ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

মুক্তমত

এমন মহীরুহ যুগে যুগে জন্মায় না

আবেদ খান, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১২৯ ঘণ্টা, মে ১৯, ২০২২
এমন মহীরুহ যুগে যুগে জন্মায় না

আবদুল গাফফার চৌধুরীর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর। কী ব্যক্তিগত, কী পারিবারিক।

গত শতকের ৫০-এর দশক থেকে সেই সম্পর্ক। আমার বয়স তখন কম। আমার সৌভাগ্য আমার শৈশব থেকে আবদুল গাফফার চৌধুরীর মতো বড় মাপের মানুষটির সান্নিধ্য পেয়েছি। তার স্নেহ পেয়েছি, উপদেশ, পরামর্শ, দিক নির্দেশনা পেয়েছি আমি এবং আমার পরিবারের সদস্যরাও।  

এত বড় মাপের একটি মানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা মনে এলে ভাবি, তিনি তো গোটা দেশের মানুষের কাছেই ঘনিষ্ঠতর। হবেন না-ই বা কেন, পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে যখন এই দেশের মানুষের মন-মানসিকতা অসাম্প্রদায়িকতায় পরিপূর্ণ, সেই মানুষের মনোচাহিদাকে পূরণ করার জন্য কৈশোর থেকেই তিনি জড়িয়ে যান বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে। বাহান্নর ভাষা আন্দোলনে তাঁর অমর কবিতার জন্যে তিনি আজ ইতিহাসের অংশ। কিন্তু তিনি কি শুধু ভাষাসংগ্রামীই ছিলেন? তাঁর সৃষ্টির মাত্রা ছিলো বহুমাত্রিক। কবিতায় তিনি কালজয়ী হয়েছেন, তাঁর কথাশিল্পে পারদর্শীতার কথা কি বাদ দেওয়ার সুযোগ আছে? তাঁর অনেক গুণই আজও অনাবিষ্কৃতই রয়ে গেছে। তিনি ছিলেন সাহসী, বন্ধুবৎসল, স্নেহপ্রবণ ও আপসহীন একজন মানুষ। তিনি বন্ধুত্বটাকে সর্বদা সবার সামনেই স্বীকার করেছেন। যারা নীতিগতভাবে তাঁর বিরোধী, রাজনৈতিকভাবে তাঁর প্রতিপক্ষ, তাদের সঙ্গেও তাঁর সর্বদা আন্তরিক যোগাযোগ ও সম্পর্ক বজায় ছিল। ব্যক্তিগত সম্পর্ককে তিনি ব্যক্তিগত জায়গায়ই রেখেছেন এবং রাজনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তিনি কোনরকম আপস করেননি। এটি ছিল তাঁর চরিত্রের একটি বড় বৈশিষ্ট্য। সবচেয়ে বড় কথা তিনি নিজের চিন্তা-চেতনা ও বিবেককে স্বার্থের কারণে কখনও বিক্রি করে দেননি। সারাজীবন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের সংগ্রামে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন এবং উজাড় করে দিয়েছেন পুরোটাই।  

তিনি যখন ‘আওয়াজ’ বের করেন, তখন ছয় দফার কাল। ছয় দফাকে মানুষের কাছে নেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর যে ভূমিকা- সে কথা কি ভুলে থাকা সম্ভব? বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠতা লাভের অন্যতম ক্ষেত্র ছিলো তাঁর সেসব আপসহীন চিন্তা-দর্শন ও জীবন। পাকিস্তানের গোড়ার দিক থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ কিংবা পরবর্তীকালে আমাদের দেশের অসাম্প্রদায়িক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় তিনি ছিলেন সর্বদা সোচ্চার।  

একজন লেখক, একজন সাংবাদিক এবং একজন অসাম্প্রদায়িক মানুষ হিসেবে তাঁর বড় একটি শক্তির দিক ছিলো-তা হলো তাঁর অসাধারণ স্মৃতিশক্তি। প্রতিটি ঘটনাকে তিনি তাঁর অতীতের অভিজ্ঞতার সংমিশ্রণে দারুণভাবে সাজিয়ে তুলতেন; যা পাঠককে দ্রুত কাছে টানার মাধ্যম হিসেবে কাজ করতো। তাঁর চিন্তা-ভাবনাগুলো ছিলো স্বচ্ছ। তিনি যা ভাবতেন, বিশ্বাস করতেন তা-ই তিনি অকপটে বলতেন। পরিণতিতে তাঁর কি সমস্যা হতে পারে তিনি মোটেও ভাবতেন না। এর জন্য তাঁকে ভোগান্তিও পোহাতে হয়েছে।  

বাংলাদেশের দ্ইু সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান ও জেনারেল এরশাদের আমলে তাঁর দেশে আসার পথে অলিখিত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিলো। তিনি কিন্তু থোরাই তোয়াক্কা করেছেন সেসব।  

স্নেহের দাবি নিয়ে অনেক সময় তাঁর কাছে পরামর্শ চাইতাম। কি লন্ডনে, কি দেশে; যেখানেই তিনি থাকতেন আমাকে পরামর্শ দিতেন। আমি তাঁর তুলনায় নগণ্য হওয়ার পরও অনন্যটাই পেয়েছি তাঁর কাছ থেকে। এমন মহীরুহ একটি দেশে যুগে যুগে জন্মায় না। আজকে মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী শোকবার্তায় সেরকমই মন্তব্য করেছেন। আবদুল গাফফার চৌধুরী আমাদের মধ্যে নেই; কিন্ত তাঁর সৃষ্টি থাকবে যতদিন বাংলাদেশ থাকবে।  

লেখক-সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক জাগরণ।  

বাংলাদেশ সময়: ২১০০ ঘণ্টা, মে ১৯, ২০২২
নিউজ ডেস্ক

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।