ঢাকা: কোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধের দায় নিতে চায় না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। তাই মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের রায়ে জামায়াত অপরাধী ও সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত হলেও দলটিকে নিষিদ্ধের ব্যাপারে কালক্ষেপণ করছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার।
কেবলমাত্র আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই বিষয়টির নিষ্পত্তির চিন্তা-ভাবনা করছে সরকার। তবে সরকারের সে প্রক্রিয়ারও কোনো অগ্রগতি নেই। মানবতাবিরোধী অপরাধী সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচারের জন্য সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন (আইসিটি)-১৯৭৩ সংশোধনের উদ্যোগ নিলেও দীর্ঘদিন ধরে তা আটকে আছে। একই সঙ্গে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের আপিল নিষ্পত্তিও প্রায় ৩ বছর ঝুলে আছে।
জামায়াতের যুদ্ধাপরাধের বিচার সংক্রান্ত সংশোধিত আইন সংসদের পাসের জন্য মন্ত্রিসভার অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। আইন মন্ত্রণালয় থেকে একটি খসড়া তৈরি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়েছে। প্রায় দেড় বছর ধরে খসড়াটি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পড়ে আছে। কবে সেটি মন্ত্রিসভার বৈঠকে তোলা হবে, সে ব্যাপারেও কেউ কিছু বলতে পারেন না।
আইনের খসড়াটি কবে মন্ত্রিসভার বৈঠকে তোলা হবে জানতে চাওয়া হলে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলতে পারেননি। তিনি শুক্রবার(২৭ মে) বাংলানিউজকে বলেন, জামায়াতের বিচার সংক্রান্ত আইনের খসড়াটি মন্ত্রিসভার বৈঠকে আসবে, খুব শিগগিরই আসবে। এ বছরই আসবে কি-না জানতে চাওয়া হলে আইনমন্ত্রী বলেন, দেখা যাক কি হয়।
এদিকে আইনটি সংশোধিত না হওয়ায় জামায়াতের বিরুদ্ধে তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হলেও গত দুই বছর তিন মাসেও আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) তৈরি করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দাখিল করতে পারছেন না প্রসিকিউশন। আইন অনুসারে এ ফরমাল চার্জ গ্রহণ করলে পরবর্তীতে অভিযোগ গঠন সাপেক্ষে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে জামায়াতের বিচার শুরু হবে। ২০১৪ সালের ২৭ মার্চ দল দলবদ্ধভাবে জামায়াতের বিরুদ্ধে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রসিকিউশনের কাছে জমা দিয়ে রেখেছেন ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা।
আইনটি সংশোধিত হলে কেবল জামায়াতই নয়, মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র বিরোধিতাকারী অন্য পাঁচটি দল পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি (পিডিপি), নেজামে ইসলাম, মুসলিম লীগ (কনভেনশন), মুসলিম লীগ (কাউন্সিল) ও কৃষক শ্রমিক পার্টিরও বিচার হবে।
আইন সংশোধন সাপেক্ষে বিচারে দোষী সাব্যস্ত হলে জামায়াত ছাড়াও তাদের অঙ্গ সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির (সে সময়কার ইসলামী ছাত্রসংঘ) ও ইসলামী ছাত্রীসংস্থা, শান্তি কমিটি, রাজাকার বাহিনী, আলবদর বাহিনী, আলশামস এবং মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম নিষিদ্ধ ও অবলুপ্ত হওয়াসহ তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হয়ে যাবে। জামায়াতের বিভিন্ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। ভবিষ্যতেও যেন কেউ এ ধরনের রাজনীতির আলোকে রাজনৈতিক দল গঠন বা রাজনীতি করতে না পারেন সে রায়ও দিতে পারবেন ট্রাইব্যুনাল। জামায়াতের নীতিনির্ধারক, সংগঠক, পরিচালক এবং কেন্দ্র থেকে শুরু করে সকল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য দায়ী হবেন।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও সরকার সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, কোনো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের দায় যাতে আওয়ামী লীগের ওপর না চাপে সে বিষয়টি চিন্তায় রাখা হয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র বিরোধিতা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধসহ সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে জামায়াত অপরাধী ও সন্ত্রাসী দল হিসেবে চিহ্নিত হলেও এটি রাজনৈতিক দল হিসেবেও পরিচিত। তাই জামায়াত নিষিদ্ধ হলে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের দায় আওয়ামী লীগের ওপর এসে যেন না পড়ে, সে বিষয়টিও চিন্তা করা হচ্ছে। এ কারণে নির্বাহী ক্ষমতায় জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হচ্ছে না।
জামায়াতের শীর্ষনেতা আধ্যাত্মিক গুরু সাবেক আমির গোলাম আযমসহ অন্য নেতাদের যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের রায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল জামায়াতকেও সন্ত্রাসী ও অপরাধী সংগঠন হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। একইসঙ্গে হাইকোর্টের রায়ে রাজনৈতিক দল হিসেবে নির্বাচন কমিশনের দেওয়া জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হয়েছে। এ অবস্থায় সরকার নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগ করেই জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে পারে। এ ব্যাপারে আইনগত কোনো বাধা নেই বলেও জানান আইন বিশেষজ্ঞরা।
সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, হাইকোর্টের রায়ে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হয়েছে। কোনো দলের যদি নিবন্ধন বাতিল হয়, তাহলে সেটি শুধু নির্বাচনে অংশ নেওয়ার অযোগ্যই না, রাজনৈতিক হিসেবেও বৈধতা থাকে না। এ রায়ের পর জামায়াতকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা যায়।
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ বিভিন্ন মহল থেকে যুদ্ধাপরাধী এবং ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনীতি এবং সন্ত্রাসী, জঙ্গিবাদী তৎপরতার দায়ে জামায়াতকে নিষিদ্ধের দাবি রয়েছে। এ দাবিতে দীর্ঘ দিন ধরে জোরালো আন্দোলন চলে আসছে। এ প্রেক্ষাপটে জামায়াতের বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেয় সরকার। কিন্তু সেটি আর এগোচ্ছে না।
তবে আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জামায়াতের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন সংশোধনেরও কোনো প্রয়োজন নেই। যে আইন রয়েছে সেই আইনেই বিচার করা সম্ভব।
সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বাংলানিউজকে আরও বলেন, যে আইন আছে দল হিসেবে জামায়াতের যুদ্ধাপরাধের বিচার করার জন্য সেটিই যথেষ্ট। আইসিটি আইনেই জামায়াতের বিচার এবং সাজা দেওয়া সম্ভব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের দল নাৎসি পার্টিও বিচারের মাধ্যমে নিষিদ্ধ হয়েছে। একই অপরাধ করেছে জামায়াত। এ অপরাধের বিচার হলে জামায়াত নিষিদ্ধ হবে।
এদিকে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে দেওয়া হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে জামায়াতের করা আপিলও নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে। জামায়াতকে নির্বাচন কমিশনের দেওয়া নিবন্ধনের বিরুদ্ধে তরিকত ফেযারেশনের নেতারা ২০০৯ সালে হাইকোর্টে রিট করেন। এ রিটের শুনানি শেষে ২০১৩ সালের ১ আগস্ট জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট। এর পর পরই জামায়াতের পক্ষ থেকে এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হয়। প্রায় ৩ বছর ধরে এটি আপিল বিভাগে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে।
আওয়ামী লীগ ও সরকার সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো আরও জানায়, জামায়াত নিষিদ্ধ হলে পরবর্তী পরিস্থিতি কি হবে, নিষিদ্ধের পর জামায়াত আরও সন্ত্রাসী ও নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড চালায় কি-না, সেসব বিষয় চিন্তায় রাখা হয়েছে। তাছাড়া আন্তর্জাতিকভাবে কোনো কোনো মহল থেকে সমালোচনা বা চাপ আসে কি-না, সে বিষয়টিও ভাবা হচ্ছে। এসব কারণে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপগুলোতে কৌশলগত ধীরগতি রয়েছে। আর সরকারের ধীরে চলা নীতির কারণেই সব কিছু আটকে আছে।
বাংলাদেশ সময়: ০০৫০ ঘণ্টা, মে ২৯, ২০১৬
এসকে/এএসআর