ঢাকা, শনিবার, ৮ আষাঢ় ১৪৩১, ২২ জুন ২০২৪, ১৪ জিলহজ ১৪৪৫

মুক্তমত

হাইতির পথে এক শ্বাসরুদ্ধকর বিমানভ্রমণ

আবু বকর সিদ্দিক, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭২২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৫, ২০১২
হাইতির পথে এক শ্বাসরুদ্ধকর বিমানভ্রমণ

১০ জুন ২০১১ শুক্রবার। অনেক মর্যাদাপূর্র্ণ দিন।

বিশেষ করে বাঙালি মুসলমানদের কাছে দিনটি ধর্মীয় দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ঠিকমত আদায় না করলেও শুক্রবার পরিষ্কার জামা কাপড় পরে মসজিদমুখি হওয়ার নিরব প্রতিযোগিতা লক্ষ্য করা যায়। ওয়াক্তিয়া নামাজে মসজিদের এক চতুর্থাংশ পূরণ না হলেও শুক্রবারে মসজিদ, মসজিদের বাহির এমন কি খোলা আকাশের নিচে রাস্তায় রোদ-বৃষ্টির মধ্যে নামাজ আদায় করতেও কোনো কুন্ঠা বোধ নাই। আমার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নয়।              

আজ সেই শুক্রবার। কিন্তু একি! ঘুম থেকে উঠার পর শরীরে কেমন যেন অন্য এক অনুভূতি। দীর্ঘ ৩০/৩২ ঘন্টা বিমান ভ্রমণ। এত সময় বিমান ভ্রমণ! ভাবতেও অবাক লাগে। কোনো দিনকল্পনাও করিনি। পুলিশ বিভাগে চাকুরির সুবাদে আজ এই সুযোগ। আনন্দের মধ্যেও মন নিরানন্দ। নিজেকে কেমন যেন একা একা মনে হচ্ছে। স্ত্রী , ছেলে , মেয়ে, আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে  এক বছর বিদেশে থাকতে হবে। যদি আর কোনো দিন ফিরে তাদের কাছে ফিরে যেতে না পারি। আমার অনুপস্থিতিতে যদি কিছু হয়ে যায়। বার বার স্বজনদের চেহারা মানসপটে বন্যার পানির মত আঘাত হানছে ।
             
মাঝে মধ্যে ফোন। পুলিশ ক্লাবে একা বসে আছি। কখন বাজবে ১২.০০ টা। না! আজকের ঘন্টা অনেক বড়। সময় আর যায় না। দীর্ঘ দিন পথ চলার পর তৃষ্ণাকাতর ক্লান্ত পথিক যেমন চলতে পারে না তেমনি ঘড়ির কাঁটাও চলতে পারছে না। হায়! এভাবেই হয়তো এক দিন চলতে চলতে মাঝ পথে থেমে যাবে, পথ শেষ হবে না।              

আমি ৮০ জন সদস্যের কমান্ডার। বাংলাদেশ থেকে হাইতি নিয়ে যেতে হবে। বিভিন্ন প্রকার চিন্তা মনের ভিতর কাল বৈশাখির ঝড়ের মত উলট পালট করছে। রাত্রে সামান্য বৃষ্টি হলেও সকাল থেকে মেঘশূন্য আকাশ। আমার সঙ্গী অনেকেই বিমানের সময় জানার জন্য বার বার মোবাইলে কল করে। বিভিন্ন বিষয়ে দিক নির্দেশনা দিচ্ছি । আমাদের মালামাল বিমানবন্দরে পৌঁছাল কিনা  জানার চেষ্টা করছি।                

১২.০০ টা বাজার ১০ মিনিট আগেই বয়কে ডেকে রুমের চাবি দিয়ে বের হলাম। কিন্তু কোন মায়ামন্ত্র আমাকে কঠিন পাথর করে দিয়েছে। পা দুখানা আটকে গেছে। পা তুলতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। জন্মভূমি আমাকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চায়। বিদায় দিতে চায় না। তারপরও অনেক কষ্টে রাস্তায় গেলাম। রিক্সার জন্য অপেক্ষা করছি। একি! হঠাৎ চারদিক অন্ধকার হয়ে এলো। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি, কই সূর্য ? অভিমানে মুখ ঢেকেছে। মসজিদ থেকে আজানের ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। আকাশের চোখ বেয়ে দু’এক ফোটা জল পড়তে শুরু করেছে। এবার  নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারছি না। মনে হচ্ছে প্রকৃতি আমাকে সত্যিই বিদায় দিচ্ছে।                

রিক্সায় রওনা হলাম। খুব কাঁদতে ইচ্ছা হচ্ছে। কি লজ্জা! রিক্সাওয়ালা বা পথচারী যদি টের পেয়ে যায়। তাই খুব কষ্ট করে নাক মুখে রুমাল দিয়ে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে পৌঁছলাম। সেখানে আরো এক মন খারাপ করা দৃশ্য। আমার সহযাত্রী অনেকের আত্মীয়-স্বজন অশ্র“ জলে বিদায় দিতে এসেছে। আমার জন্য কেউ আসেনি,আসবেনা জানি। ছোট একটি শিশু মায়ের কোলে দেহটাকে মুচড়িয়ে  মুচড়িয়ে চিৎকার করছে । প্রতিটি শিশু মায়ের কোলকে নিরাপদ মনে করে। সন্তানের কাছে মায়ের কোলের মত শান্তি পৃথিবীতে আর কোথাও নেই। কিন্তু এই শিশুর জন্য মায়ের কোল কেন আজ  বিভীষিকা ? তার ক্রন্দনে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠছে। তার বিদায়ী পিতার কোল আজ এই শিশুর কাছে কত না সুখ ও শান্তিময়। এই টুকু শিশু তার জ্ঞানইবা কতটুকু। রক্তের বাঁধন যে কত শক্তিশালী ! পিতার অনুপস্থিতি এই শিশু টের পেয়ে গেছে।       
        
এই সকল দৃশ্য দেখে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। পা দু’খানা অবশ হয়ে গেল। চেয়ারে বসে পড়লাম। উচ্ছ্বসিত ক্রন্দন জোয়ারের পানির মতো বাঁধ ভেঙ্গে ফেললেও সবলে রোধ করে আসছি। প্রতিটি মুহুর্ত যেন এক একটি বছর। সময় এগিয়ে আসছে । আহত পাখির মতো  ছটফট করতে করতে এক সময় আতœসমর্পণ করলাম ।

বিশেষ বাসযোগে রওনা হলাম। বিমানবন্দরে পৌঁছালাম। নিজের বলে কিছু নেই। এক অজানা শক্তি আমাকে পরিচালনা করছে। বিমান বন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলো। নিরিবিলি একটা জায়গা খোঁজার জন্য বিমানবন্দরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ঘুরে ফিরতেই ফাস্টফুডের  দোকানের একটি ছোট স্টোর রুম পেয়ে গেলাম। অনুমতি নিয়ে দরজা বন্ধ করে ভিতরে প্রবেশ করলাম । হঠাৎ মেঘের র্গজনের ন্যায় কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম। দু‘চোখ থেকে বন্যায় বাঁধভাঙ্গা স্রোতের মতো  ন্যায় জল পড়তে লাগলো। বেশ কিছু  সময় এ ভাবে চলার পর আস্তে আস্তে নিজেকে সামলে নিলাম। তার পর মোবাইলযোগে ঘনিষ্ঠ জনদের নিকট থেকে বিদায় নিলাম।                  

বৈকাল ৫.০০ টার সময় বিমানে উঠার পালা। বিমানের কাছে গেলাম। বারবার বিমানটি দেখলাম। জর্ডান এয়ার লাইন্সের বিমান। সিঁড়ি দিয়ে বিমানে উঠলাম। অনুমান ২৫০ সিটের বিমানে আমরা যাত্রী ১৬০ জন। সবাই সিটে বসে পড়েছে। আমিই শেষ ব্যক্তি। আমার জন্য বাম পার্শ্বের প্রথম আসন রাখা ছিল। দুইজনের বসার স্থান আমি একাই বসলাম। কিন্তু তাতে কী? সাগরে ঝড় উঠলে বড় বড় ঢেউ যেমন কিনারে আছড়ে পড়ে আমার মনের মধ্যে তেমনি বেদনার ঢেউ উথাল পাথাল করছে। কোনো মতেই নিজেকে শান্ত করতে পারছি না ।  
          
জর্ডান এয়ার লাইন্সের বিমান হাইতির পথে
হে আল্লাহ,  তুমি মানুষকে এত জ্ঞানে সমৃদ্ধ করেছ যার হিসাব এই মানবকূলের পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। তুমি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী এবং ওদের অন্তবর্র্তী সব কিছু সৃষ্টি করেছ শুধু মানুষের জন্য। সুরা আররহমান-আয়াত (১৩)
“তবে  তোমরা তোমাদের রবের কোন অনুগ্রহ অস্বীকার করবে?

-    না আমাদের কোন কিছুই অস্বীকার করার নাই। তোমার অনুগ্রহে জলে, স্থলে, আকাশে এমনকি এক গ্রহ থেকে অন্য গ্রহে যাবার পথ প্রশস্ত করেছ। তোমার প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে শেষ করা যাবে না। আমি তো নেহায়েত তোমার অধম বান্দা। জ্ঞান গরিমা বলতে তেমন কিছু নাই। যে টুকু দিয়েছো সেটা দিয়েই আজ আমার এই লেখার প্রয়াস। তুমি আমাকে কবুল করে নাও, আমিন।
-                
বেলা ৫.২০ মিনিটে বিমানের দরজা বন্ধ করে দিল। অকস্মাৎ সর্বাঙ্গে কাঁটা দিয়ে উঠলো। যতটুকু দেখা যায়, অনেকের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। আমি কিন্তু ব্যতিক্রম নই। বিমানবালা এসে সিটবেল্ট বাঁধা শিখিয়ে দিল। সিট বেল্ট বাঁধা হলো। বিমান দুর্ঘটনায় পড়লে কি করতে হবে বলে দিল। এই বার মনে হলো মরণপুরীতে যাবার ব্যবস্থা পাকা। মরণপুরী সর্ম্পকে আমার কোনো জ্ঞান নেই। যতটুকু জানি মৃত্যুর উদ্দেশ্যে যাত্রা। অর্থাৎ অনিবার্য মৃত্যু। এই সময় মা, বাবা, স্ত্রী, পুত্র, কন্যা আত্মীয় স্বজনদের কারো কথা মনে নেই, মনেও পড়ছে না। সকলেই দোয়া কালাম পড়তে শুরু করেছে।

হে আল্লাহ্ তুমি ছাড়া আর কেউ নেই। তুমি রাহমানির রাহিম। তোমার রহমত ছাড়া আমরা পৌছতে পারবো না। আজ রোজ হাসরের কথা মনে হয়। রোজ হাসরের বিচার দিনে সকলেই ‌‌’ইয়া নফসি ইয়া নফসি’ করবে। কে মা, কে বাবা, কে স্ত্রী, পুত্র, কন্যা আত্মীয়স্বজন কারো কথা মনে থাকবে না। এমনকি শরীরে কোনও বস্ত্র থাকবে না। কিন্তু কারো প্রতি নজর দেয়ার ফুসরত হবে না। মনে হয়, আজ সেই রোজ হাসরে বিচারের যৎসামান্য নমুনা মাত্র। এতেই এত ভয়, এত উৎকন্ঠা।    

কেন আমরা সেই দিনের কথা স্মরণ করি না? কেন আমরা পার্থিব জীবন নিয়ে এত ব্যস্ত থাকি? কেন আমরা অন্যায় করতে কুন্ঠাবোধ করি না? বিপদে পড়লে শত সহস্রবার আল্লাহর নাম মনে পড়ে, উদ্ধারকারী তুমি ছাড়া কেহ নাই। কিন্তু পরে নিজেদের  নফস নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না।                

বিমান ৫.৩০ মিনিটে যাত্রা শুরু করে। ৫.৩১ হতে ৫.৩৫ এই ৪  মিনিট দম বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম। হার্ট বিট স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক গুণ বেড়ে যায়। পায়ের নখ থেকে শিরশির শুরু করে মাথা পর্যন্ত পৌঁছে যায়। শরীরের লোম, মাথার চুল খাড়া হয়ে যায়। সামান্য এদিক ওদিক হলেই চোখের নিমিষে সব শেষ। পালানোর সুযোগ নেই। আল্লাহ্ তায়ালার অশেষ মেহেরবানিতে আমাদের বহনকারী বিমান কিছু সময়ের মধ্যে ৮০০/৯০০ মাইল গতিতে ৩২০০০/৩৩০০০ ফিট উপর দিয়ে চলা শুরু করে।                   

সিট বেল্ট খোলা হলো। বিমান থেকে খাবার পরিবেশন করলো। উন্নত মানের খাবার। কিন্তু গলা দিয়ে নিচে নামতে চায় না। সারাদিন তেমন কিছুই খাওয়া হয়নি। তারপরও পেটে ক্ষুধা নেই। অনেক কষ্টে খেলাম।

হে সৃষ্টিকর্তা, আজ তুমি আমার জীবনকে আর একবার স্বার্থক করলে । যেমন করেছিলে আমার জন্মের সময়। একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ রুপে এই পৃথিবীতে পাঠিয়ে। যে কোনো একটি অঙ্গ না দিলে আমার কিছুই বলার বা করার ছিল না। এজন্য তোমার প্রতি আর একবার শুকরিয়া আদায় করি। বিমানের কাচের ছোট্ট জানালা দিয়ে বাইরে চোখ রাখতেই দেখি, একি অপরুপ দৃশ্য। নীচ থেকে নীল আকাশের গায়ে বিভিন্ন মেঘপুঞ্জ দেখেছি। অনেক কবি, সাহিত্যিক এই মেঘপুঞ্জ দেখে কবিতা ও সাহিত্য সমৃদ্ধ করেছেন। আমি  মেঘকে শুধু মেঘ হিসাবেই দেখেছি। তার অপরুপ দৃশ্য বা ভয়ংকর দৃশ্য কিছুই  চোখে পড়েনি। যা পড়েছে তা কবিতা বা সাহিত্য লেখার জন্য যথেষ্ট না।  

আজ আমি সেই মেঘের উপরে, অনেক উপরে। আমার নিচে মেঘগুলি শুভ্র ঘন, মাঝারি ও হালকাভাবে কোথাও দাঁড়িয়ে আছে আবার কোথাও বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। এই মেঘের ফাঁকে ফাঁকে সবুজের সমারহ। মনে হয় মেঘগুলি সবুজের সাথে লুকোচুরি খেলা করছে। বড় বড় নদীগুলি নদী বলে মনেই হয় না; যেন সরু খাল। গাছের গুঁড়ি ফেলে পার হওয়া যাবে। ছোট নদী অজগর সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলছে। শহরের বড় বড় দালানকোঠা আলাদিনের সেই দৈত্যের হাতের মুঠায়। বড় বড় শহরগুলি দেখতে যেন শিল্পীর তুলিতে ক্যানভাসে আঁকা ছবি। অনেক সময় চোখে পড়েছে দীর্ঘদিন অনাবৃষ্টিতে কৃষিজমির মাটি চৈত্রের খরতাপে ফেটে চৌচির তেমনি দৃশ্য।

মেঘগুলি শিমুল গাছের ডালে ডালে পরিপক্ক খোল হতে সদ্য পরিস্ফুটিত তুলা যেমন থরে থরে সাজানো অতিশুভ্র নয়ন জুড়িয়ে যায় ঠিক তেমনি মেঘগুলি থরে থরে সাজানো। সেই অপরুপ দৃশ্য লিখে প্রকাশ করার মত নয়। হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে হয়। ঐ দূরে ছোট টিলা বড়টিলা পাহাড়-পর্বতের মতো মেঘ গুলি দাঁড়িয়ে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করছে। কখনো কখনো খুব শুভ্র ঘন মেঘ দেখে মনে হয়েছে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে রাশি রাশি তুলা পড়ে আছে ।  
           
রাশি রাশি তুলার মতো মেঘ
পৃথিবীর কত মানুষ শীতে কষ্ট পায়। এই তুলা পৃথিবীর শীতার্ত সকল মানুষের মাঝে বিলিয়ে  দিলেও শেষ হবে না। অথচ এই সামান্য তুলা পেয়ে তারা কতই না খুশী হতো। আবার কখনো গাছ থেকে বাতাসে উড়ে বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে থাকা তুলার মতো মেঘগুলি ছড়ানো ছিটানো। কোথাও মৃদু বাতাসে নদীর পানিতে ওঠা ঢেউয়ের মত মেঘ গুলি খেলায় মগ্ন। কোথাও মেঘগুলি দুর্বার গতিতে ছুটে চলছে। পিছনে ফিরে দেখার সময় নেই। আজ নববধূর ডাকও যেন তার কানে পৌঁছাবে না।         

পড়ন্ত বেলার মিষ্টি রোদ সাদা মেঘের উপর লালচে গোলাপি রঙ ঢেলে দিয়েছে। দেখে মনে হয় কোনো শিল্পী তার মনের মাধুরী দিয়ে এই রঙের মিশেল ঘটিয়েছে। মৃদু বাতাসে সেই মেঘগুলি রঙ বদলায় যেন রঙের খেলা চলছে। মাতোয়ারা হয়ে রঙের খেলা দেখতে দেখতে কখন যেন রাঙ্গা বধু লজ্জায় মুখ ঢেকে পালিয়ে যায় বুঝতেই পারিনি। যাবার সময় তার পদধ্বনি শুনিনি। কানের কাছে ফিস ফিস করেও কিছু বলেনি। শুধু রেখে গেছে সাতটি রং। তার রেখে যাওয়া রং দিয়ে মেঘগুলি নিজ অঙ্গে মেখে সুন্দরী প্রতিযোগিতায় নেমেছে ।  

রাতের বেলা আকাশ পথে চলা সে আর এক অভিজ্ঞতা। আকাশে চাঁদ উঠেছে কিনা জানি না। তার স্নিগ্ধ আলো পৃথিবীকে দিয়েছে কিনা তাও দেখি নাই। আজ কোনো দম্পতি বেলকনিতে বসে পারবে না তাদের স্মৃতিকথা উজাড় করে দিতে। পারবে না প্রেমিকপ্রেমিকা হৃদয়ের ভালোবাসার কথা বলতে। পারবেনা তারা চাঁদের আলোতে অবগাহন করতে। চাঁদকে নিয়ে লেখা হবেনা কোনো কবিতা। চাঁদহীন আকাশে দেখেছি ছোট বড় তারাগুলি মিট মিট করে জ্বলছে ।

বিমান থেকে নিচে কিছুই চোখে পড়েনি। শুধু দেখেছি অন্ধকার। কিন্তু কোনো শহর বা বন্দরের পাশ দিয়া যাবার সময় মনে হয়েছে নিচে আর একটি আকাশ। আকাশের গায়ে ছোট বড় তারার মত শহরের আলোগুলি মিটমিট করে জ্বলছে। আমি দুই আকাশের মাঝ দিয়ে চলছি। ভাবতেই অবাক লাগে। সারা রাত্রি  জেগে শুধু এই সকল দৃশ্য দেখছি ।          

হঠাৎ কান ধাপা লেগে শো শো শব্দ করছে। এই বুঝি কানের তালা ফেটে যায়। বাইরের কোনো শব্দই শোনা  যাচ্ছে না। পায়ের পাতা শির শির করছে। শরীরের ওজন হালকা হালকা লাগছে। বিমান শুধু নিচের দিকে নামছে। আমার সঙ্গে বিমানে সহযাত্রী মহিলাদের সর্ম্পকে কিছু নাইবা বললাম। বুঝলাম বিমান অবতরণ করবে। মনে পড়ে অবতরণ করার সময় যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে কত বিমান দুর্ঘটনায় পড়েছে। কত লোক মারা গেছে তার হিসাব নাই। সকলের মুখে আল্লাহর নাম। দোয়া কালাম পড়তে পড়তে বাংলাদেশ সময় রাত্রি ১২.৪০ মিনিট এবং জর্দান সময় রাত ০৯.২৫ মিনিটে বিমান জর্দানের রাজধানী আম্মান বিমানবন্দরে অবতরণ করে।

বাংলাদেশে রাত ০৪.৩০ মিনিট এবং জর্দানে রাত ০১.১৫ মিনিটের সময় বিমানের যাত্রা শুরু হলো। সেই রাতের আকাশ। রাত যেন শেষ হয় না। আজ নিদ্রাদেবী পালিয়েছে। দুচোখের পাতা এক করতে পারছি না। হঠাৎ দেখি বিমান আটলান্টিক সাগরে পানিতে অবতরণ করছে। ভয় ভয় লাগছিল। বাংলাদেশ সময় বেলা ১২.৪০ এবং পুর্তুগাল সময় সকাল ০৭.০০ ঘটিকায় পর্তুগালের শান্তা মারিয়া বিমানবন্দরে  বিমান অবতরণ করে।

শান্তা মারিয়া বিমানবন্দর আটলান্টিক মহাসাগরের পাড়ে অবস্থিত। হালকা কুয়াশাচ্ছন্ন সূর্য তখনো উদিত হয়নি। বেশ শীত শীত ভাব। তাপমাত্রা ১৭/১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শীতের কাপড় পরে আমরা বিমান থেকে বের হলাম। বেশ আনন্দ লাগছিল। খাঁচার পাখি ছাড়া পেলে আনন্দে দিশেহারা হয়ে যায়। আমরাও অনেকটা তাই। সকলেই এদিক ওদিক ছুটাছুটি করছি। বিমানবন্দরের কোনো নিয়ম মানা হচ্ছে না। মনে হয় ছোট শিশুদের স্কুল ছুটি হয়েছে ।              

এই বিমানবন্দর থেকে কম সংখ্যক যাত্রী ওঠানামা করে। আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দেয়ার জন্য সব বিমানে তেল নেয় । বিমানের রানওয়ে সাগরমুখি। সাগরের দিক থেকে এসে বিমান ল্যান্ড করে । ল্যান্ড করার সময় মনে হয় বিমান সাগরের পানি ছুঁই ছুঁই। আবার বিমান ফ্লাই করার সময়ও একই রকম।
    
শান্তা মারিয়া বিমানবন্দরে জানতে পারি, শান্তা মারিয়া বিমানবন্দর থেকে হাইতি বিমানবন্দরে বিমানে যেতে ০৬.৩০/০৭.০০ ঘন্টা সময় লাগে। এই সময় শুধু আটলান্টিক মহাসাগরের উপর দিয়ে বিমান চলবে। ০৬.৩০/০৭.০০ ঘন্টা আটলান্টিক মহা সাগরের উপর! হঠাৎ অত্যধিক শীতে শরীরের লোম যেমন খাড়া হয় তেমনি আমার শরীরের লোম খাড়া হয়ে ওঠে। শরীরের মধ্যে শির শির করতে লাগলো। হার্টবিট বেড়ে যাচ্ছে। আমার মত অনেকের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল।                  

আটলান্টিক মহাসাগরে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের কথা শুনেছি। বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের উপর দিয়ে যাবার সময় কত জাহাজে, কত বিমানে থাকা মানবসন্তান, সাগরমাতা তার নিজ মাতৃত্বের টানে বুকে টেনে নিয়েছে তার হিসাব হয়তো নাই। কোন মাতৃত্বের টানে সাগরমাতা এই মানব সন্তানদের নিজ বুকে টেনে নিয়েছে? সেই সন্তানদের ভাগ্যে কী ঘটেছে? সেই বিষয়ে অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা করে কোনো কুল কিনারা পায়নি, এমনকি জাহাজের কোনো ক্ষুদ্রাংশও উদ্ধার হয়নি। হয়তো কোনো দিনই এই রহস্যের দ্বার উন্মোচিত হবে না।

মনে পড়ে ছোট বেলার সেই দিন গুলি। লেখা পড়ার জন্য বাবা মায়ের বকুনি ও স্কুল শিক্ষকের মার খেয়ে কতদিন নদীর পাড়ে একা একা বসে থেকেছি। যদি লাল পরী নীল পরীর দেখা পাই। সিনেমার নায়কের মত লাল পরী নীল পরীর ডানায় চড়ে পাতালপুরীতে যেতাম। সেখানে রাক্ষসের সাথে যুদ্ধ করে সব রাক্ষস মেরে ফেলবো। রাজকন্যাকে উদ্ধার করবো। বীরদর্পে পাতালপুরিতে  থেকে যাব। আর ফিরে আসবো না। কিন্তু আজ  সাগরমাতা আদর করে বুকে টেনে নিয়ে পাতালপুরির রাজকন্যাসহ রাজত্ব দিলেও কি রাজি হওয়া  যায় ? শুধু আমি কেন ? পৃথিবীর কেহই রাজি হবে না।

সাগর মাতা, তুমি পৃথিবীর তিন ভাগ গ্রাস করেছ। তোমার বুকে ধন রতেœর পাহাড় গড়েছ। প্রতিবৎসর লক্ষ লক্ষ মানুষ তোমর বুকে টেনে নিচ্ছ। তারপরও কি তোমার সাধ মিটেনি ? সাগর মাতা ! তুমি কি সত্যই ক্ষুধার্থ ? তুমি কি জান ? পৃথিবীর কত মানুষ না খেয়ে থাকে । কত শিশু না খেয়ে পুষ্টির অভাবে ধুঁকে ধুঁকে মরছে ? কত মানুষ পেটের ক্ষুধায় দ্বারে দ্বারে ঘুরছে ?  তুমি কি তাদের চেয়েও বেশী ক্ষুধার্থ ? জানি তোমার ক্ষুধা কোনো দিন মিটবে না । সাগর মাতা! তুমি আমাকে ডেকো না। তোমার মায়াবী হাতছানি উপেক্ষা করা বড়ই কঠিন।                    

বাংলাদেশ সময় ১৪.৪০ টায় এবং পুর্তগাল সময় সকাল ০৯.০০টায় আমাদের বহনকারী বিমান হাইতির উদ্দেশ্যে রওনা হলো। আটলান্টিক সাগরের উপর দিয়ে চলছে। মাঝে মধ্যে বিমান ঝাকুনি দিলেই বুকে ছ্যাঁৎ করে ওঠে, যেমন ওঠে কুমার লোহা পুড়িয়ে লাল করে পানিতে দিলে। এই বুঝি সাগরমাতা হাত ছানি দিয়ে ডাকছে ।  
              
দিনের বেলা। সূর্য তার রশ্মি বিনা বাধায় আপন গতিতে বিকিরণ করছে। এত ভয় ভীতির মধ্যেও সাগরের সৌন্দর্য দেখার লোভ সংবরণ করতে পারলাম না। আবহাওয়া ভাল থাকায় সমুদ্রের পানি বিমান থেকে বোঝা যায়। বিমান অনেক উপরে থাকায় সমুদ্রের ঢেউ চোখে পড়ে না। তবে আটলান্টিকের বুকে বরফের ছোট ছোট পাহাড় চোখে পড়েছে। সূর্যের আলো বরফের উপর পরে মনে হয় স্বচ্ছ কাচের স্তূপ। কিছু পাহাড়ের অধিকংশ বরফ গলে যাওয়ার ফলে বিচিত্র আকার ধারণ করেছে। মনে হয় কোনো শিল্পী বরফ কেটে মনের মাধুরি দিয়ে বিভিন্ন চিত্র তৈরি করেছে। সেই চিত্রকর্মের উপর সূর্যের তীর্যক রশ্মি পড়ায় মণিমুক্তা হীরার মত বিভিন্ন রঙ বিচ্ছুরিত হচ্ছিল। মনে হয় কোনো রাজা বাদশার ধনভাণ্ডারের সমস্ত মণিমুক্তা, হীরা উক্ত চিত্র কর্মে বসানো হয়েছে।                  

যেদিকেই চোখ যায়, দুর দিগন্তে আকাশ সমুদ্রের সাথে মিশে একাকার হয়ে গেছে। অনেক স্থানে কুয়াশচ্ছন্ন সমুদ্র সাদা চাদর মুড়ে ঘুমিয়ে আছে। সাদা, কালো, ধুসর নানা রঙের মেঘগুলি মনের আনন্দে সমুদ্রের পানির উপর দিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে । অনেক সময় মনে হয়, ছোট ছোট খন্ড খন্ড মেঘ রাজহংসের মত সমুদ্রের পানিতে স্বাধীনভাবে নিজেদের অস্তিত্ব প্রকাশ করছে । অনেক সময় দূর দিগন্তে দেখেছি, মেঘের সাদা-কালো বড় বড় পাহাড় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

সমুদ্রের বুক দিয়ে চলাচলকারী বড় বড় জাহাজ দেখে মনে হয় শিশুদের খেলনা। সময় শেষ হয় না। এই সময় কত কথাই না মনে পড়ে। বিশেষ করে শিশুকালের দিনগুলি। বাবা-মায়ের চোখের মণি কলিজার টুকরা, আদরের সন্তান চোখের আড়াল হতে দিত না। সবসময় বুকে আগলে ধরে রাখতো। আজ সেই সন্তান একা, বড়ই একা। স্ত্রী, পুত্র, কন্যা যাদের জন্য জীবন দিতেও কুন্ঠা নেই, আজ তাদের ভালোবাসা কোথায় ? কই! তাদের ভালোবাসা আমাকে পিছু ডাকে না । তবে কি শুধুই স্বার্থ ?  স্বার্থের ভালোবাসায় আমি আজ রিক্ত।                

মোক্ষম সময় এসে গেল। বাংলাদেশ সময় রাত ১০.০০টা এবং হাইতি সময় সকাল ১১.০০টায় হাইতি বিমানবন্দরে পৌঁছি। মনে মনে বলি, আল্লাহ্ তোমার অশেষ দয়া। এই মরণপুরী থেকে তুমি বাঁচালে। মনে মনে বললাম, বাপরে বাপ আর বিমানে উঠবো না। ৩২ ঘন্টার বিমানভ্রমণে প্রতি মুর্হূত কেটেছে নতুন নতুন শংকায়।

হাইতি থেকে আবু বকর সিদ্দিক, সহকারী পুলিশ সুপার
BANFPU-1(Rotation-1), MINUSTAH, HAITI

বাংলাদেশ সময়: ১৬৫২ ঘণ্টা, ২৫ জানুয়ারি, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।