ঢাকা: বিরোধী সংগঠনের নেতাকর্মীদের রগ কাটা, হত্যা ও নির্যাতনের অভিযোগ ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে বরাবরই। ১৯৭৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠিত ধর্মাশ্রয়ী এ ছাত্র সংগঠন প্রতিষ্ঠার মাত্র তিন বছর পর থেকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড শুরু করে, যা চলছে এখনো।
ছাত্রলীগের হিসাব মতে, ১৯৮১ সাল থেকে আজ পর্যন্ত গত ৩২ বছরে ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের ৩২ জন নেতাকর্মী ছাত্র শিবিরের হাতে নিহত হন। আহত হয়েছেন অসংখ্য মেধাবী শিক্ষার্থী।
ছাত্রলীগের দফতরে বিভিন্ন সময় শিবিরের হাতে নিহত ও আহত ছাত্র নেতাদের তালিকা সংরক্ষিত রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, এসব ছাত্র নেতাদের শিবির সরাসরি হত্যা করেছে কিংবা তাদের দোসরদের দিয়ে হত্যা করিয়েছে।
ছাত্রলীগের দফতর সূত্রে জানা গেছে, ১৯৮১ সালে চট্টগ্রাম সিটি কলেজের নির্বাচিত এজিএস ছাত্রলীগ নেতা তবারক হোসেনকে হত্যা করে শিবির। এটি ছিল শিবিরের প্রথম হত্যা।
এরপর থেকে একের পর এক হত্যাযজ্ঞ চালায় শিবির। ১৯৮২ সালের ১১ মার্চ শিবিরের হামলায় মারা যান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ নেতা মীর মোশতাক এলাহী।
১৯৮৪ সালে শিবির চট্টগ্রাম কলেজের সোহরাওয়ার্দী হলে ছাত্র ইউনিয়ন নেতা ও মেধাবী ছাত্র শাহাদাত হোসেনকে জবাই করে হত্যা করে। ১৯৮৬ সালে জাতীয় ছাত্রসমাজের নেতা আবদুল হামিদের হাতের কবজি কেটে নেয় শিবির ক্যাডারা।
১৯৮৮ সালে শিবিরের ক্যাডার বাহিনী ছাত্রমৈত্রী নেতা ডাক্তার জামিল আক্তার রতনকে কুপিয়ে ও হাত পায়ের রগ কেটে হত্যা করে। একই বছর চাঁপাইনবাবগঞ্জের বীর মুক্তিযোদ্ধা ও জাসদ নেতা জালালকে হত্যা করে তারা।
ওই বছরের ১৭ নভেম্বর শিবিরের হামলায় মারা যান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আসলাম হোসেন। এর পরদিনই শিবিরের হামলায় মারা যান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আজগর আলী।
ওই বছর ঘটেছে আরও কয়েকটি হত্যার ঘটনা। ১৭ জুলাই এসএম হলে বহিরাগত শিবির ক্যাডাররা হামলা চালিয়ে জাসদ ছাত্রলীগের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সহ সভাপতি ও সিনেট সদস্য আইয়ুব আলী খান, বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক ও সিনেট সদস্য আহসানুল কবির বাদল ও হল সংসদের ভিপি নওশাদের হাত-পায়ের রগ কেটে দেয়।
একই বছর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক মো. ইউনূসের বাসভবনেও বোমা হামলা চালানো হয়।
১৯৮৮ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর তিন জনকে হত্যা করে সিলেটের রাজনীতির ইতিহাসে কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সৃষ্টি করে ছাত্রশিবির। এদিন শিবির ক্যাডাররা জাসদ ও ছাত্রলীগের মেধাবী নেতা মুনীর-ই-কিবরিয়া চৌধুরী, তপন জ্যোতি ও এনামুল হক জুয়েলকে হত্যা করে।
১৯৮৯ সালের ১৮ এপ্রিল শিবিরের হামলায় মারা যান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শফিকুল ইসলাম। ১৯৯০ সালের ২২ ডিসেম্বর হত্যা করা হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রমৈত্রীর সহ সভাপতি ফারুকুজ্জামানকে।
১৯৯২ সালের ১৭ মার্চ গুলি করে হত্যা করা হয় জাসদ ছাত্রলীগ কর্মী ইয়াসির আরাফাত। এ বছর শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের বিচারের দাবিতে করা আন্দোলনে শিবির হামলা করে। এতে আহত হন জাসদ নেতা মুকিম। পাঁচদিন পর তিনি মারা যান।
১৯৯৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর খুন হন ছাত্রমৈত্রী নেতা জুবায়ের হোসেন রিমু। ১৯৯৪ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রমৈত্রী নেতা প্রদ্যুৎ রুদ্র চৈতীর হাতের কব্জি কেটে নেওয়া হয়। ১৯৯৫ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি শিবিরের হাতে খুন হন ছাত্রমৈত্রীর আরেক নেতা দেবাশীষ ভট্টাচার্য।
১৯৯৭ সালে শিবিরের হামলা শিকার হন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ কর্মী বকুল।
১৯৯৮ সালে বরিশাল থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে আসা ছাত্র আইয়ুব আলী শিবিরের হাতে নিহত হন। ১৮ মে চট্রগ্রাম শহরতলির বটতলী এলাকায় শহরগামী শিক্ষকবাসে শিবিরের গুলিবর্ষণের ঘটনায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মুসফিকুর সালেহীন নিহত হন।
একই বছর ২৪ মে সিলেটের ব্লু-বার্ড স্কুলের সামনে ছাত্রলীগ নেতা সৌমিত্র বিশ্বাসকে হত্যা করা হয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী সঞ্জয় তলাপত্রকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় এবছর।
২০০০ সালে বহুল আলোচিত ৮ মার্ডারের ঘটনা ঘটে চট্টগ্রামে। এ বছর চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটে ৮ জন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীকে প্রকাশ্য দিবালোকে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে শিবির ক্যাডাররা।
২০০১ সালে শিবিরের হাতে নিহত হন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতা আলী মর্তুজা। এ বছর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হলে শিবির কর্মীরা কমান্ডো হামলা চালায়। এতে ছাত্রীদের লাঞ্ছিত ও রক্তাক্ত করে তারা।
২০০৪ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রীদের মিছিলে হামলা চালিয়ে শিবির ক্যাডাররা অর্ধশতাধিক ছাত্রীকে রক্তাক্ত করে। ওই বছর ৩১ আগস্ট শিবিরের হাতে নিহত হন সিলেট সরকারি ভেটেরিনারি কলেজের ছাত্র রফিকুল হক সোহাগ।
২০১০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি শিবিরের সঙ্গে ছাত্রলীগের সংঘর্ষ হয়। এদিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ কর্মী ফারুক হোসেনকে হত্যা করে ম্যানহোলের মধ্যে ফেলে রাখে শিবির কর্মীরা। ১২ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র এএএম মহিউদ্দিনকে শিবির ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে।
একই বছরের মার্চ মাসে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস দখল করতে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী বিনোদপুর বাজারে তিন ছাত্রলীগ কর্মীকে কোপায় শিবির। এ ঘটনায় সোহরাওয়ার্দী হলের ৮ শিক্ষার্থী আহত হন।
গত বছরের ১৯ অক্টোবর শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ কর্মী ইমরান আহমেদ কুপিয়ে আহত করা হয়। এ বছরের ২১ নভেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সহ সভাপতি আখেরুজ্জামান তাকিমের ওপর হামলা চালায় শিবির।
এ বছরের ২২ আগস্ট রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এসএম তৌহিদ আল হাসান তুহিনের ওপর হামলা চালিয়ে তার হাত-পায়ের রগ কেটে দেয় শিবির কর্মীরা। এর পরের দিন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবি) ছাত্রলীগ কর্মী রুহুল আমিনের হাত ও পায়ের রগ কেটে দেওয়া হয়।
এ তালিকা প্রসঙ্গে ছাত্রলীগের দফতর সম্পাদক শেখ রাসেল বাংলানিউজকে বলেন, বিভিন্ন সময় এসব ঘটনা ঘটার পর পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ ও নিজস্ব অনুসন্ধানের মাধ্যমে এ তালিকা তৈরি করা হয়েছে। এ তালিকা শিবিরের অপকর্মের একটি খণ্ডিত অংশ মাত্র। শিবির এর চেয়ে আরও বেশি ভয়ঙ্কর।
শিবিরের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের তীব্র সমালোচনা করে ছাত্রলীগের সভাপতি এইচএম বদিউজ্জামান সোহাগ বাংলানিউজকে বলেন, বিগত সময়ের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য শিবিরের সব নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করতে হবে।
তিনি বলেন, রাষ্ট্রের সব জঙ্গি কর্মকাণ্ডের মূলে শিবির। দেখা যায়, যারা বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত, তারা অতীতে শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল। তারা রাষ্ট্রীয় ও আর্ন্তজাতিক সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে জড়িত। এদের রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধ করা উচিত।
শিবিরকে বর্জন করতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রতি আহ্বানও জানান তিনি।
শিবিরের হত্যার রাজনীতি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শিবিরের কেন্দ্রীয় সহ-প্রচার সম্পাদক জামাল উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, যুবলীগ নেতা মিল্কিকে তাদের নিজেদের লোকরা হত্যা করেছেন বলে আমরা মিডিয়ায় দেখেছি। বিশ্বজিৎকে ছাত্রলীগ হত্যা করেছে।
এগুলো মিডিয়ার কল্যাণে প্রমাণিত হয়েছে। নইলে হয়তো বলা হতো, শিবির তাদের হত্যা করেছে। আসলে তারা নিজেরাই বিভিন্ন স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে নিজেদের লোকদের হত্যা করেন। আর প্রকৃত ঘটনা ধামাচাপা দিতে শিবিরের ওপর দোষ চাপান।
হত্যার রাজনীতির সঙ্গে শিবির জড়িত নয় দাবি করে তিনি বলেন, আজ পর্যন্ত শিবিরের ১৭৭ জন নিহত হয়েছেন। যাদের কেউই ক্ষমতার ভাগাভাগি কিংবা অন্তর্কোন্দলে মারা যাননি। অথচ ছাত্রলীগসহ অন্য ছাত্র সংগঠনের বেলায় এটা প্রায়ই ঘটে থাকে। শিবির আদর্শের রাজনীতি করে, হত্যার রাজনীতি করে না।
বাংলাদেশ সময়: ০৬৫২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৬, ২০১৩
এমইউএম/এএ/এএসআর/এসআরএস