ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে ফিরে দেখা ইতিহাস

পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার পথে উত্তাল-তরঙ্গের দিনগুলি

অধ্যাপক ড. এ কে এম মাহবুব হাসান, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০১৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৮, ২০২১
পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার পথে উত্তাল-তরঙ্গের দিনগুলি

শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অবিচার ও ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে পূর্ব বাংলার জনগণের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন।

স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার সেই মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী আগামী ১৭ মার্চ।  তার প্রতি শ্রদ্ধা।

প্রথম পর্ব
নিখিল ভারত মুসলিম লীগে বাঙালি নেতৃত্ব ও পূর্ব বাংলায় আওয়ামী লীগের নবযাত্রা 
২৩ জুন ১৭৫৭ পলাশীর আম্রকাননে ইতিহাসের ঘৃণিত খলনায়ক মীর জাফর ও লর্ড ক্লাইভের ষড়যন্ত্রে বাংলা-বিহার উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার করুণ পরাজয় হলে শুরু হয় ইংরেজদের শোষণ ও লুণ্ঠন, যা থেকে মুক্তি পেতে ভারতবাসীর পেরিয়ে যায় ১৯০ বছর। ব্রিটিশ শাসনামলে নানা রকমের বিদ্রোহ ও আন্দোলনের মাধ্যমে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ভারতীয়রা ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে। ২৮ ডিসেম্বর ১৮৮৫ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে বোম্বাইয়ে ৭২ জন প্রতিনিধি নিয়ে ‘ভারতের জাতীয় কংগ্রেস’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ভারত উপমহাদেশে ধনী ও শিক্ষিত মুসলিমরা বিশ শতকের শুরুতে মুসলিমদেরকে শিক্ষিত ও রাজনৈতিকভাবে সচেতন করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। একটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে ১৯০৬ সালের সেপ্টেম্বরে লখণৌতে, অক্টোবরে সিমলাতে এবং সর্বশেষে ৩০ ডিসেম্বরে ঢাকায় বিশতম সর্বভারতীয় মোহামেডান শিক্ষা সম্মেলন থেকে প্রথম সভাপতি হিসাবে নবাব স্যার সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের জন্ম হয়।  

১৯০৭ সালে কলকাতায় মুসলিম নেতৃবৃন্দের এক সভায় নিখিল বঙ্গ মুসলিম লীগ গঠিত হলে সলিমুল্লাহ তার সভাপতি হন। ১৯০৮ সালে পূর্ববঙ্গ ও আসাম নিয়ে প্রাদেশিক মুসলিম লীগ গঠিত হলে সলিমুল্লাহ তার সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং ১৯০৯ সালে প্রাদেশিক মুসলিম লীগ পূণর্গঠন করে এর সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২ মার্চ ১৯১২ পূর্ববঙ্গ ও আসাম মুসলিম লীগ এবং পশ্চিমবঙ্গ মুসলিম লীগ একীভূত হয়ে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের প্রাদেশিক শাখা হিসাবে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ গঠিত হয় যার সভাপতি হন সলিমুল্লাহ।  

১৯৩৪ সালে এম এ জিন্নাহ নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সভাপতি হলে তার সাথে এ কে ফজলুল হকের মতবিরোধ তীব্র হয়ে ওঠে। ১৯৩৪ সালে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী আসামে মুসলিমদেরকে অনুপ্রাণিত করে আসাম প্রাদেশিক মুসলীম লীগ গঠন করেন। ১৯৩৬ সালে ঢাকায় ফজলুল হক কৃষক প্রজা পার্টি গঠন করে এর কার্যক্রম জোরদার করেন।  ১৯৩৭ সালে কৃষক-প্রজা পার্টি ও মুসলীম লীগ জোটবদ্ধভাবে নির্বাচনে জয় লাভ করলে ফজলুল হক প্রথমবার বাংলার প্রধানমন্ত্রী হন। এই ঐক্য ভেঙ্গে গেলে ১৫ অক্টোবর ১৯৩৭ সালে ফজলুল হক লক্ষ্ণৌ অধিবেশনে মুসলিম লীগে যোগদান করে বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সভাপতি এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাধারণ সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব নিলে কৃষক প্রজা পার্টি হয় দুর্বল আর মুসলিম লীগ হয় শক্তিশালী। এভাবেই মুসলিমরা কলকাতা, আসাম ও পূর্ববঙ্গে মুসলিম লীগ-এর সাথে নানা নাম যুক্ত করে নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রাখেন। কংগ্রেসের মোহন-দাস করমচাঁদ গান্ধী (মহাত্মা গান্ধী), জওহরলাল নেহেরু, সুভাষ বোস ও মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দসহ প্রমুখরা ভারতের স্বাধীনতার দাবিতে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন জোরদার করলে ব্রিটিশরা ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। ধর্মীয় ভিত্তিতে ভারত বিভাজনের নানামুখী বিরোধিতা থাকা সত্ত্বেও ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান এবং ১৫ আগস্ট  ভারত নামে দুটি আলাদা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ভারতের ঐক্যবদ্ধতা অটুট থাকলেও পাকিস্তানের দুই অংশ পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে নানা বৈষম্য ও বিভেদের কারণে দূরত্ব বাড়তে থাকে। পূর্ব বাংলার মানুষের অধিকার আদায়ে নতুন চিন্তা ধারার রাজনৈতিক দল গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়।

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিমের নেতৃত্বাধীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ এবং মওলানা ভাসানীর আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের যৌথ প্রয়াসে ২৩ জুন ১৯৪৯ ঢাকার কে এম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে প্রায় ৩০০ নেতা-কর্মীদের সম্মেলনে পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সভাপতি, আতাউর রহমান খান, শওকত হোসেন ও আলী আহমদ খান সহ-সভাপতি, শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক এবং কারাবন্দী অবস্থায় শেখ মুজিবুর রহমান যুগ্ম-সম্পাদক হিসাবে নতুন এই দলের দায়িত্ব পান। ১৯৫২ সালের এপ্রিল মাসে জেল থেকে মুক্ত হয়ে শেখ মুজিব করাচি গিয়ে সোহরাওয়ার্দীর সাথে আলোচনা করলে সোহরাওয়ার্দী জিন্নাহ আওয়ামী মুসলিম লীগ বাদ দিয়ে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করেন। পাকিস্তান সৃষ্টির পরে ফজলুল হক কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে না থেকে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের অ্যাডভোকেট জেনারেলের পদে চাকরি করতে থাকেন এবং ১৯৫৩ সালের সেপ্টেম্বরে চাকরি ছেড়ে মুসলিম লীগে যোগদান করেন। ৯ জুলাই ১৯৫৩ ঢাকার নবাবপুর রোডের মুকুল সিনেমা হলে পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম সম্মেলনে মওলানা ভাসানীকে সভাপতি এবং শেখ মুজিবকে সাধারণ সম্পাদক করে কার্যনির্বাহী কমিটি গঠিত হয়। দায়িত্ব নিয়ে শেখ মুজিব দেশের সর্বত্র ঘুরে নবগঠিত দলকে সুসংগঠিত করার কাজে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন।  

২১-২৩ অক্টোবর ১৯৫৫ ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশনে পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগকে অসম্প্রদায়িক করার লক্ষ্যে দলের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দিতে উপস্থিত প্রায় সাতশত কাউন্সিলরের পাঁচজন বাদে অন্য সবাই সমর্থন করেন যা ছিল এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। ধর্ম নিরপেক্ষ থেকেও যে একটি রাজনৈতিক দল শক্তিশালী হতে পারে তা স্পষ্ট ও প্রয়োজনীয় হতে থাকে। এই অধিবেশনেই মওলানা ভাসানী সভাপতি এবং শেখ মুজিব সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৭ সালের জুলাই মাসে মওলানা ভাসানী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করে পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ত্যাগ করেন। ৬-৮ মার্চ ১৯৬৪ ঢাকার গ্রীনরোডের আমবাগানে পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল সভায় মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ সভাপতি এবং শেখ মুজিব পুনরায় সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। শেখ মুজিব পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের মাঝে এক অসামান্য নেতা হয়ে ওঠেন এবং দলের শক্তি বৃদ্ধিতে নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন। ৭ অক্টোবর ১৯৫৮ পাকিস্তানের প্রথম রাষ্ট্রপতি সাহেবজাদা ইস্কান্দার আলী মির্জা সামরিক আইন জারি করে জেনারেল মোহাম্মদ আইয়ুব খানকে প্রধান সামরিক শাসক নিয়োগ করেন। ২৭ অক্টোবর ১৯৫৮ আইয়ুব খান রাষ্ট্রপতি ইস্কান্দার মির্জাকে পদচ্যুত করে নিজে রাষ্ট্রপতির পদ দখল করেন। সামরিক আইনে রাজনৈতিক দল ও কর্মকান্ড নিষিদ্ধ হলে মুসলিম লীগ ও আওয়ামী মুসলিম লীগও বন্ধ হয়ে যায়। (চলবে)

লেখক: অধ্যাপক, প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।