(২০২০ সালে বঙ্গমাতার বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব-এঁর জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন অনুষ্ঠানে উপস্থাপিত মূল প্রবন্ধ)
আগস্ট মাস আমাদের কান্নার মাস। এই মাসে আমরা হারিয়েছি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁর পরিবারের সদস্য তিন পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শেখ রাসেল, পুত্রবধূ সুলতানা কামাল, পারভিন রোজী, ছোট ভাই শেখ আবু নাসের, ভগ্নিপতি আব্দুর রব সেরনিয়াবত, আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা শেখ ফজলুল হক মনি এবং বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবকে।
বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব, যিনি ছায়াসঙ্গিনী হিসেবে নেপথ্যে থেকে বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির পথচলাকে সুগম করতে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন। আগস্ট মাস ভাবলে অবাক লাগে। আমরা সৃষ্টিকর্তার লীলা বুঝিনা, বোঝার ক্ষমতাও আমাদের নেই। আমি অবাক হয়ে যাই। এই মাসে বেগম মুজিব আসলেন, শেখ কামাল আসল। আবার বঙ্গবন্ধুর সাথে সবাই চলে গেলেন। আমি বেগম মুজিবকে নিয়ে দুই একটি কথা বলতে চাই। বেগম মুজিব ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ছায়াসঙ্গিনী।
সৈয়দ শামসুল হকের একটি কথা মনে পড়ে- ‘বেগম মুজিবের ডাক নাম ছিলো রেণু। সেই রেণু থেকে সুরভিত ফুলের রেণু হয়ে যিনি বঙ্গবন্ধুর জীবনকে ভরিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব। ’ তাঁর মানবিকতা বঙ্গবন্ধুর মত একজন নেতাকে বিপদে আপদে সব কিছুতে যে সাহস ও নিঃশর্ত সমর্থন যুগিয়েছিল। যিনি স্কুলে যাননি, কলেজে যাননি, কিন্তু তিনি বঙ্গবন্ধুর চোখে সারা পৃথিবীকে দেখেছেন। সেই মহিয়সী নারী ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বুলেটে নির্মমভাবে নিহত হন। নির্মম হত্যাকান্ডের সময় তিনি ঘাতকদের বলেছিলেন ‘আমাকেও মেরে ফেলো। ’
আমার অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে সেই মহিয়সী নারীকে শ্রদ্ধা নিবেদন করছি, যিনি সত্যিকারের অর্থে জীবন থেকে শিক্ষা নিয়েছিলেন এবং শিক্ষা দিয়েছিলেন। তিনি স্বশিক্ষিত বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব। বেগম মুজিব, সেই ছোট্ট রেণু- সংবেদনশীল মন নিয়ে যিনি তাঁর স্বামীর সব কর্মকান্ডকে সমর্থন করেছিলেন। আমি অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে পড়েছি- রেণু যখন বঙ্গবন্ধুর বাড়ীতে এসেছিলেন, তখন শ্বশুর-শ্বাশুড়ী তাঁকে পুত্রবধূ ও মেয়ের স্নেহ দিয়েছিলেন।
আমাদের দেশের অনেক রাজনৈতিক নেতা বলেন ঘরের লোকদের কাছ থেকে অনেক কিছুর সমর্থন পাওয়া যায় না। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর বাড়ীতে সহযোগিতা বা সমর্থনের অভাব ছিল না। বঙ্গবন্ধু বাড়ীতে থেকেছেন খুব অল্প সময়। কিন্তু যখন বাড়িতে এসেছেন তখন সেই সময়টুকু সোনার আলোয় ভুবন ভরিয়ে দিয়েছেন রেণু, বেগম মুজিব।
৫ বছর বয়সে তিনি মা কে হারালেন এবং ৩ বছর বয়সে হারালেন বাবাকে। বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফর রহমান রেণুকে শেখ মুজিবের সাথে বিয়ে দিয়ে দিলেন। এক দিকে বালিকা বধূ অন্য দিকে সেই শ্বশুর শ্বাশুড়ি। আমি বলবো গোপালগঞ্জের মাটি ধন্য যে তারা এরকম একজন নারীকে দেখেছেন। বঙ্গবন্ধু মাঠে ফুটবল খেলছেন, আবার ছাত্রদের নিয়ে সংগঠন করছেন- ছায়াসঙ্গিনী হিসেবে প্রতিটি কর্মকান্ডে বাড়ী থেকেই বেগম মুজিব সাহস যুগিয়েছেন। এরকম একজন সঙ্গিনী আল্লাহর অশেষ রহমত ও দান।
আমরা দেখি সমাজে যারা উচ্চ শিখরে, সেই সব নেতাদের আশে পাশের লোকগুলি, বিশেষ করে যারা কাছের লোক- তারা বেশি উচ্চাভিলাষী হয়ে ওঠে। কিন্তু বেগম মুজিবে মধ্যে এই জিনিসটি ছিল না। আমরা জানি ৩২ নম্বরে তিনি তাঁর পরিজন নিয়ে সাধারণভাবে জীনযাপন করতেন। সাধারণ মানুষ তাঁর কাছে আসতে পারবেনা ভেবে তিনি বঙ্গভবনে পর্যন্ত গেলেন না। এ থেকে বোঝা যায় তিনি জনসাধারণের কত আপন জন ছিলেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে শুনেছি বঙ্গবন্ধু যখন প্যারোলে আসবেন তখন পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন দিক নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে প্যারোলের বিপক্ষে মত দিয়েছিলেন বঙ্গমাতা। আমাদের দেশের সাধারণ অবস্থায় আমরা জানি কোন ভদ্রমহিলার স্বামী তার কাছে আসবে, এই আকুলতা, এই ব্যাকুলতা স্বাভাবিক। কিন্তু তাঁর বিপরীতে বেগম মুজিব প্রতিটি আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম পর্যন্ত- প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে তাঁর স্বামীকে আকুন্ঠ সমর্থন ও সাহস যুগিয়েছিলেন।
বঙ্গমাতা যখন শুনলেন বাংলাদেশ মুক্ত হয়েছে, স্বাধীন হয়েছে, খানসেনারা পরাজয় বরণ করেছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে, সেই সময় বেগম মুজিব এক ঝটকায় পাকিস্তানের পতাকা ভেঙ্গে পায়ে চেপে টুকরো করে ফেলেছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, এই সংবাদে তিনি বিজয়ের আবেগে এতটাই আন্দোলিত হয়েছিলেন। তাঁকে যে বাড়িটিতে আটকে রাখা হয়েছিল সেই বাড়িটি খানসেনাদের পাহারায় ছিল, তারা ইচ্ছা করলে তাকে মেরেও ফেলতে পারত, কিন্তু তিনি মৃত্যুর কোন পরোয়া করেননি।
যুদ্ধের পরবর্তী সময় যিনি মহান মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত মেয়েদের মায়ের মমতায় পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তিনিই বঙ্গমাতা বেগম মুজিব। তিনি একটা সময় বঙ্গবন্ধুকে অনেক কাছে পেয়েছিলেন, সেটা হল বঙ্গবন্ধুর চিকিৎসার জন্য যখন বিদেশে গেলেন এবং তিনিও সঙ্গে গেলেন। বোধ হয় তখনই তিনি পরম মমতায় বঙ্গবন্ধুকে সেবা করার সুযোগ পেয়েছিলেন।
পঁচাত্তরের পনেরই আগস্টের ভয়ংকর প্রত্যুষে ঘাতকদের বুলেটের সামনে নির্ভীক বঙ্গমাতার কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল ‘আমাকেও মেরে ফেলো’। কবির ভাষায় বলি-
“পাড়ি দিতে নদী, হাল ভাঙে যদি, ছেঁড়ে যদি তার কাছি,
মৃত্যুর মুখে দাঁড়ায়ে জানিব তুমি আছো, আমি আছি। ”
লেখক: সংসদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার