ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

শেম! মুন্নি সাহা

মাহবুব মিঠু, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৪৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০১২
শেম! মুন্নি সাহা

(১)
সাংবাদিক দম্পতি খুন হবার দু’দিন পরেই আমার একটা ইনটেনসিভ কোর্স শুরু হয়। কাকতালীয়ভাবে কোর্সটার বিষয়বস্তুর সঙ্গে মেঘের জীবনের বর্তমান মুহূর্তগুলোর বেশ মিল রয়েছে।

বিষয়ের নাম “Bereavement and loss”. সারাটা সপ্তাহ জুড়ে যে বিষয়গুলো আলোচিত হলো ক্লাসে, সত্যি কথা কি, বারবার আমার মেঘের মুখটা ভেসে উঠছিল।

একই সময়ে ঘটতে থাকা তিনটি ঘটনা নাগরিক হিসেবে আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে। তাজউদ্দিনের নাতিকে পেটানোর পরে আদালতের স্বতঃপ্রণোদিত পদক্ষেপ আমাদেরকে খুশি করলেও প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। রাষ্ট্রের কাছে বড় বড় আত্মীয়বিহীন আমাদের মতো ছোট নাগরিকের অবস্থান কোথায়? আমাদের নিরাপত্তার ভাবনা কার? রাজনীতিবিদদের সাম্প্রতিক বক্তব্য এবং কাজ দেখে মনে হয়েছে, আসলে নেতা এবং রাজনীতি কার স্বার্থে? জনগণ নাকি নিজেদের ক্ষমতায় নেবার স্বার্থই শুধু লক্ষ্য। তৃতীয় উদ্বেগটা একটা আধুনিক সভ্য রাষ্ট্রের অস্তিত্বের জন্য ভয়াবহ। সাংবাদিক দম্পত্তির খুনের পরে একেক সময়ে পুলিশের একেক আচরণে জনমনে রাষ্ট্রের প্রতি তীব্র অবিশ্বাস এবং সন্দেহ তৈরি হয়েছে। এমনকি রাষ্ট্রের পক্ষে রাষ্ট্রযন্ত্রের কারো কোনো সত্য কথাও বিনা দ্বিধায় সত্য বলে মেনে নিতে কেউ পারছে না। এগুলোর একটাও হঠাৎ করে তৈরি হয়নি। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে এই আস্থাহীনতা কিংবা রাষ্ট্র যন্ত্রের সঙ্গে জনগণের অবিশ্বাসের সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে। পরিস্থিতির কারণে হয়তো এখন সেগুলো প্রকাশ্যে, সরবে আলোচিত হচ্ছে মাত্র।

উপরের ধারাবাহিকতায় সাংবাদিক দম্পত্তির হত্যা পরবর্তীতে কয়েকটি সংশয় দেখা দিয়েছে। এগুলো হলো- অপরাধীরা ধরা পড়বে তো নাকি জজ মিয়ার মতো আর কেউ ভুক্তভোগী হবে? অপরাধী ধরা পড়লেও শাস্তি নিশ্চিত হবে তো? এবং সেই সঙ্গে যেহেতু মেঘের সামনে হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটেছে এবং সে একজন স্বাক্ষী। তাই মেঘের নিরাপত্তার কথাও সঙ্গতভাবে আলোচনায় আসছে।

কিন্তু যে কথা বা কথাগুলো কেউ ভাবছে না সেটা হলো মেঘের জীবনকে স্বাভাবিকীকরণ প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্র এবং সমাজের দায়িত্ব নিয়ে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে আমাদের দেশে এখনো মানসিক ক্ষতিগুলো আমলে নেওয়া হয় না। শুধুমাত্র চাক্ষুষ ক্ষতিগুলোই বিবেচ্য বিষয়। এ কারণেই ট্রমা বা কাউন্সিলিং এর মতো মানসিক স্বাস্থ্য নিশ্চিত করার কথা আমাদের কারো ভাবনাতেই আসে না। তাই সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ডর পরে বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক বিষয় আলোচিত হলেও মেঘের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কারো তেমন উদ্বেগ নেই। অথচ খুনি ধরা পড়া কিংবা খুনির বিচার হবার মতোই মেঘের মানসিক স্বাস্থ্য নিশ্চিত করাও একইসঙ্গে, সমানতালে  অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। নিজের চোখের সামনে বাবা-মাকে খুন হতে দেখার প্রতিক্রিয়া একজন অবুঝ বাচ্চাকে মানসিকভাবে কতোটুকু ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে সেটা ধারণাতীত। এই মুহূর্তে মেঘের জন্য এবং মেঘকে যারা লালন-পালনের দায়িত্ব নেবেন তাদেরকে দক্ষ কাউন্সিলরের দ্বারস্থ করা জরুরি।

(২)
ফিরে আসি কোর্সটির ব্যাপারে। যারা কোর্সটি নিয়েছিলেন তাদের মধ্যে দু’জন সমগ্র অস্ট্রেলিয়াতে যারা লস এন্ড গ্রিফের উপরে কাজ করেন তাদের মধ্যে অন্যতম। এদের একজন হচ্ছেন ক্যারল, যার পড়ানোর মধ্যে অন্যতম একটা সৌন্দর্য হলো বিভিন্ন ক্লাসিক আর্টের সঙ্গে মিল রেখে বক্তব্য এগুতে থাকে। পিছনে বড় পর্দায় পৃথিবীর বড় বড় চিত্রকরের আঁকা বিখ্যাত ছবিগুলো ভেসে উঠার সঙ্গে বক্তব্য এগুতে থাকে। পড়ানোর এ এক অদ্ভুদ সৌন্দর্য! অসম্ভবভাবে বিষয়বস্তুর গভীরে নিয়ে যায় অবলীলায়। ছবি এবং বক্তব্যের সঙ্গে মনে হয় ঘটনাগুলোর সঙ্গে আমি নিজেও হেঁটে চলেছি। প্রত্যক্ষ করছি মানুষ বা মানুষদের বেদনা, কষ্টগুলো। নিজেকে গর্বিত মনে হয়, মানুষের অচেনা গহীণ পথে হেঁটে হেঁটে না বলা কষ্টের সাথী হয়ে কিছুটা দুঃখ লাঘবের সঙ্গী হতে পেরে।

প্রতিদিন ক্লাস শেষ করে এবং লাঞ্চ ব্রেকের সময় আমি অনলাইনে পত্রিকাগুলো পড়ে মেঘের পরিস্থিতির সঙ্গে ক্লাসের বিষয়বস্তু মিলাতে গিয়ে ভাবাবেগে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি। হায়রে আমাদের চারপাশের পরিবেশ। শুধু বাইরের ব্যথাটাই দেখি। ভিতরের না দেখা ক্ষতগুলো যেগুলো সারা জীবন মানুষকে তাড়া করে ফেরে, রয়ে যায় অবহেলিত। আমি এখনও ট্রমা, লস এন্ড গ্রিফের ছাত্র যেটা কিনা সোস্যাল ওয়ার্কের টপিকগুলোর মধ্যে বলা যায় ব্যবহারিক। তাছাড়া এই ছোট্ট পরিসরে পুরো বিষয়টা লেখা সম্ভবও নয়। ছাত্র হিসেবে এটুকু অন্ততঃ ধারণা হয়েছে, মেঘকে স্বাভাবিক জীবনে ভাল করে ফিরিয়ে আনার জন্য তার মানসিক স্বাস্থ্যকে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে।  

এই পরিস্থিতির শিকার মানুষদের বিভিন্ন ধরনের মানসিক এবং শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। প্রথম চেষ্টাটাই হতে হয় ঘটনাগুলোকে মেনে নিয়ে বাস্তব জীবনে ফিরিয়ে আনা। বলাটা অনেক সহজ হয়ে গেল; কিন্তু করাটা অনেক অনেক কঠিন। এই কঠিন দায়িত্ব নিতে পারে শুধু একজন অভিজ্ঞ কাউন্সিলর। প্রথমেই ট্রমাটাইজড মানুষের মনে প্রশ্ন জাগে,

“Coming back to life
What is life like now?”

না, জীবনটা ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার মতো সব সময় এতো নিষ্ঠুর নয়। কিন্তু জীবন যে মানবিক, সেই বোধটা জাগিয়ে তোলাই হচ্ছে কঠিন। শ্রেণীকক্ষে একের পর এক Bereavement and loss এর উপরে বিভিন্ন থিওরি এবং কেসস্টাডি আলোচনা হচ্ছিল। ভুক্তভোগীর মনে আরো জটিল জটিল প্রশ্নের উদয় হয়। অতি আপনজনদের হারিয়ে নতুন পরিবেশে, নতুন সম্পর্কগুলো জটিল মনে হয়।

“who I am with you?
Who I am without you?”

এ প্রেক্ষাপটে মা বাবাকে হারিয়ে মেঘের ভিতরে সম্পর্কের তুলনামূলক ভাবনা আসতে পারে। সে হয়তো মা বাবার আদরের সঙ্গে বর্তমানে যারা তাকে রক্ষণাবেক্ষণ করছে তাদের ব্যবহারকে মিলানোর চেষ্টা করবে। নিজের আইডেনটিটি নতুন পরিস্থিতিতে বুঝার চেষ্টা করবে। মা-বাবাহীন অবস্থায় সে কে? আমাদের সমাজে এ ধরনের পরিস্থিতির শিকার বাচ্চাদের জন্য যেমন দাদা-দাদি বা নানা-নানির কিংবা অন্য আত্মীয়তার সম্পর্কের ভিতরে ভাল সামাজিক সাপোর্ট সিস্টেম আছে। ঠিক বিপরীতভাবে আবেগ প্রকাশের সংস্কৃতির কারণে সেটা অনেক সময় বাচ্চার আত্ম-পরিচয়কে অসন্মানিত করে। অতি আবেগ দেখাতে গিয়ে অনেকে প্রকাশ্যে বলে, ‘হায় হায় এতিম ছেলেটা। দেখিস কোনো কষ্ট না হয়। ’ ‘এতিম’ শব্দটাই ব্যবহারের কারণে একটা মানুষের অসহায়ত্ব কিংবা অনাহুত উপস্থিতি, অধিকারহীন অবস্থানকে বুঝিয়ে থাকে। এই ধরনের শব্দগুলোর একটা গভীর প্রভাব থাকে ব্যক্তির জীবনে এবং সেটা আজীবন।

(৩)
এই পরিস্থিতিতে সমাজ এবং রাষ্ট্রের অনেক কিছু করার আছে। সেই দায়িত্ব পালন না করে কিছু লোককে  দায়িত্বহীনভাবে অনেক কিছু করতে এবং বলতে দেখা যাচ্ছে। এমনকি কিছু কিছু সাংবাদিকদের কাছে মেঘের মানসিক স্বাস্থ্য কোনো ধর্তব্যের বিষয় নয়। তাদের প্রয়োজন শুধু গরম গরম তাজা খবরের। এগুলো ‍শুধু হলুদ সাংবাদিকতা নয় বরং গ্রিডি  জার্নালিজম (লোভী সাংবাদিকতা)। কেউ ধরিয়ে দিলেও দুঃখপ্রকাশ না করে বরং কাউকে কাউকে এর সমর্থনে কথা বলতে দেখেছি। বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন নিউজের বার্তা সম্পাদক মুন্নি সাহা বলেছেন, ‘বাংলাদেশের আবেগটা অন্য ধরনের। বাবা-মা এভাবে মারা যাবার পর তাদের সন্তানটি কেমন আছে তা জানতে চান অনেকেই। আর তা দেখানোর মাধ্যমে কোন নিয়ম ভঙ্গ হয়েছে বলে আমি মনে করি না। ’ শেম মুন্নি সাহা! সহকর্মীর মৃত্যুও আপনাদের মনে এতোটুকু মানবিকবোধ এনে দিতে পারেনি। এখনও খবরই মুখ্য, মেঘের জীবন নয়?

পাশাপাশি সাংবাদিকদের আরেকটি চক্র তদন্তের আগেই রুনির পরকীয়া নিয়ে মুখরোচক খবর ছেপে চলেছে। এর কারণ কি? কারণ বিশ্লেষণ করতে গেলে অনেকের রোষাণলে পড়ার ভয় আছে। একটু চোখ পিছনে নিয়ে সংবাদপত্রের পাতাগুলোতে মন বুলান। পুলিশ ঘটনার পরপরই বলা শুরু করে যে, অপরাধের মোটিভ হাতের মুঠোয় এবং অপরাধীরাও নাগালের মধ্যেই রয়েছে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে পুলিশ হত্যাকাণ্ডের ক্লুগুলো এমনভাবে বর্ণনা দিতে শুরু করে যে নিজেরা না বললেও ভাবনায় পরকীয় বিষয়টা মাথায় চলে আসে। এর ভিতরে একটা জিনিস উল্লেখযোগ্য। অনেকেই বলা শুরু করল, মৃতদেহ দেখে প্রাথমিক ধারণা হয় যে সাগরকে আগে খুন করা হয় এবং বিশ্লেষণটা ছিল রুনির সম্পর্ককে কেন্দ্র করে। সঙ্গে বলা হয়, রুনি পরিস্থিতির শিকার। সাক্ষী না রাখার জন্য রুনিকে হত্যা করা হয়। কিন্তু কিছুদিন পরেই মেডিকেল রিপোর্ট থেকে জানতে পারলাম যে, সাগর নয়, রুনিকেই প্রথমে হত্যা করা হয়। প্রথম দিকে পুলিশের রাখঢাক দেখে কেউ কেউ ভেবেছিল, হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে রুনির পরকীয়া জড়িত বলেই পুলিশ ধীরে ধীরে এগুচ্ছে। সাংবাদিক দম্পত্তি বিধায় বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়াতে এই উদ্যোগ। কিন্তু দিন যতো যেতে লাগল ততোই বুঝা গেল, অবৈধ সম্পর্কের বিষয়টি ছড়ানো পরিকল্পিত। বরং এসব গুজবের আড়ালে আরেকটি জজ মিয়া নাটক মঞ্চস্থ হতে চলেছে হয়তো।
 
ঠিক এর বিপরীতে বাংলানিউজের দুইটি দায়িত্বশীল খবর প্রশংসার দাবি রাখে। জাকিয়া আহমেদের ‘মেঘকে ওর মতোই থাকতে দিন’ যেটা মেঘের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য খুবই জরুরি এবং কয়েকদিন পরে একদল সাংবাদিকের মানবিক আবেদন সংবলিত লেখা ‘খুন হওয়া রুনি-সাগরকে আর খুন নয়’ সত্যিই সাড়া জাগানো এবং প্রাসঙ্গিক। এর মাধ্যমে নিহত দম্পত্তির চরিত্র হনন না করার অনুরোধ করা হয়েছে। সাংবাদিক দম্পত্তি হত্যার পরে অন্যান্য বিষয়ের মতো আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে যা হোল সাংবাদিকতা এবং এথিকস। কিন্তু এটা কিভাবে নিশ্চিত করা যায়? আইন করে করতে গেলে দেখা যাবে আমাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থায়, ভাল আইনটা হয়ে দাঁড়াবে সাংবাদিক এবং মুক্তচিন্তা দমনের হাতিয়ার। কিছু সাংবাদিকের গ্রিডি জার্নালিজমের কারণে সাংবাদিকতা এবং এথিকস, এই বিষয়ের উপরে ভাবনার সময় চলে এসেছে।

(৪)
আমাদের দেশে যে কোনো বিষয় নিয়ে রাজনীতি করার সংস্কৃতি নতুন নয়। প্রতিটা দল যার যার অবস্থান থেকে সেটা করে যাচ্ছে। সাংবাদিক হত্যাকাণ্ড নিয়েও সেটা লক্ষ্য করা গিয়েছে গোড়া থেকেই। মামলার ঘটনা পুলিশ কর্তৃক বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে টুইস্ট করার ঘটনা কি রাজনীতির অংশ নয়? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আসামিদের ধরতে হবে। ঘোষণাটি সবার দৃষ্টি কেড়েছিল। কিন্তু পরে বুঝা গেল, ওটাও ছিল আমাদের চিরাচরিত রাজনৈতিক মিথ্যাচার। আবেগকে পুঁজি করে জনপ্রিয়তা আদায়ের চেষ্টা। পরে মন্ত্রী আরেকটি অনুষ্ঠানে স্বীকার করেছেন, মিডিয়ার চাপে নাকি তিনি বলতে বাধ্য হয়েছিলেন। ধন্যবাদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। আপনি সরাসরি না বললেও বুঝিয়ে দিয়েছেন, প্রয়োজনে আপনি মিথ্যা কথা বলেন। পরবর্তীতে সত্য না জানা পর্যন্ত আপনার সব কথাই মিথ্যে হয়ে থাকবে আমাদের কাছে। রাখাল ছেলের বাঘ আসার গল্প শুনেছেন তো? শুনলেও ভুলে গেছেন!

অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী সদ্য বাবা-মাকে খুন হতে দেখা মেঘের জীবনের দায়িত্ব নিয়েছেন ব্যক্তিগতভাবে। কিন্তু কেন? এটাতো কোনো রাষ্ট্র নায়কের আচরণ নয়। দেশে কি শুধুই মেঘ এভাবে বাবা-মা হারাচ্ছে? কয়জন মেঘের দায়িত্ব নিতে পারবেন তিনি, কিংবা নিচ্ছেন? কেনই বা সেটা নিতে হবে?
 
রাষ্ট্রযন্ত্র যখন বিভিন্নভাবে তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হচ্ছে তখন মানুষের ক্ষোভ এভাবে প্রশমনের চেষ্টা করা রাজনৈতিক দেওলিয়াপনা ছাড়া কিছুই নয়। অতীতেও অনেক শাসক এভাবে ব্যক্তিগত দায়িত্ব নিয়েছেন। কিন্তু তার অবস্থা কি এখন? কোন অনুসন্ধানী সাংবাদিক ভাই কি একটু জানার চেষ্টা করে দেশবাসীকে জানাবেন? অভিভাবকহীন শিশুদের জন্য রাষ্ট্রের কি দায়িত্ব নেই? টেকসই, সবার জন্য প্রযোজ্য, এ রকম পথে না গিয়ে আমাদের প্রধানমন্ত্রী সহজ দায়িত্বের পথটি বেছে নিলেন। যেটা পালন না করলেও জবাবদিহিতা নেই। বাবা-মাকে হারানো শিশুরা কেন অন্যের দান নিয়ে নিজেকে ছোট করে বেড়ে উঠবে? বরং তাদের দেখভালের দায়িত্ব আইন করে রাষ্ট্র নিলে সেই সহযোগিতা নেওয়া হবে শিশুর অধিকার। যেটা গ্রহণে কোনো গ্লানি নেই। আমাদের নেতারা কেনইবা করবেন? এগুলোতে রাজনৈতিক ফায়দা কোথায়?

অতীতেও মানুষের এই আবেগ নিয়ে নির্লজ্জ খেলা হয়েছে। আবেগের তাড়না এত যে, তাতে তাড়িত হয়ে মূল বিষয় হারিয়ে যায় বারবার। ব্যক্তির অপরাধ ঢেকে গিয়ে সেখানে ব্যক্তিই হয়ে যায় প্রধান নিশানা। সেই নিশানায় ‍উপযু্ক্ত শাস্তি পাওয়ার আগে অপরাধী নিজেই আরেকটা অপরাধের শিকার হয়ে পড়ে। সে রকমটি হতে দেখেছি সাঈফের বেলায়। আজকে কোনো উপযুক্ত তথ্য প্রমাণ ছাড়া কে বা কারা বাতাসে গুঞ্জন ছড়িয়ে দিয়েছে রুনির পরকীয়ার কথা। আমাদের সবাইকে এই ধরনের আবেগী উৎসব এবং রাজনৈতিক নির্লজ্জ খেলা থেকে বেরিয়ে এসে আরো বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে।

ক্লাসের ফাঁকে বিরতীতে সামনের বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসটা একদম পাহাড়ের চূড়ায়। যেখানটাতে দাঁড়িয়েছিলাম, সেখান থেকে গ্লেনেল্গ (Glenelg) বিচ পুরোপুরি দেখা যায়, যদিও অনেক দূর। দূরে সাগর। আকাশে মেঘও ছিল। মেঘের কালো রঙটি আর নেই। সাদা সাদা তুলোর মতো। মেঘ সাগরের কোলে মাথা ঘেঁসে নিশ্চিন্তে দৌড়ে বেড়াচ্ছে। আমাদের মেঘ, জানি, কখনো বাবা সাগর কিংবা মা রুনির চারপাশ ঘিরে এমন হুটোপুটি করতে পারবে না। কিন্তু অন্ততঃ আমাদের সবার দায়িত্বশীল আচরণ কিছুটা হলেও তো ওর জীবনের কালো দাগটা কাটিয়ে নিতে সাহায্য করবে। এখনো দেখছি সাগরের উপরে কালো মেঘটা আর নেই। বকের মতো কিংবা কাশফুলের মতো শুভ্র এক গু্চ্ছ মেঘ ঝলমল করছে আকাশের বুকে। কেমন যেন স্বপ্নিল! মেঘের জীবন আরো বেশি স্বপ্নময় হয়ে উঠুক প্রত্যাশা করি। খুনিরা ধরা পড়ুক, উপযুক্ত সাজা পাক। সাগর-রুনির আত্মাও ওপার থেকে সেটা দেখে শান্তি পাক।

মেঘের থেকে মেঘ কেটে যাক

জীবনে তার সূর্য হাসুক।

[email protected]

বাংলাদেশ সময় ১০৩৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।