ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

রাজনীতি

সংকটে নেতাদের ভূমিকা: না.গঞ্জে শামীম ওসমান ছাড়া যেন ‘কোথাও কেউ নেই’

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০১৮ ঘণ্টা, জুলাই ২৬, ২০২৪
সংকটে নেতাদের ভূমিকা: না.গঞ্জে শামীম ওসমান ছাড়া যেন ‘কোথাও কেউ নেই’

নারায়ণগঞ্জ: নারায়ণগঞ্জে স্মরণকালের ভয়াবহ নাশকতা ও তাণ্ডবের ঘটনায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাদের নিষ্ক্রিয়তায় চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে সাধারণ নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের মাঝে। বিশেষ করে জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের প্রধান কার্যালয়ে আগুন ও লুটপাটের ঘটনার পর শীর্ষ নেতারা দেখতে না আসায় ক্ষোভে ফুঁসছেন তারা।

১৪ বছরে ক্ষমতার স্বাদ নিয়ে ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’ হওয়া আর পদ-পদবির জন্য মাঠে নামা নেতারা ‘যে গর্তে লুকিয়ে আছেন’ সেখানেই থাকার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

অবশ্য গত ১৯ জুলাই (শুক্রবার) নাশকতাকারীদের বিরুদ্ধে মাঠে নামায় আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য একেএম শামীম ওসমানকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিরা। তারা বলছেন, শুক্রবার শামীম ওসমান মাঠে না নামলে পুরো শহর জ্বালিয়ে দিতো নাশকতাকারীরা।

জানা গেছে, গত ১৮ জুলাই বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে প্রায় আড়াই ঘণ্টা কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এরপর সন্ধ্যা থেকে শুরু হয় নাশকতা। ব্যাপক তাণ্ডব চালানো হয় ঐতিহ্যবাহী নারায়ণগঞ্জ ক্লাবে। ওইদিন রাতেই ভাঙচুর করা হয় নগরীর ১৬নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ কার্যালয়, আগুন দিয়ে লুটপাট করা হয় জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের প্রধান কার্যালয়ও।

একইসঙ্গে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের ভুইগড় এলাকায় আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের কার্যালয়সহ বিভিন্ন স্থাপনায় আগুন দিয়ে ভাঙচুর করে লুটপাট চালানো হয়। লিংক রোডের সাইনবোর্ড ও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় বেশ কয়েকটি যানবাহন।

এর আগে ১৪ জুলাই দেশে ফিরেই হাসপাতালে ভর্তি হন স্থানীয় সংসদ সদস্য শামীম ওসমান। কিন্তু পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে শুনে তিনি শনিবার একটি সমাবেশের আয়োজন করার নির্দেশ দেন। শামীম ওসমানের নির্দেশে ফতুল্লা, সিদ্ধিরগঞ্জ, শহর, বন্দরের নেতা-কর্মীরা প্রস্তুতিও নিতে থাকেন। অসুস্থাবস্থায় শুক্রবার সকালেই নারায়ণগঞ্জে আসেন তিনি। ওই দিন জুমার নামাজের পর একটি মিছিল বের করে নগরীর প্রধান সড়ক বঙ্গবন্ধু রোড অবরোধের চেষ্টা চালানো হয়, সেসময় বিভিন্ন মার্কেটে ভাঙচুর ও লুটপাটের চেষ্টা চলে। নাশকতা ঠেকাতে নেতা-কর্মীদের নিয়ে মাঠে নামেন শামীম ওসমান।

এসময় শামীম ওসমানকে লক্ষ্য করে দুর্বৃত্তরা ককটেল ও গুলি ছুড়লে শুরু হয় সংঘর্ষ। শামীম ওসমান নগরীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে নেতা-কর্মীদের নিয়ে টহল শুরু করেন। এসময় ডিআইটি ও নয়ামাটি এলাকায় ফের ককটেল ও গুলিবর্ষণ শুরু হলে সংঘর্ষ চরম আকার ধারণ করে। এক পর্যায়ে শামীম ওসমান নেতা-কর্মীদের নিয়ে পাল্টা ধাওয়া দিলে নাশকতাকারীরা পিছু হটে। এরপর শামীম ওসমানের নেতৃত্বে নেতা-কর্মীরা ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড ও সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকায় পৌঁছালে সেখানেও শত শত নাশকতাকারীরা পিছু হটে। শামীম ওসমান সন্ধ্যায় নেতা-কর্মীদের নিয়ে ফতুল্লার বিসিকসহ বিভিন্ন এলাকাতে টহল দেন। পরে তিনি নেতা-কর্মীদের নিয়ে রাতভর শহরে অবস্থান করলে চোরাগোপ্তা হামলা শুরু করে নাশকতাকারীরা।

লিংক রোড ও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে হামলাকারীদের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় লিংক রোডের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামের পাশে মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক শাহ নিজাম উদ্দিনের মালিকানাধীন ‘নাসিম ওসমান মেমোরিয়াল পার্ক’, শামীম ওসমানের ব্যবসায়িক অংশীদরত্বে চলা শীতল এসি বাস ট্রান্সপোর্টের ২৬টি বাস, এসবি নিট নামে বহুতল রপ্তানিমুখি গার্মেন্টসহ প্রায় ২০টি যানবাহন। রাতে নাশকতাকারীরা নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নগর ভবনে আগুন দিলে তাদের প্রতিহত করার চেষ্টা করা হয়।

নগরীর ১৫নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি এইচ এম রাসেল বলেন, কী বলবো বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। নগর ভবনে আগুনের ঘটনায় সদর থানায় সিটি করপোরেশনের দায়ের করা মামলায় দলের এমন ছেলেদেরও নাম দেওয়া হয়েছে, যারা সরাসরি গত ১৯ জুলাই শুক্রবার বিএনপি ও শিবিরের সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে মাঠে লড়াই করেছে। যখন নগর ভবনে আগুনের ঘটনা ঘটেছে তখন এই ছেলেগুলো লিংক রোডে নাশকতাকারীদের বিরুদ্ধে লড়াই করছিল। এই ঘটনায় কর্মীরা যে কোনো সময় ক্ষোভে ফেটে পড়তে পারেন।

মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট খোকন সাহা বলেন, আমি ও আমার সভাপতি আনোয়ার হোসেন, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু হাসনাত শহীদ বাদল ছাড়া জেলা ও মহানগর পর্যায়ের কাউকেই দেখলাম না ক্ষতিগ্রস্ত আওয়ামী লীগ অফিসটি দেখতে গেছেন। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল হাইসহ অনেক সহ-সভাপতিও আছেন, তারাও আসেননি একটিবারের জন্য। কাকে বলবো এসব কথা, আর কর্মীদেরই বা কী উত্তর দেব। আমার মনে হয় কর্মীদের এসব প্রশ্নের উত্তর কেন্দ্রীয় নেতারাই ভালো দিতে পারবেন।  

অপরদিকে শামীম ওসমানের অবস্থানের কারণে শনিবার ও রোববার নারায়ণগঞ্জ শহরে কোনো নাশকতা চালাতে ব্যর্থ হয় দুর্বৃত্তরা। গত দু’দিনে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে থাকলে এ নিয়ে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরেই শুরু হয় আলোচনা। দলের নেতা-কর্মীরা তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন জেলা ও মহানগরের শীর্ষ নেতাদের ওপর।

নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের নেতা হুমায়ুন কবীর মৃধা বলেন, জেলায় চারজন আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি আছেন, মেয়র আছেন, দলীয় উপজেলা, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আছে, দলীয় কাউন্সিলররা আছেন। কিন্তু এক শামীম ওসমান আর তারপন্থী লোকজন ছাড়া মাঠে দেখলাম না কাউকেই।

মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক শাহ নিজাম বলেন, নারায়ণগঞ্জের পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে এক শামীম ওসমান ছাড়া কোথাও কেউ নেই। পদ-পদবির জন্য শত শত কর্মী নিয়ে যাদের মিছিল করতে দেখি, কেন্দ্রীয় নেতারা এসে যাদের গুণকীর্তন করেন, যারা বামপন্থীদের নিয়ে মাঠে নেমে নিজেকে সাহসী দাবি করেন, তাদেরও দেখা পাইনি।

দলের ক্ষুব্ধ কর্মী-সমর্থকরা বলেন, যারা গর্তে লুকিয়ে আছেন, আশা করবো তারা সেখানেই থাকবেন। পরিবেশ-পরিস্থিতি ভালো হওয়ার পর মাঠে নামলে তাদের লজ্জিত হতে হবে আমাদের কাছে।

এদিকে নারায়ণগঞ্জের ঘটে যাওয়া ঘটনা ও তৃণমূলের ক্ষোভের বিষয়ে জানতে চাইলে সংসদ সদস্য শামীম ওসমান বলেন, আমি দেশের বাইরে ছিলাম। ফিরেই অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। কিন্তু আমাকে মোবাইলে ফোন করে একজন হিন্দু ভদ্র মহিলা রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় তার ও কিশোরী সন্তানের ওপর ঘটে যাওয়া যে বীভৎস বর্ণনা দিয়েছিলেন, তা শুনে নিজেকে আর হাসপাতালের বেডে ধরে রাখতে পারিনি। একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে জামায়াত-শিবির ও অগ্নিসন্ত্রাসের বিরুদ্ধে, প্রাণের নারায়ণগঞ্জ আর নারায়ণগঞ্জবাসীকে এই ধ্বংসলীলার হাত থেকে বাঁচাতেই নেমেছিলাম। কে নামেননি বা নামতে পারেননি সেটা আমার কাছে কোনো ম্যাটার না।

শামীম ওসমান বলেন, আমার মনে হয় ক্ষমতার সুবিধা নিয়ে কারা দেশের এমন ক্রান্তি লগ্নে ঘুমিয়ে আছেন আর এই চরম মুহূর্তেও বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা করছেন তাদের চিহ্নিত করার সময় এসেছে। দলের সাংগঠনিক ভিত্তিকে গোছানো ও মজবুত না করতে পারলে সামনে এর চেয়েও বেশি ধাক্কা খাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

এসময় নগরীর ১৬নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ কার্যালয় ও জেলা-মহানগর আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে হামলা ও আগুন দেওয়ার পরও অনেক শীর্ষ নেতা সেখানে যাননি কেন, এমন প্রশ্ন করেন শামীম ওসমান। তিনি বলেন, তারা কেন নামেননি এই প্রশ্নের উত্তর তারাই দিতে পারবেন এবং কেন্দ্রীয় নেতাদেরও এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া উচিত বলে মনে করি। তা না হলে ভবিষ্যতে কেউই নামবে না।  

এদিকে সংকটময় মুহূর্তে ভূমিকার জন্য শামীম ওসমানকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিরা। জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট মহসিন মিয়া বলেন, শামীম ওসমান মাঠে নামার কারণেই নাশকতাকারীরা ভীত হয়েছে, নগরী রক্ষা পেয়েছে।

নারায়ণগঞ্জ চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি খালেদ হায়দার খান কাজল বলেন, জেলার অর্ধশত ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতৃত্ব দেয় চেম্বার। সব ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা শামীম ওসমানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। তারা বলেছেন, দেশের অন্যতম ব্যবসায়িক কেন্দ্রটি নারায়ণগঞ্জ শহর ছিল তাণ্ডবকারীদের অন্যতম টার্গেট। শামীম ওসমান পুরো নগরীকে নিরাপদ করেছেন।

দেশের গার্মেন্ট মালিকদের বৃহৎ সংগঠন বিকেএমইএর সহ-সভাপতি সোহেল সারোয়ার বলেন, শামীম ওসমান নিজেই অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ছিলেন। তিনি সেই অসুস্থ শরীর নিয়ে মাঠে নেমেছেন সাধারণ মানুষকে, বিশেষ করে ব্যবসায়ীদের নিরাপদ করতে। আমরা তার কাছে কৃতজ্ঞ, তিনি মাঠে না নামলে শহরের পরিস্থিতি কী হতো, তা ভাবলেও গা শিউরে উঠছে।

বাংলাদেশ সময়: ২০১৫ ঘণ্টা, জুলাই ২৬, ২০২৪
এমআরপি/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।