জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্য ভারতের একটি ধর্মনিরপেক্ষ, বিকেন্দ্রীভূত এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ একীভূত জাতি গঠনের দৃষ্টিভঙ্গির কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত। ভারতে যোগদানের পর থেকে কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যটিতে যথেষ্ট রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক এবং সামরিক সম্পদ ব্যয় করেছে এবং আজও, পাকিস্তানের যুদ্ধংদেহি মনোভাবের কারণে জম্মু ও কাশ্মীর ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার অন্যতম প্রধান বিষয়।
যে কোনো অঞ্চলের রূপান্তর নির্ভর করে অঞ্চলটিতে বসবাসরত জনগণের কাছে উপস্থাপিত প্রতিকূলতার প্রকৃতির ওপর। প্রতিকূলতা থেকেই তৈরি হয় সম্ভাবনার এবং কেন্দ্রশাসিত জম্মু ও কাশ্মীর অঞ্চলে এর অভাব নেই।
ব্লক উন্নয়ন পরিষদ এবং চলমান জেলা উন্নয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠান জম্মু ও কাশ্মীরের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করেছে, যা ভারতের তিন স্তরীয় শাসন ব্যবস্থার অধীনে স্থানীয় সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। মূলধারার রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য নির্বাচনে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতে স্থানীয় সরকারের সর্বনিম্ন স্তরের প্রতিনিধিত্বকারী পঞ্চায়েতগুলিকে গত বছরে ২০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি তহবিল বিতরণের মাধ্যমে শক্তিশালী করা হয়েছে। স্থানীয় সরকারের এই শক্তিশালীকরণের ফলে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল জম্মু ও কাশ্মীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য তিনটি জাতীয় পুরস্কার পেয়েছে।
জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যকে দু’টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল (জম্মু-কাশ্মীর এবং লাদাখ)হিসেবে পুনর্গঠন করার নয়া দিল্লীর সিদ্ধান্তের পর কেন্দ্রীয় সরকার জম্মু ও কাশ্মীরে সর্ব-অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন, দক্ষ শাসন এবং অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য সামাজিক-অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবায়নের জন্য কাজ করে চলেছে। এই ইতিবাচক পরিবর্তনের ফলে সমাজের সকল অংশের জীবনে উন্নতি হয়েছে এবং কেন্দ্র সরকার কর্তৃক প্রণীত বিভিন্ন আইন জম্মু ও কাশ্মীরে প্রবর্তন করা হয়েছে। এই আইনের মধ্যে রয়েছে নারী, শিশু এবং সুবিধাবঞ্চিতদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার রক্ষা ও প্রচারের জন্য প্রণীত আইনসমূহ যেমন- বিনামূল্যে ও বাধ্যতামূলক শিক্ষার অধিকার আইন ২০০৯, কিশোর ন্যায়বিচার (শিশুদের যত্ন ও সুরক্ষা) আইন ২০১৫, মানবাধিকার সুরক্ষা আইন ১৯৯৪, তথ্য অধিকার আইন ২০০৫, সরকারী ভাষা বিল ২০২০ এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের জন্য নতুন আবাসন নিয়ম।
কৃষি ক্ষেত্রে বিখ্যাত কাশ্মীরি আপেলের জন্য একটি অনন্য বাজার প্রকল্প চালু করা হয়েছে, যার ফলে এ১৫ হাজার টনেরও বেশি আপেল কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি সংগ্রহ করে তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে মূল্য স্থানান্তর করা হয়েছে। এছাড়াও বিশ্ব বিখ্যাত কাশ্মীরি জাফরানের (বিশ্বের একমাত্র জাফরান ১৬০০ থেকে ১৮০০ মিটার উচ্চতায় উৎপাদিত হয়) অনন্য পরিচয় রক্ষা করতে এবং এর উৎপত্তিস্থল নিশ্চিত করার জন্য ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) ট্যাগ দেওয়া হয়েছে।
সরকারি চাকরিতে দ্রুত এবং স্বচ্ছভাবে কর্মী নিয়োগের প্রতিশ্রুতি মেনে, জম্মু ও কাশ্মীর সরকার তরুণদের জন্য একটি দ্রুত নিয়োগ প্রক্রিয়ার অধীনে সকল স্তরে ১০ হাজার পদে বিজ্ঞাপন দিয়েছে, পরবর্তী পর্যায়গুলিতে ২৫ হাজার অতিরিক্ত পদ পূরণ করা হবে। এই চাকরির জন্য বাছাই প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন মাপকাঠির মধ্যে এলাকার বাসিন্দা, তালাকপ্রাপ্ত মহিলা বা এতিম মেয়ে আবেদনকারীদের প্রতি অতিরিক্ত গুরুত্ব দেয়া হবে। সরকার একটি কর্মসূচি পুনরুদ্ধার করেছে যার অধীনে সমস্ত সরকারি চাকরি জম্মু ও কাশ্মীরের বাসিন্দাদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে।
শিক্ষাক্ষেত্রে ২৫ হাজার আসন সম্বলিত ৫০টি নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যা ৭০ বছরের মধ্যে জম্মু ও কাশ্মীরের শিক্ষাগত সুবিধার সবচেয়ে বড় সম্প্রসারণ। পাঁচ লাখেরও বেশি শিক্ষার্থী বেশ কয়েকটি সরকারী বৃত্তি প্রকল্পের সুবিধা গ্রহণ করেছে যা আগের বছরের তুলনায় চারগুণ বেশি। একইভাবে, চিকিৎসা ক্ষেত্রে দু’টি অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিকেল সায়েন্সেস, সাতটি নতুন মেডিকেল কলেজ, পাঁচটি নতুন নার্সিং কলেজ এবং একটি স্টেট ক্যান্সার ইনস্টিটিউট করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। স্কুলের শিশুদের উন্নত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য একটি ছাত্র স্বাস্থ্য কার্ড যোজনাও চালু করা হয়েছে।
জম্মু ও কাশ্মীরে অবকাঠামো উন্নয়নে ৮০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি মূল্যের ৫০০টিরও বেশি প্রকল্প সম্পন্ন হয়েছে এবং প্রায় ৮০০ মিলিয়ন ডলারের দুই হাজারের বেশি প্রকল্প অনুমোদিত হয়েছে। বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে বিলম্বিত প্রকল্পের বাধাগুলি অপসারণ করা হয়েছে এবং সেই প্রকল্পগুলির অনেকগুলিই প্রায় সমাপ্তির কাছাকাছি। জম্মু ও শ্রীনগরকে আধুনিক, টেকসই স্মার্ট শহর হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে, যেখানে ৯০০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি মূল্যের ১৯০টি প্রকল্প পরিকল্পনা করা হয়েছে। উভয় শহরে হালকা রেল ট্রানজিট ব্যবস্থার প্রস্তাবও অনুমোদিত হয়েছে। প্রথমবারের মতো একটি আবাসন, বস্তি উন্নয়ন, পুনর্বাসন এবং জনপদ নীতি অনুমোদিত হয়েছে, যার অধীনে দুই লাখ ঘর নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে। ৭০ বছরে প্রথমবারের মতো তিল লাখের বেশি পরিবারকে বিদ্যুৎ ব্যবহারের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।
৬০ হাজার শয্যার ১৭টি কোভিড-১৯ হাসপাতাল স্থাপন করা হয়েছে যাতে ২০ হাজার নিবিড় পরিচর্যা এবং ২৫ হাজার আইসোলেশন ইউনিটে অক্সিজেন সুবিধা রয়েছে। শ্রীনগর দেশের ১৬টি জেলার মধ্যে অন্যতম যা মহামারী ব্যবস্থাপনায় সর্বোত্তম অনুশীলনের জন্য স্বীকৃত। সরকার স্টার্ট-আপগুলির জন্য একটি আইটি পার্কের প্রয়োজনীয়তাও স্বীকার করেছে এবং কিছু লজিস্টিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য বিনামূল্যে অফিসের জায়গা দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। শিল্প ও বাণিজ্য বিভাগ জম্মু ও শ্রীনগরে দুটি আইটি পার্ক স্থাপন করবে।
জম্মু ও কাশ্মীরের পর্যটন খাতে অপার সম্ভাবনা রয়েছে এবং একটি শ্রম-নির্ভর শিল্প পর্যটন হওয়ায় অন্যান্য শিল্পের তুলনায় কর্মসংস্থানের ব্যাপক সুযোগ রয়েছে যা স্থানীয় জনগণের আর্থিক উন্নয়নের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় কোষাগারে রাজস্ব প্রদান করে।
অবশেষে, জম্মু ও কাশ্মীর নিজের প্রকৃত সম্ভাবনাকে পুরোপুরি কাজে লাগানোর জন্য স্বীকৃতি ও সমর্থন পেয়েছে এবং এখন সেই সময় এসে গেছে যখন সমগ্র বিশ্ব কাশ্মীর নামক উদযাপনের অংশ হতে চাইছে। মানুষের মানসিকতার পরিবর্তনের সাথে সাথে উন্নয়ন, সুযোগ, আশা এবং সমৃদ্ধির একটি নতুন যুগ শুরু হয়েছে। জম্মু ও কাশ্মীরের সঙ্গে দেশের বাকি অংশের অংশীদারিত্ব উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় এই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলকে ভারতের উজ্জ্বল মুকুট হতে সাহায্য করবে।
উপত্যকায় পর্যটন, শিক্ষা, অবকাঠামো, দক্ষতা উন্নয়ন, উদ্যোক্তা এবং অর্থনীতির উন্নয়নে একটি ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি করতে সংস্থা, বেসরকারি এবং অন্যান্য দায়িত্বশীল সংস্থার সঙ্গে কাজ করতে সরকার সম্পূর্ণভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ইতোমধ্যে কাজ শুরু হয়েছে এবং ফল আসতে সময় লাগতে পারে, কিন্তু উদ্দেশ্য যেখানে জনগণকে সাহায্য করা, তাতে কোন সন্দেহ নেই যে জম্মু ও কাশ্মীর ভারতের সর্বশেষ সাফল্যের গল্প হতে যাচ্ছে!
লেখক: ব্রাইটার কাশ্মীরের সম্পাদক, কলামিস্ট, টিভি কমেন্টেটর এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক