ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

কবিতা

প্রিয় পাঁচ কবিতা ও কবিতার গল্প | মুক্তি মণ্ডল

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫৩৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০১৬
প্রিয় পাঁচ কবিতা ও কবিতার গল্প | মুক্তি মণ্ডল বাংলানিউজ

বাংলানিউজের শিল্প-সাহিত্য বিভাগের বিশেষ আয়োজন ‘প্রিয় পাঁচ কবিতা ও কবিতার গল্প’র এবারের পর্বে থাকছে, কবি মুক্তি মণ্ডলের নিজের লেখা প্রিয় পাঁচ কবিতা ও সেগুলো লেখার পেছনের গল্প। 

কবি মুক্তি মণ্ডলের জন্ম ১৯৭৬, চুয়াডাঙ্গা। তার প্রকাশিত বই- ঘড়ির কাঁটায় ম্যাটিনি শো (কৌরব, ২০০৮), পুষ্পপটে ব্রাত্যমিনতি (জোনাকরোড, ২০০৯), উন্মাদ খুলির পৃষ্ঠাগুলি (আবহমান, ২০১১) এবং ভেল্কিবাজের আনন্দধাম (এন্টিভাইরাস পাবলিকেশন, ২০১৫)।

তিনি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞায় কর্মরত।  

বাংলানিউজের শিল্প-সাহিত্য বিভাগের বিশেষ আয়োজন ‘প্রিয় পাঁচ কবিতা ও কবিতার গল্প’র এবারের পর্বে থাকছে, কবি মুক্তি মণ্ডলের নিজের লেখা প্রিয় পাঁচ কবিতা ও সেগুলো লেখার পেছনের গল্প।  


প্রিয় পাঁচ কবিতা 

ভেল্কিবাজের আনন্দধাম
                                                    ক্ষুদ্র মানুষের দাপটে দিশেহারা আধ-পাগলা সাঁই
                                                   ভদ্র লোকেদের কামড়ে কামরাঙা স্বাদে তুলছে হাই!

অতি সূক্ষ্ণ, বর্ণচোরা, নিঝুম রাতের তরঙ্গের সাথে ভেসে আছে যেই কমলাস্নানের দৃশ্য, সেতো আমারই গভীর উপলব্ধির আয়ু - কালো মুকুটের পাশে পড়ে থাকা চূর্ণ বালুকণা। বৃষ্টির গন্ধ দুয়ার খুলে তুমিই তো পালিয়েছিলে, আমাকে দর্পণে আপেলের পাশে বসিয়ে রেখে, মায়া তিরের মুখশ্রীতে ফিরে এসো নগ্নবেশে - দুই হাতের আঙুল, এসো ঘষে ঘষে ধুয়ে ফেলি ধুলো ও প্রেতলোকের সিঁড়ি...

একাকীত্বের দিনগুলি কটা পুষ্পখোল, এর ভেতর হারিয়ে যেতে থাকে কাছের মানুষ, নভোদৃশ্যের ঢেউ, কারও কারও দরোজায় ফুল শুকায়, একটু টোকা দিলেই ঝরে পড়ে বাদামি প্রহর, সুহাসিনীর নদীবন্দর ছেড়ে গেলে কেউ কেউ গুম হয়ে যায়। বিদূষী করুণাময়ীর চোখের পাতায় নেচে যায় কাঠঠোকরাদের গ্রাম; নিঝুম উলুবনের হাওয়া এসে জড়িয়ে ধরে, বদহাওয়া শরীরে লেপে দেয় উষ্ণ খোড়লের মায়া, দেহাসনে উড়ে আসে বাসনার ছাই, রাত্রিমূর্তি চিরে একা একা বসে বসে তাই দেখে মনকানাই! অঙ্গমালায়ও হেসে ওঠে ইতরপনা, মনের অতলে রঙ্গমেলায় ফুঁসে কি তারই ভূজঙ্গনা? কাঁপছে মধুভা-, কাঁপছে মাটির নিমাই।

বিমূর্ত পূজারীর দিকে ছুঁড়ে দেওয়া তরুবালার হাসি কুড়াতে কুড়াতে ঘরে ফিরতেও ভোর হয়, কটাক্ষ করে কামভাষাবিদ, যেন কূটাভাস, যেন শশীকর বিলে কাত হয়ে থাকা মাথা, স্বীকার করি আমি ঠগবাজ, প্রাণহরণ বিরোধী, চরিত্রাকাশে সারাক্ষণ ওড়ে ভোমর ও চিল, ভাল লাগে সাদা কাগজ, ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন, ভোলানাথের ময়লা ধুতির গিট। পড়ে থাকে সন্দেহভরা চোখ, কুঁচকানো ভ্রু। ও কি হিপোক্রাট!

সকল প্রশংসা দেহভাণ্ডর তলে রোশনি ছড়ায়, অল্পকাল তাঁর প্রতিবিম্বে নেচে নেচে চলে যেতে চাই, ভানু প্রণীত স্বল্পায়ুর নদে যে মেঘমালা স্মিত হাসে, তাতে সর্বদা ক্ষণিকা তাঁর নিরীহ চক্ষু ভাসায়। নিন্দা নাই, স্নিগ্ধ তাঁর নাভিতলে দেখি ষাড়ের লড়াই।  

পথভোলা
সবুজ নেশার পথভোলা আলো সিংহ
মেঘের ধ্বনিতে ঘরছাড়া 
মহুয়ার উন্মুক্ত জগতে, খড়ের গাদায়, একা।  

চারিদিকে খোলা, যেইদিকে নদী পথ সেইদিকে 
মুখ করে গাঢ় এক আকাক্সক্ষায় 
মানুষ দেখবে বলে ঠাঁয় বসে থাকে।  

মানুষেরা আসে না, ঘাট ছেড়ে উঠে আসে ডাঙায় 
একে একে হরেকরকম ভালুকেরা
তাদের মুখে মানুষের গন্ধ, মাংশের কণা।

এইসব দেখে আর দূরতম দিগন্তে অসম্ভব মেঘের 
পিঠে উড়ে যায়, আর নাঙ্গাভুখা
আকাক্সক্ষার সর্বস্ব খুলে রক্তবর্ণ তৃষ্ণার
সিংহিনীর খোঁজ করে।  

সিংহিনীরা লুকিয়ে আছে মানুষের গায়ের গন্ধে, মাংশের
কণায়, পথভোলা তাই বসে থাকে, 
যেইদিকে দৃষ্টির বক্ষ খোলা দুয়ার 
সেইদিকে মুখ করে।

তোমার মুখের স্বদেশী পক্ষীকুল আর মেঘের ডাকে
আমাদের প্রচলিত বিধি-নিষেধের তীর ছেড়ে
ঝোপের গভীর মুখশ্রীতে পথভোলা ঘুমিয়ে রয়েছে।  

নাচের স্কুল
ওইখানে নদীর শুকানো দাগ, কালোসংহার, মায়াসূচি খুলে একটা গাছের নিচে সবুজ সংরাগ 
জড়িয়ে আছে, যার ভেতর তুঁতশিল্পের পোকাদের বেদনাসমূহ নীলজরি
তারা শিরার ভেতর কাল রাতে অনেক পাখি উড়িয়েছিল, 
তাদের চোখের মৌচাকে মেঘলা আকাশ।
নেচে নেচে আজ আমার শরীর খুঁড়ছে, পাখি বিক্রেতার মুখে মিলিয়ে যাচ্ছে ঝুমঝুম বৃষ্টির শব্দ, 
তারে জাগিও না।

হাতের মধ্যে দেখো বাঁশিওয়ালার ধড়, কালী মন্দিরের পাশে ঘুমানো পাগল দেখো মিটিমিটি 
আকাশের তারা, তাকে জাগাও, তার
চুলের বাগানে খুন হয়ে যাওয়া শেফালী ফুলের মালায় আজ রোদ উঠেছে।  

নদীহীন মুখের মানুষেরাও দেখো যেচে যেচে নাচের স্কুলে এসেছে, ওদেরকে তুমি নাচ শেখাও, 
আমি এখন ঘুমাতে যাবো বংশীবাদকের চোখে,
আমাকে কেউ ডেকো না।

আমি ঘুমাবো
বাজো পাতার টুকরো শব্দ
ভেঙে যাওয়া কালো সোহাগ শাদা সোহাগ সাঁইজির চরণেতে বাজো
বাসনার তারে বেজে ওঠো ঘুমহীন জানালার ধ্বনি

কলুদের তৈল কারখানার কাছে এসে একটু ডাকো আমাকে
ফিসফিস, আমি তোমার কাছে যাবো
সমুদ্র ঢেউয়ে ডুবে যাওয়া রোদের সাথে চোখের পৃষ্ঠাগুলো তলিয়ে দেবো

কালো শাদা ডোরা কাটা লেনে আলো কেটে কেটে 
তোমাকে খণ্ড খণ্ড দেখবো
খণ্ডাংশের ভিতর আলোক সাঁইজির চরণ দেখবো
দেখবো লোহার পুলে মানবিক চোখ

ঢেলে দিও আজকে সবটুকু অন্তর, কালকে থাকবে না এই আঁচ
আমার ঘাড়ের কাছে 
পুরনো ঘ্রাণের মুখগুলো ভেসে উঠছে

আজ তুমি দেখো টেবিলের উপর আলো কার স্পর্শ চাচ্ছে
ফুরিয়ে যাওয়া শলাকার দিকে এগিয়ে এসে
হৃদপিণ্ডটা খুলে রাখো লালনের পাশে, আমি ঘুমাবো

টোটেম প্রফেসর তোমার ঘড়ির কাঁটায়
অংশগ্রহণমূলক রৌদ্দুর বিতরণে 
টোটেম প্রফেসর তোমার ঘড়ির কাঁটায় ম্যাটিনি শো

আমার চুম্বন দৃশ্য রুদ্ধশ্বাস গোলাপি ট্রেনের
খোলা জানলায় লুম্পেন শহর
লাজুক বিষন্ন মানুষেরা বোতাম ছেঁড়া জলপাই রঙের 
জামার কলার দিয়ে
চোখ মুছতেছে

তুমি মৃত দেহ কাঁধে নিয়ে কত দূরে যাবে?
সৌন্দর্যের পর্যটনে গভীর মমতা
রিলিফ মুডে দেখো হাতাগুটিয়ে বসে আছে

আমি শহরের ভিউ পয়েন্টে
নতজানু রিকসার স্পোকের সঙ্গে ঘুরতেছি
নির্দলীয় সরকারের 
দূপুরের নির্জন খোঁপায় বেদনারা লুকালে আমার
মগজের মধ্যে ভাইরাস অপ্রতিভ হয়ে ওঠে

আমি তাকে ফিল করি
রিসাইকেল বিনে রাখা সমস্ত রোদ্দুর একটিভ করে দেখি
ট্রাক ড্রাইভারের শক্ত বাহুতে সূর্য লটকে যাচ্ছে
টোটেম প্রফেসর তোমার ঘড়ির কাঁটায় গার্মেন্টসকর্মীদের

টোল পড়া গালের রূপকথারা
শস্য সুনামের গন্ধ ছড়াচ্ছে ... গন্ধ ছড়াচ্ছে...


কবিতার পেছনের গল্প
এই লেখাগুলো আমার প্রিয়, তবে এর বাইরেও আমার আরও অনেক প্রিয় লেখা রয়েছে। প্রিয় এই লেখাগুলা লেখার পিছনে সত্যিকার কোনো গল্প নেই, রয়েছে সমকালের রাষ্ট্র নির্মিত রাজনীতি ও মানুষের জীবনযাপন এর পর্যালোচনা। আমার প্রথম গ্রন্থ ঘড়ির কাঁটায় ম্যাটিনি শো বের হয় ২০০৮ সালে, এ গ্রন্থের লেখাগুলো কয়েক বছরের লেখার একটা সংকলন বলা যায়। যেসময়ে এই লেখাগুলা লেখা সে সময়কার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে সুশীল-কুশীলদের আচরণ ব্যক্তিগতভাবে আমি মেনে নিতে পারিনি, আমি মনে করি সভ্য কোনো সমাজে, কোন রাষ্ট্রে এই ধরনের ব্যবস্থা থাকতে পারে না। এটা গণতন্ত্র নয় (যদিও আমি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী নই), গুটিকতেক সুশীল ননীখোরকে ধরে নিয়ে এই ব্যবস্থা গঠন করাকে আমি মনে করি সাধারণ মানুষের সাথে চরম অসভ্যতা করা হয়েছে। এটা বিরাজনীতিকরণের একটা চক্রান্ত ছাড়া অন্য কিছু নয়। টোটেম প্রফেসর নামক লেখাটা এইসব বিষয়াশয়কে বহুকৌণিকভাবে দেখতে চেয়ে নির্মাণ করা। আমার চারটা বইয়ে যেসব লেখা আমি সংযুক্ত করেছি তা বেশিরভাগই রাজনীতি, রাষ্ট্র, সমাজ, ধর্ম ও মানুষের আচরণের পর্যালোচনা এবং ব্যক্তির বিকাশের চরম একটা পর্যায়ে একজন সভ্যমানুষের আদল ও তার জীবনজগৎ কিরকম হতে পারে তারই একটা বাঞ্ছারূপ।  

মানুষ তো একা, প্রাণের সমস্বরে রসে গন্ধে মানুষ অন্য প্রাণিসম্পদের মতোই, সভ্য হয়ে উঠতে হলে তাকে অনেক কিছু পরিত্যাগ করতে হয়, অনেক নিকুঞ্জছায়া ধারণ করতে হয় অন্তরমহলে, সেই অন্তরমহলকে চিন্তায় পরিচর্যা ও চর্চার প্রয়াস থেকেই পুষ্পপট ও পরবর্তী দু’টি গ্রন্থের লেখাগুলা লেখা, এখানে সমসাময়িক যারা লিখছেন এবং আর লিখছেন না তাদেরকে, তাদের লেখাজোখাকে পর্যালোচনা ও ব্যঙ্গ করার মাধ্যমে নিজের সুরতহালও বহুরৈখিক ভঙিমার দেওয়ালে সেঁটে দেওয়ার পায়তারা আছে।  

লেখা আহ্বান

বাংলাদেশ সময়: ১১২৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০১৬
এসএনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

কবিতা এর সর্বশেষ