ঢাকা, শনিবার, ৮ আষাঢ় ১৪৩১, ২২ জুন ২০২৪, ১৪ জিলহজ ১৪৪৫

মুক্তমত

নীরব কেন হে সৈনিক?

ফজলুল বারী, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৪, ২০১২
নীরব কেন হে সৈনিক?

‘আমি সৈনিক, কখন অ্যাটাক করতে হয় তা জানি’, এটা সর্বশেষ রংপুরের জনসভায় এরশাদের কথা। তিস্তা রোড মার্চে মানুষ দেখে খুশি খুশি কথাগুলো বলেছিলেন  পতিত সাবেক এই স্বৈরাচারী।

এর মাঝে গণতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে ব্যর্থ এক অভ্যুত্থান চেষ্টা হয়ে গেছে। কিন্তু এ নিয়ে এরশাদ কেন হঠাৎ এমন নীরব হয়ে গেলেন? কোথাও কোনো কথা নেই, ভাষা নেই, ব্যর্থ অভ্যুত্থান চেষ্টা নিয়ে একখানা কবিতা লেখাও হয়নি! বিষয়টি খুবই  গোলমেলে মনে হচ্ছে। কারণ আমাদের দেশে ইনিই সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়া একমাত্র জীবিত কুশীলব। ইদানিং তার জীবনের শেষ ‌`এইম ইন লাইফ`, জীবনে শেষবারের মতো একবার ক্ষমতায় যাওয়া। জীবনের শেষ খোয়াব। কিন্তু গণতান্ত্রিকভাবে তা সম্ভব না। কারণ সেই জনভিত্তি তার নেই। কিন্তু লক্ষ্য করে দেখবেন, অভ্যুত্থান প্রস্তুতি ব্যর্থ হবার ঘটনায় শুধু এরশাদ না, এ দলের কাজী জাফর, ফিরোজ রশীদ, রুহুল আমীন হাওলাদার কারও মুখেই কোনও রা নেই! পক্ষে না, বিপক্ষেও না! অথচ এরা কারণে অকারণে এত কথা বলেন। কথা বলতে ভালোবাসেন। কিন্তু এখন আর কোনো কথা বলছেন না। অভ্যুত্থান প্রস্তুতি ব্যর্থ হওয়ায় শু্করিয়া জানিয়েও না! কেইসটা কী?

অভ্যুত্থানকামীদের লক্ষ্য ছিল খিলাফত রাষ্ট্র। এখন যে রাষ্ট্র আছে, তা তাদের পছন্দ না। সংবিধানে বিসমিল্লাহ আছে, এরশাদের রাষ্ট্রধর্ম আছে। খিলাফত রাষ্ট্রের পথে এসব অগ্রগতি। কিন্তু যথেষ্ট না। তবে এই খিলাফতওয়ালাদের কিন্তু হাসিনা-খালেদার চেয়ে তুলনামূলকভাবে এরশাদই পছন্দ। বিদিশা তার সাবেক স্ত্রী, জিনাত সাবেক বান্ধবী হতে পারেন, কিন্তু খিলাফতওয়ালাদের এসব অপছন্দ না। বিন লাদেন ইন্তেকালের সময়ও তার তিন বিবি বহাল ছিলেন। যুদ্ধাপরাধী জামায়াত, ফতোয়াবাজ আমিনীরাও খিলাফতওয়ালাদের পছন্দ! কারণ তারা ধর্মের কথা বলে। বিএনপি এই সরকারের বিরুদ্ধে বলে। পতন চায়। এদের সবার এক রা। আজকের দিনে মহাজোটের নেতা হয়ে গেলেও এরশাদ বঙ্গবন্ধুর খুনি থেকে শুরু করে যুদ্ধাপরাধীদের সব সময় পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন। সময়ের প্রয়োজনে মাঝে এসব নিয়ে তিনি মিঠা অনেক কথা বললেও  যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রশ্নে হঠাৎই যে ইউটার্ন নেওয়া শুরু করেছেন, তা নিঃসন্দেহে অনেকের নজর এড়ায়নি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ত্বরান্বিত করার দাবিতে সর্বশেষ গণমিছিলে এরশাদ আর এ দলের প্রধান নেতারা ছিলেন না। ঢাকায় কর্মসূচির দিন আকস্মিকভাবেই গাজীপুরে এরশাদের কর্মসূচি দেওয়া হয়। তিনি মহাজোটের নেতা, তিনি চারদলীয় স্বপ্নদ্রষ্টা! তিনি সেখানেও ছিলেন, এখানেও আছেন। এখান থেকে সরকারপক্ষকে নিষ্ক্রিয় রেখে দুর্নীতির মামলাগুলো থেকে একের পর এক খালাস নিচ্ছেন! এখনই এর মাঝে যুদ্ধাপরাধী ইস্যুতে নেই। সময় মতো এখানেও থাকবেন না। মি. আনপ্রেডিকটেবল এরশাদের পক্ষে সবকিছুই সম্ভব!

গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হবার পরেও ক্যান্টনমেন্টের বাড়িতে বসে সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করে একটা কিছু ঘটানোর মতলবে ছিলেন এরশাদ। তখন বিবিসিতে ইন্টারভ্যু দিয়ে তার সে উস্কানির পরপরই তাকে গ্রেফতার করে হয়। এরপর থেকে দীর্ঘ কারাবাসের সঙ্গে ক্যান্টনমেন্টে তার প্রবেশও নিষিদ্ধ হয়েছিল। মহাজোটের নেতা হবার পর সে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করিয়ে নিতে পেরেছেন এরশাদ। এখন তার ক্যান্টনমেন্টের কোথাও যেতে নেই মানা! ১/১১-এর লোকজন ক্ষমতায় আসার পর শেখ হাসিনা-খালেদা জিয়া গ্রেপ্তার, দুর্নীতির মামলায় আওয়ামী লীগ-বিএনপির নেতারা দৌড়ের ওপর থাকলেও এরশাদের কোনো সমস্যা হয়নি। অথচ এরশাদ হলেন দেশের রাজনীতিকদের মধ্যে একমাত্র ব্যক্তি, যিনি  দেশের সর্বোচ্চ আদালতের চোখে  দুর্নীতিবাজ হিসাবে চিহ্নিত। দুর্নীতির মামলায় সাজার কারণে পাঁচ বছর কোনো নির্বাচন করতে পারেননি।

মহাজোটের নেতা হওয়া সত্ত্বেও তার সর্বশেষ বক্তব্য ও কার্যক্রমকে অনেকে মনে করেন সরকার নিয়ন্ত্রিত অথবা নির্ধারিত। আগামী দিনগুলোতে বিএনপি নির্বাচনে এলে এরশাদকে বিরোধী দলের নেতা করার চিন্তা সরকারের কারও কারও উর্বর মস্তিষ্কে আছে! এরশাদ যেমন আ স ম আব্দুর রবকে করেছিলেন, গৃহপালিত বিরোধী দলের নেতা! বিএনপিও একাধিকবার সে অভিযোগ করে বলেছে, অলীক স্বপ্নটি কখনো বাস্তবায়িত হবে না। কিন্তু এরশাদকে কে কী বলেছেন বা এরশাদও কারও কথায়-বলায় চলার মতো বিশ্বস্ত-নির্ভরযোগ্য কি না তা তাকে যারা জানেন তারা মানবেন। ঢাকার কোনো ইন্ধন-আস্কারা ছাড়া চট্টগামে বিদ্রোহ করে জেনারেল মঞ্জুরের মতো জিনিয়াস একজন অফিসার জিয়াকে মেরে ফেলেছেন, এ গল্পটি ওয়াকিফহালরা আজও বিশ্বাস করেননি। এরপর মঞ্জুরকে ধরে কাউকে কিছু বলতে দেওয়ার আগেই মেরে ফেলার ঘটনা প্রতিষ্ঠিত করেছে সে সন্দেহ। সেই একটি কৃতিত্বে ওসি কুদ্দুস সেই যে কোটিপতি বনেছিলেন, আজও তিনি দেশের শীর্ষ ধনীদের একজন! কিন্তু অজ্ঞাত কারণে খালেদা জিয়া কোনোদিন জিয়া হত্যার বিচারে আগ্রহ না দেখানোয় অনুদঘাটিতই রয়ে গেছে জিয়া হত্যাকাণ্ড আর এরসঙ্গে এরশাদের সম্পৃক্তির অপ্রকাশিত রহস্য। সেই সৈনিক আবার অ্যাটাকের কথা বলে হঠাৎই মূক ও বধির হয়ে গেলেন কেন? কোনও সম্পর্ক অথবা স্বপ্নই যদি না-ই থাকবে, তবে ব্যর্থ অভ্যুত্থান-প্রস্তুতির নিন্দা করতে সমস্যা কোথায়, সাধু?

ফজলুল বারীঃ সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক   

বাংলাদেশ সময়: ১৪০৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৪, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।