ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

মান্যবর প্রধানমন্ত্রীর গদির আত্মকাহিনী

আশা নাজনীন, সাংবাদিক/গবেষক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫১০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০১২
মান্যবর প্রধানমন্ত্রীর গদির আত্মকাহিনী

আমি গদি। মখমল, ফোম, কাঠ, পিতল এবং সোনালি রঙের প্রলেপে মুড়ে আছি আমি।

নিজেকে উজার করে দেশের প্রধানমন্ত্রীকে আমার চারকোনা বিশিষ্ট হৃদপিন্ডে বসতে দেই। প্রধানমন্ত্রী বসলেই আমি সার্থক। সার্থক আমার অস্তিত্ব।

১৯৭১’এর ১৬ ডিসেম্বর আমার জন্ম হলেও মূলত শেখ সাহেব (জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান) যেদিন এইখানটায় আমার হৃদপিন্ডের ওপরে বসেন, মূলত সেদিনই আমার আত্মা প্রাণ পায়। সেই প্রাণ হামাগুড়ি দিয়ে হিমাগারে চলে যায় ৭৫ এর ১৫ আগস্ট। নির্বাক আমি বোধহীন হয়ে পড়ি। বহুদিন কোমায় থাকার পর ৯১ সালে আমি ফিরে পাই সম্মান। নির্বাচিত হয়ে এলেন খালেদা জিয়া। শান্তি-ভালোবাসা খালেদার জন্য উজার করে দিয়েছিলাম, আমার ওপরে বসে তিনি ব্যথা পেয়েছেন-এমন দাবি কোনোদিনও করতে পারবেন না। দেশের মানুষ তাকে এইখানে পাঠিয়েছে-সেটাই ছিলো আমার তৃপ্তি।

১৯৯৬ সালে এলেন শেখের বেটি, হাসিনা। হ, অর জন্যই তো এতোদিনের অপেক্ষা আমার, সেই ৯১ সালেই যার আওনের কথা ছিলো। ভোটের আগের দিন উল্টাপাল্টা কি বইলা নাকি পাবলিক খ্যাপায়া দিছিলো। তাইতো, পাবলিকরে খ্যাপাইলে তো পাবলিক খ্যাপবোই, খিক খিক কইরা তো আর হাসবো না। শেখের বেটি বহু ভালো কাজ করলো, কিন্তু প্রকাশ্যে দলের গুন্ডা-পান্ডাগো পক্ষ নিয়া আবার পাবলিকের লগে বিবাদে জড়ায়া পড়লো। ফলাফল ২০০১ সালের নির্বাচনে আমার ঠিক সামনে আইসা হাজির হইলো জামায়াতে ইসলামী, যারা বাংলা মায়ের ইজ্জত লুন্ঠন করছিলো। ঘৃণায়, রাগে দু:খে আমার গদি ফাইট্যা যাচ্ছিলো, নিজামী আর মুজাহিদ আমার গদিতে প্রায় প্রতি রাতেই সবার অনুপস্থিতিতে জিহ্বা দিয়া চাটা মারতো। আমার হৃদপিণ্ড ফুটা কইরা পার্সেন্টেজ নিতো কথিত যুবরাজ। আমি চিৎকার কইরা কানছি, কানতে কানতে আমার চারপায়ের একটা পা তো প্রায় ভাইঙ্গাই গেছিলো। আমি হেলে পড়তে থাকি। অরা চাটা মাইরা আমার গদিটারে অরা এমন ময়লা বানায়া দিছিলো যে, ওইখানে কোনো নিরস্ত্র মানুষের বসবার সুযোগ ছিলো না। মঈন উ আহমেদ অস্ত্রশস্ত্র লয়া কারফিউ জারি কইরা আমার গদিটারে পরিষ্কার করাইছে ফখরুদ্দীনরে সঙ্গে লয়া। কিছুদিন ভালো কাটলেও ভেতরে ভেতরে আমি অস্থির  হয়ে উঠি, পাবলিকও অস্থির হয়ে পড়ে। গদির সামনে যদি মিলিটারি পোশাকে কেউ দাঁড়ায়া থাকে, তখন মনে হয় আবার বুঝি পাকিস্তানিরা এলো!

২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে যখন হাসিনা আমার গদিতে ফিরা আইলো, আমি সর্বশক্তিমানের দরবারে শুকরিয়া জানাইছিলাম-আমার গদি চাটা দিয়া যারা ময়লা করছিলো, ওদের বিচার এবার বাংলার মাটিতেই হবে, শেখ সাহেবের খুনের বিচার হবে।

কিন্তু এ আমি কি দেখছি? শেখের বেটি তো আমার গদিতে বইস্যা চান্দি গরম কইরা ফেলছে। লক্ষীপুরের খুনি যদি মাফ পায় তাইলে শেখ সাহেবের খুনীদের বিচার ও কোন মুখে করতাছে? নিজের বাসভবনেই শেখের বুক খুনিরা ঝাঁঝরা করে দিছিলো যা পাগলের মতো হাসিনা প্রত্যেকদিন একবার কইরা আমারে স্মরণ কইরা দিতো। আমি মাইন্ড করি নাই, স্বজন হারানোর বেদনা আমি পুরা না হইলেও কিছু কিছু বুঝি। হায় হায়, হাসিনা দেখি এখন কয়-বেডরুমের নিরাপত্তা সরকার দিতে পারবো না। তাইলে অয় আমার গদিতে বইসা আছে কেন?

আমার হৃদপিণ্ডে বোধহয় বড় ধরনের অসুখ হয়েছে। এতো ব্যথা আগে কখনো হয়নি। কারণ বহু দুর্দিনেও আমি সুদিনের স্বপ্ন দেখেছি। কিন্তু এবার যে আর কোনো স্বপ্ন বাকি নেই। পাবলিকের সঙ্গে বিবাদে জড়াইয়া পড়া হাসিনারে কোন দুখে পাবলিক আবার আমার উপরে বসাইবো? বেডরুম তো বাদই দিলাম, প্রতিদিন রাস্তার উপরে মুরগীর মতো মানুষ জবাই করতাছে বাস-ট্রাকের চালকেরা, একের পর এক ধামাচাপা। শেষমেষ তো হাসিনার সব অর্জনকেই ধামাচাপা দিয়ে দিচ্ছে।

আমি হাসিনারে ভালোবাসতাম। ভাবতাম, নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালা। কিন্তু সাংবাদিক দম্পতির করুণ এবং নৃশংস মৃত্যু আমার সেই বিশ্বাসকে কবর দিয়েছে।

আশা নাজনীন: জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক গবেষক ও সাংবাদিক, লন্ডন

বাংলাদেশ সময় ২২৪৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।