আজ এমন একজন বিদুষী, আলোকিত নারীকে নিয়ে আমি কিছু লিখতে বসেছি- যাঁর কথা মনে হতেই চোখের সামনে ভেসে উঠছে অপরূপ, স্লিগ্ধ, মায়াভরা একটি মুখ যেন চির চেনা, আদি এবং অকৃত্রিম বাঙালি নারীর প্রতিকৃতি, তিনি আর কেউ নন- সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহধর্মিণী ও জীবনসঙ্গী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব। ৯১তম জন্ম জয়ন্তীতে তাঁর স্মৃতির প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা ও প্রণতি।
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম যথার্থই বলেছেন-
“বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি
চির কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী
অর্ধেক তার নর। ”
সত্যি কথা বলতে কি- যে কোন বড় কাজের আড়ালে থাকে কিছু অজানা ত্যাগ, তিতিক্ষা এবং নিরব সংগ্রাম। একটি চারাগাছের মহীরুহ হয়ে বেড়ে ওঠার পেছনে যেমন থাকে কারো না কারোর নিরলস প্রচেষ্টা এবং অনন্য ত্যাগের মহিমা- তেমনি মহৎ সৃষ্টিশীল এবং গৌরবময় কাজে অনুপ্রেরণা ও সাহস যোগানোর পেছনেও থাকে একজন নারীর মহিমান্বিত ত্যাগ ও ভূমিকা। যাঁর নেতৃত্বে আমরা একটি স্বাধীন, সার্বভৌম দেশ পেয়েছি, কোটি কোটি মানুষের যিনি শ্রদ্ধা ও ভালবাসার একজন হয়ে উঠেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁর পেছনেও ছিল একজন ক্লান্তিহীন, বিচক্ষণ, দৃঢ় চিত্তের অধিকারী নারী- তিনি আমাদের বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর চিরকালের আদর্শিক সঙ্গী, শুদ্ধতম বাঙালি নারীর প্রতীক। তাঁর কাছে আমরা আজীবন ঋণী হয়েই রইব।
১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট মধুমতি নদীর শাখা বাইগার নদীর ঢেউ আর মুক্ত সজীব বাতাসের শান্ত পরিবেশে টুঙ্গিপাড়া গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ফুলের মত গায়ের রং ছিল বলে মা ডাকতেন রেণু। কিন্তু দুর্ভাগ্য রেণুর, মাত্র তিন বছর বয়সেই বাবাকে হারান তিনি। দাদা তাকে ঐ বয়সেই চাচাত ভাই শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে বিয়ে দেন। পাঁচ বছর বয়সে মা কে হারানোর পর শ্বাশুড়ি সায়েরা খাতুন তাঁকে বুকে টেনে নেন।
দিন চলে যায় - ধীরে ধীরে ফজিলাতুন নেছা রেণু হয়ে ওঠেন স্বামী-সন্তান এবং সংসার অন্তঃপ্রাণ এক চিরাচরিত বাঙালি নারী। হয়ে ওঠেন বাংলার শোষিত, নির্যাতিত, নিপীড়িত জনগণকে মুক্তির চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে তোলার আন্দোলন সংগ্রামে স্বামীর পাশে থাকা এবং সাহসী সহযোদ্ধা, বন্ধু। বাংলার মানুষের ন্যায়সঙ্গত দাবী দাওয়া, অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে যে আপোষহীন ও ক্লান্তিহীন আন্দোলন বঙ্গবন্ধু গড়ে তোলেন ফজিলাতুন নেছা মুজিব ছিলেন তার নিরন্তন সঙ্গী ও প্রেরণাদাত্রী। ছয়দফা, এগারদফা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সংগ্রাম, পাকিস্তানি কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি-কোথায় নেই তাঁর নিরলস অন্তহীন, সংগ্রামী ভূমিকা ও অসাধারণ সাহসী মনোবলের দৃঢ়তা?
১৯৬৮ সালের ৩ জানুয়ারী রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র’ মামলা দায়ের করা হয়। এক বছরেরও বেশী সময় তিনি বন্দী ছিলেন। ফজিলাতুন নেছা মুজিব এই পুরো সময়টা রাজবন্দীদের পরিবারের খোঁজ খবর নিয়েছেন, ঊনসত্তরের গণ আন্দোলনে ছাত্র জনতার সঙ্গে একাত্ম হয়ে এই ষড়যন্ত্রের মোকাবেলা করেছেন। অবশেষে ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবকে কারামুক্ত করতে সক্ষম হন। তখন শেখ মুজিব হয়ে উঠেন ‘বঙ্গবন্ধু’।
১৯৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ জয় এবং বঙ্গবন্ধুর প্রধানমন্ত্রী হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাকে বানচাল করার তৎকালীন পাকিস্তানি শাষকদের গভীর ষড়যন্ত্রের সেই দুঃসময়েও বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকে সাহস জুগিয়েছেন ফজিলাতুন নেছা মুজিব। ১৯৭১ এর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের নেপথ্যেও ছিল ফজিলাতুন নেছা মুজিবের অনন্য অবদান। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যাবার আগে তিনি শেখ মুজিবকে বলেছিলেন কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে এবং তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেছিলেন- মনে রেখো তোমার সামনে আছে জনতা পেছনে বুলেট সুতরাং কারও তৈরী করা কথা নয়, তোমার মন যা চায়, তোমার মনে যে কথা আছে তুমি তাই বলবে। কি অসাধারণ দৃঢ়চেতা প্রেরণাদাত্রী! ১৯৭১ সালের ৭মার্চ, পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণ সেদিন বঙ্গবন্ধু জাতিকে উপহার দিয়েছিলেন যাঁর ফলশ্রুতিতে স্বাধীনতার লাল সূর্যকে আমরা ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিলাম। মাত্র ৫৪ বছরের জীবনে বঙ্গবন্ধু ৪ হাজার ৬৮২ দিন কারাগারেই ছিলেন।
এই সময়গুলোতে সন্তানদের এবং সংসারের দেখভাল করা ছাড়াও তিনি দলের নেতা কর্মীদের ও খোঁজ খবর নিতেন। দলের নেতা কর্মীদের পরিবারের যে কোন সংকটে পাশে দাঁড়াতেন। কন্যাদায়গ্রস্থ পিতা কিংবা তাদের ছেলে মেয়েদের শিক্ষার জন্যে, যার যা কিছু প্রয়োজন হাত বাড়িয়ে দিতেন। তিনি ছিলেন প্রখর বুদ্ধিমত্তার অধিকারী। সব কিছুই মনে রেখে দিতে পারতেন। বঙ্গবন্ধু তাই তাঁকে বলতেন ‘জীবন্ত ডায়রী’। মোট কথা বাঙালি জাতির দীর্ঘ স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন পুরোমাত্রায় সক্রিয়। দুটি যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁকে আজীবন লড়াই করে যেতে হয়েছে একটি তাঁর সংসার, অন্যটি রাজনৈতিক অঙ্গন।
আজ বঙ্গবন্ধুর যে লেখক পরিচিতি তার নেপথ্যেও রয়েছে ফজিলাতুন নেছা মুজিবের বিশাল ভূমিকা। ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৯ প্রায়শই কারাগারে রাজবন্দী থাকা অবস্থায় শেখ মুজিব তাঁর আত্মজীবনী লিখেছেন। তিনি সেখানে লিখেছেন- ‘আমার সহধর্মিণী একদিন জেল গেটে বসে বলল, বসেই তো আছ, লেখ তোমার জীবন কাহিনী’। শুধু তাই নয় একদিন তিনি লেখার জন্যে কয়েকটি খাতাও দিয়ে গেলেন। প্রথম দিকে সামান্য দ্বিধাগ্রস্থ থাকলেও খাতা হাতে পেয়ে শেখ মুজিব লিখতে শুরু করে দিলেন। স্মৃতি নির্ভর এই “অসমাপ্ত আত্মজীবনী” গ্রন্থে তিনি তাঁর জীবনের বিভিন্ন প্রেক্ষাপটের ছবি এঁকেছেন নিপুনভাবে- ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এ এক অসামান্য প্রাপ্তি। আমরা ফজিলাতুন নেছা মুজিবের কাছে ঋণী হয়ে থাকব তাঁর এই অপরিসীম অবদানের জন্যে।
তিনি ছোটবেলায় লেখাপড়া করেছেন মিশন স্কুলে। তারপর শিক্ষা নিয়েছেন পারিবারিক গৃহ শিক্ষকের কাছে। পড়াশোনার প্রতি ছিল তাঁর অদম্য আগ্রহ। পরবর্তীতে তিনি যখনি সময় সুযোগ পেতেন পড়াশুনা করতেন। তুখোর মেধাবী ফজিলাতুন নেছা মুজিবের স্বপ্ন ছিল শিক্ষার আলোকে আলোকিত একটি উন্নত দেশ, উন্নত সমাজ। তাই মানব কল্যাণে তিনি আজীবন ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে নিজের দুই ছেলেকে যুদ্ধের সম্মুখ সমরে পাঠাতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করেননি তিনি। স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন নয় মাস তিনি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে বন্দী ছিলেন। ‘বঙ্গবন্ধু’ ও তখন পাকিস্তানের জেলে বন্দী ছিলেন। তাঁর কোন খবর কেউ জানতো না, প্রতিদিন নানারকম গুজব শোনা যেত শেখ মুজিবকে মেরে ফেলার আয়োজন চলছে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নেতারা বেগম মুজিবের উপর নানা রকম চাপ প্রয়োগ করতো, যাতে তিনি শেখ মুজিবকে যুদ্ধ বন্ধ করার কথা বলেন- তা না হলে তাঁর এবং তাঁর সন্তানদের জীবন রক্ষা পাবে না। কিন্তু ফজিলাতুন নেছা মুজিব ছিলেন তাঁর সিদ্ধান্তে অটল, অনড়। কোন রকম চাপের মুখে তিনি নতি স্বীকার করেননি। তিনি বলেছিলেন স্বামী যদি বীরের মত জীবন বিসর্জন দিতে দ্বিধা না করেন তবে তিনি কেন ভীরুর মত অন্যায়ের কাছে আত্মসমর্পণ করবেন। তাইতো তিনি হলেন আমাদের বঙ্গমাতা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিদীপ্ত, দূরদর্শী মহীয়সী বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিবের নাম তাই স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
স্বাধীনতার পরে যুদ্ধ বিধস্ত দেশকে গড়ে তোলার প্রতিটি কাজে তিনি বঙ্গবন্ধুর সাথে ছিলেন নিঃস্বার্থভাবে। পরোপকারী ফজিলাতুন নেছা মুজিব আমাদের নারী সমাজের জন্য এক অনুকরণীয় আদর্শ। মুক্তিযুদ্ধে সম্ভ্রমহারা মা-বোনদের সহযোগিতা করা, তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করাসহ ব্যক্তিগত ভাবে তাদের পাশে গিয়ে সান্ত¡না দিতেন তিনি এবং সামাজিকভাবে তাদের প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগও নিয়েছিলেন। তিনি নারী পুর্নবাসন কেন্দ্র গড়ে তোলেন। স্বাধীনতা সংগ্রামে ও স্বাধীনতা পরবর্তীতে দেশ ও জাতি গঠনে বঙ্গমাতার অবদান অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিবের মহৎ কাজ ও নেপথ্য রাজনৈতিক জীবনের বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতা আগামী প্রজন্মের জন্য অনুকরণীয় হয়ে থাকবে এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিবের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে দেশ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলেই আমার বিশ্বাস। বঙ্গমাতার অবদানকে পরম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করার জন্য প্রতিবছর যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে জাতীয় ভাবে ৮ আগস্ট তাঁর জন্মবার্ষিকী উদযাপন করা হয়ে থাকে। কবির ভাষায় বলতে ইচ্ছে করে,
“বঙ্গমাতা
তুমি আজ মোদের নয়ন সমুখে নাই তবে
কোটি কোটি হৃদয়ে পেয়েছ যে ঠাঁই-”
লেখক: চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি