ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

কবিতা

ফিলিস্তিনের জন্য দু’টি কবিতা | আদনান সৈয়দ

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬১৯ ঘণ্টা, জুলাই ৫, ২০১৭
ফিলিস্তিনের জন্য দু’টি কবিতা | আদনান সৈয়দ ফিলিস্তিনের জন্য দু’টি কবিতা

(২০১৪ সালে ইসরাইলের আক্রমণে ফিলিস্তিনের চার বছরের ফুটফুটে মেয়ে জোবায়দার মৃত্যু হয়। তার বাবা কাশেম এখনও বেঁচে রয়েছেন। বর্তমানে তিনি হামাসে যোগ দিয়েছেন।) 

আমার প্রজাপতি মেয়েটা

(২০১৪ সালে ইসরাইলের আক্রমণে ফিলিস্তিনের চার বছরের ফুটফুটে মেয়ে জোবায়দার মৃত্যু হয়। তার বাবা কাশেম এখনও বেঁচে রয়েছেন।

বর্তমানে তিনি হামাসে যোগ দিয়েছেন। ) 

মেয়েটা আমার প্রজাপতি ভালোবাসে।
এখন ফিলিস্তিনে বসন্তকাল।
গাছে গাছে কত রঙের ফুল ফুটে আছে।
ঘরে বাইরে যেন বসন্ত উৎসব।
ঠিক এই সময় জোবাইদা ঘরে থাকে না।
আমি কখন ঘরে ফিরবে সেই আশায়
সে পথের দিকে তাকিয়ে থাকে।
কারণ আমি ঘরে ফিরলেই সে পার্কে যাবে।
ছোট্ট ফুটফুটে একটা মেয়ে। মাত্র চার বছর বয়স।
বাপ-পাগল বলতে পারেন। তার মা-ও তাই বলে।
আমি কাজ করি একটা বিস্কিট ফ্যাক্টরিতে।
সেখানে আমি সুপারভাইজার। প্রতিদিন ঘরে 
ফেরার পথে মেয়ের জন্যে এক প্যাকেট বিস্কুট নিয়ে আসি।
যদি কোনোদিন হাত খালি থাকে তাহলে
মুখটি গোমড়া করে বলবে- 
“বাবা, তুমি আমার জন্যে কী এনেছ?”
আমি জানি সে কথা। তাই অন্য কিছু ভুলে গেলেও
আমার জোবাইদার জন্যে কিছু না কিছু একটা আনবোই।
পকেটের পুটলিতে ভাঁজ করে রাখা কোনো একটা কিছু।
কিন্তু জানেন-তো আমাদের রক্তে রয়েছে প্যালেস্টাইনাইনের বীজ।
সবসময় উৎকন্ঠা আর ভয়ে থাকি।
কখন কী জানি হয়! কতো ভয় তখন মনে বাসা বাঁধে।
মেয়েটাকে নিয়েই এখন আমার সবচেয়ে বড় ভয়।
যদি কিছু হয়? মেয়েটা বেড়ে উঠুক এই দুনিয়ায়।
তারপরও কোনো এক অজানা ভয়। ‘যদি কিছু হয়ে যায়?’
আমি-তো আমার জীবন নিয়ে ভাবি না
আমার স্ত্রীর জীবন নিয়ে ভাবি না।
কারণ আমরা অনেকটাই জীবন-মৃত।
কিন্তু আমি চাই আমার সন্তান বেঁচে থাক
আমাদের বাড়ির পাশে হলুদ পাতাবাহারের মতোই।
সে বড় হোক। তারপর ছড়িয়ে পড়ুক ফিলিস্তিনের প্রান্তরে প্রান্তরে
আর ছড়িয়ে পড়ুক তার সুমিষ্ট সুবাস।
বাপ হিসেবে এই আমার সামান্য চাওয়া।
আজ বৃহস্পতিবার। ফ্যাক্টরি থেকে একটু আগেই বের হয়ে গেলাম।
মেয়েটাকে কথা দিয়েছি। আজ আমরা প্রজাপতি দেখতে বের হবো।
ঘরের খুব কাছে আসতেই দূর থেকে একটা জটলা লক্ষ্য করলাম।
বুকের ভেতরটা কেমন জানি ছ্যাৎ করে উঠল।
তাহলে কী! না, আমি আরও জোরে সাইকেলে প্যাডেল দিলাম।
না, আমি খুব বেশিদূর এগুতো পারলাম না।
একজন আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে বললো
‘কাশেম, তোমার সব শেষ হয়ে গেলো?’
সবশেষ? আমি বিড়বিড় করলাম। বুকে একটা ব্যথা টের পেলাম।
‘তোমার জোবায়দা আর নেই, কাশেম’। কে জানি বললো কথাটা।
আমি তারপর আর কিছু বলতে পারবো না।
চোখের সামনে সব কিছু অন্ধকার হয়ে গেলো।
মনে হলো, আমি যেন কোনো এক পেতপুরীতে আবদ্ধ হয়ে আছি।
যখন জ্ঞান ফিরে পেলাম তখন দেখি মেয়েটার কোমল শরীর
আমার ঠিক সামনেই নিথর হয়ে পড়ে আছে। তাকে ঘিরে কত মানুষ!
আহা! ওর চোখটা তখন কত শান্ত ছিল! মনে হলো সে যেন ঘুমিয়ে আছে।
এক অনাবিল শান্তিতে সে ঘুমিয়ে পড়েছে। আমাদের প্রতি একদলা ঘৃণা ছড়িয়ে 
সে আরেক পৃথিবীর বাসিন্দা। জামাটা রক্তে লাল হয়ে আছে।  
ইসরায়েলের রকেটে এই ছোট বুকটা তছনছ হয়ে গেছে।
আমি এবার ধীরে ধীরে মেয়েটার দিকে এগিয়ে গেলাম।
উপুড় হয়ে মেয়েটার উপর শুয়ে পড়লাম।
তার বুকে আমার নাকটা ঘঁষলাম।
গালটাকে তার গালে মিশিয়ে দিলাম।
তারপর তার কানের কাছে ফিসফিস করে বললাম
মা জোবায়দা, আজ না আমাদের প্রজাপতি ধরার কথা ছিল?
আমি এখন একা একা কীভাবে বেঁচে থাকবো? মা?
আমাকে তুই কেন তোর সাথে নিয়ে গেলি না মা আমার?
আমি তোকে ছাড়া কীভাবে বাঁচবো, মা?

আমার কথা
আমি আজ ওর কথা তোমাদের বলব।
তার নাম ছিল ফাতিমা। ফতিমা কাওমি।
আমার চেয়ে মাত্র দেড় বছরের বড় ছিল সে।
অন্যান্য আরও ফিলিস্তিনি মেয়েদের থেকে
ওর চুলগুলো ছিল অন্যরকম।
খানিকটা সোনালি, চোখের মনিটা ছিল বাদামি।
ওর বয়স ছিল বারো আর আমি সাড়ে দশ।
ফাতিমা ছিল আমার খেলাধুলার নিত্য সাথী।
হয়তো বড় বলেই সে আমাকে একটু আধটু শাসনও করত।
আমি যে সবসময় ওর কথা শুনতাম তা কিন্ত নয়।
আমাকে আপনারা এত সুবোধ বালক ভাববেন না।
তবু বলতে অসুবিধা নেই,
ফাতিমা ছিল আমার বন্ধু, আমার অভিভাবক।
আমাকে একদিন সে দুষ্টমী করে বলেছিল,
“নাজের, যদি আমি তোর আগেই মরে যাই?”
কী বলব? আপুর এমন কথা শুনে আমি কেঁদে ফেলেছিলাম।
তবে চোখ দিয়ে কোনো কান্নার জল গড়িয়ে পড়েনি।
আপনারা জানেন তো, ফিলিস্তিনিদের চোখে আর পানি নেই।
আমারও নেই। আমাদের চোখে শুকিয়ে গেছে সেই কবে।
বেশ মনে আছে, আমি আপুকে বলেছিলাম,
“তু্ই যদি মরে যাস তাহলে আমিও ট্যাংকের নিচে ঝাঁপ দেবো। ”
অথচ কী আশ্চর্য! আমি কী অমানুষের মতোই না বেঁচে আছি।

সেদিন আমরা দুই ভাইবোন মিলে যখন ইফতারের অপেক্ষায় ছিলাম,
ঠিক তথনই সব লণ্ডভণ্ড হয়ে গেলো।
হঠাৎ করেই কী জানি হয়ে গেলো।
চোখের সামনে আপুর নিথর শরীর কয়েকবার কেঁপে থেমে গেলো।
ওর হাত নেই, পা দুটো কোথায় যেন উড়ে গেছে।
তারপর সব অন্ধকার, শুধুই কালো ভয়ংকর অন্ধকার।
হ্যাঁ, আমি বেঁচে আছি।
মাঝে মাঝে মনে হয়
আমি কেন বেঁচে আছি জানো?
আমার অধিকার আদায়ের জন্য আমি বেঁচে আছি।
আমি একদিন পঁচিশ হব, চল্লিশ হব, নব্বই হব।
আমি আমার একান্ত একটি স্বদেশ দেখে যেতে চাই।
আপনাদের মতো আমিও একজন মানুষ হিসেবে 
বেঁচে থাকতে চাই। আমি আমার সেই স্বপ্নের স্বদেশের দিকেই
ধাবিত হচ্ছি। দিন দিন বেড়ে উঠছি।

(১৩ জুলাই, ২০১৫। প্যালেস্টাইনের খান ইউনুস শহরে ইসরায়েলের বিমান হামলায় দুই পা হারিয়ে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে ১০ বছর বয়সী নাজের। নাজের-কে স্মরণ করে লেখা)

বাংলাদেশ সময়: ১২১৭ ঘণ্টা, জুলাই ০৫, ২০১৭
এসএনএস


 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

কবিতা এর সর্বশেষ