ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

রাজনীতি

পুনর্গঠনের ‘প্রস্তাব’ নিয়ে কী ভাবছে বিএনপির তৃণমূল

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৩৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২২, ২০১৯
পুনর্গঠনের ‘প্রস্তাব’ নিয়ে কী ভাবছে বিএনপির তৃণমূল

ঢাকা: সদ্য শেষ হওয়া একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়ের পর বিএনপির উচ্চপর্যায় থেকে দল পুনর্গঠনের ডাক দেওয়া হয়েছে। দলের সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী ফোরামের অন্তত তিনজন নেতা ইতোমধ্যে প্রকাশ্যেই বলেছেন, ‘আমাদের মতো বর্ষিয়ান ও ব্যর্থদের বাদ দিয়ে ত্যাগী ও মাঠে থাকা অপেক্ষাকৃত তরুণদের দিয়ে দল পুনর্গঠন করতে হবে।’ 

সিনিয়রদের এই উপলদ্ধিকে তৃণমূল নেতাকর্মীরা কীভাবে দেখছেন? জানতে চাইলে দলের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুস সালাম আজাদ বাংলানিউজকে বলেন, ‘দল পুনর্গঠন তো প্রয়োজন। এটা চলমান প্রক্রিয়া।

তার আগে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে লাখ লাখ নেতাকর্মীর নামে মামলা দেওয়া হয়েছে। হাজার হাজার নেতাকর্মী কারাগারে আছে। তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। তাদের পরিবারের পাশে দাঁড়াতে হবে। যারা কারাগারে আছেন তাদের জামিনের ব্যবস্থা করতে হবে। তারপর যথাসময়ে কাউন্সিলের মাধ্যমে দলের পুনর্গঠন করতে হবে। ’  

দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বহুদিন ধরেই দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতারা দল পুনর্গঠনের পক্ষে ছিলেন। তবে নানা প্রতিকূলতার মধ্যে সেটা হয়ে ওঠেনি। তৃণমূল নেতাকর্মীরা এ নিয়ে দারুণভাবে সরব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।  

সবমিলিয়ে জাতীয় কাউন্সিল আয়োজনের মাধ্যমে এরই মধ্যে শূন্য হয়ে পড়া পদগুলো পূরণ ও বার্ধক্যজনিত কারণে অক্ষম নেতাদের সরিয়ে শারীরিকভাবে সক্ষম, সাংগঠনিকভাবে দক্ষ এবং রাজনৈতিকভাবে প্রজ্ঞাবান নেতাদের নিয়ে কমিটি পুনর্গঠনের দাবি এখন বেশ জোরালো।

গত ১৮ জানুয়ারি (শুক্রবার) রাজধানীর সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন মিলনায়তনে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ৮৩তম জন্মদিনের আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। এতে দলের সিনিয়র নেতারা বিএনপি পুনর্গঠন ও নেতৃত্ব পরিবর্তনের বিষয়ে প্রকাশ্যে কথা বলেন।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সভাপতিত্বে ওই আলোচনা সভায় দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আমাদের ঘুরে দাঁড়াতে হলে দলকে পুনর্গঠন করতে হবে। কাউন্সিলের মাধ্যমে দলকে পুনর্গঠন করতে হবে। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যারা পরীক্ষিত তাদের নেতৃত্বে আনতে হবে। প্রয়োজনে আমরা যারা ব্যর্থ তারা সরে দাঁড়াবো। ’

স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ একই অনুষ্ঠানে বলেন, ‘এখন আমাদের দুটি কাজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটি হলো নেতাকর্মীদের পুনর্বাসন আর অপরটি দল পুনর্গঠন। নতুন করে দলকে পুর্নগঠন করতে হবে। যারা দলের জন্য নিবেদিত প্রাণ হিসেবে কাজ করেছে তাদের সামনে এনে পুনর্গঠন করতে হবে। দরকার হলে আমরা সামনে থেকে সরে যাবো। ’

ওই অনুষ্ঠানে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর বলেন, ‘আমি একটু ভিন্ন ভাষায় বলতে চাই, কেউ মাইন্ড করবেন না। যারা বর্তমানে দলের নেতৃত্বে আছেন, তাদের আরো অ্যাকটিভ হতে হবে। জিয়ার আদর্শকে ধারণ করে আমাদের নেতৃত্বকে এগিয়ে যেতে হবে। এটা করতে না পারলে নেতৃত্বে থাকার প্রয়োজন নেই। ’

দলের একাধিক সূত্র জানায়, গত ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে ‘অপ্রত্যাশিত’ পরাজয়ের পর থেকেই বিএনপি পুনর্গঠন ও দলের নেতৃত্ব বদলের আলোচনাটি সামনে আসতে থাকে। সেই আলোকে গুলশানের একটি বাড়িতে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির বেশ কয়েকজন নেতা বৈঠকে বসেন। তারা দলের বর্তমান নেতৃত্ব ও নীতি-নির্ধারকদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেন।  

সেই বৈঠকে ন্যূনতম ৬টি দাবি নিয়ে তারা অবিলম্বে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির বৈঠক আহ্বানের জন্য মহাসচিব ও স্থায়ী কমিটির সদস্যদের চাপ দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।  

এরপর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলের সিনিয়র নেতাদের বৈঠকে তারা লিখিত দাবি পেশ করে অবিলম্বে জাতীয় নির্বাহী কমিটির বৈঠক আহ্বানের জন্য চাপ সৃষ্টি করেন। কিন্তু বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই মুহূর্তে দলের নির্বাহী কমিটির বৈঠক আহ্বান করার মত উপযুক্ত সময় না বলে সেই দাবি প্রত্যাখ্যান করেন।  

বাংলানিউজকে তিনি বলেন, জাতীয় নির্বাহী কমিটির অধিকাংশ সদস্য হয় কারাগারে না হয় পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এই পরিস্থিতিতে নির্বাহী কমিটির বৈঠক ডাকা সম্ভব নয়।

বিএনপি সূত্র বলছে, মহাসচিবের প্রত্যাখ্যানের পর দলটির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্যরা তাদের দাবির পক্ষে কমিটির অন্য সদস্যদের সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছেন। লিখিত দাবিতে সবার স্বাক্ষর গ্রহণ করছেন তারা। ইতোমধ্যে প্রায় ৬০ জনেরও বেশি নেতা এ দাবির পক্ষে স্বাক্ষর করেছেন।  

ধীরে ধীরে সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতাদের স্বাক্ষর গ্রহণ শেষে তারা এ দাবি কারাবন্দি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও লন্ডনে নির্বাসিত ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা।

দল পুনর্গঠনের উদ্যোক্তাদের দাবি, বিএনপির অনেক সিনিয়র নেতা ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে আঁতাত করে রাজনীতি করেন। অবিলম্বে তাদের নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দিতে হবে। স্থায়ী কমিটির বয়সের ভারে বৃদ্ধ, অকার্যকর, অক্ষম ও নিষ্ক্রিয়দের বাদ দিয়ে স্থায়ী কমিটির পুনর্গঠন করতে হবে। কোনো পরিস্থিতিতেই বর্তমান সংসদে নির্বাচিতরা শপথ গ্রহণ করবেন না।  

একাধিক নেতাকর্মী বলেন, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার-খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বর্তমান নির্বাচন কমিশন বাতিল করা ছাড়া আর কোনো নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করবে না বিএনপি। অবিলম্বে এ ঘোষণা দিয়ে ধারাবাহিক আন্দোলন করতে হবে। জাতীয় নির্বাহী কমিটির সভা আহ্বান করে বিএনপির কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে হবে। খালেদা জিয়াসহ কারাবন্দি নেতাদের মুক্তির জন্য আইনি লড়াই করতে হবে ও একটি শক্তিশালী আইনি সেল গঠন করতে হবে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, আমি মনে করি বিএনপি জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত একটি দল, এটি অমর। তবে দলের নেতারা তার আদর্শ থেকে দূরে সরে গেছে। সেজন্য দল পুনর্গঠন করা দরকার। বিএনপি যদি আবার জিয়ার আদর্শে ফিরে আসতে পারে, তার আদর্শে উদ্ধুদ্ধ হতে পারে, তাহলে এগিয়ে যেতে পারবে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন প্রতিকূল রাজনৈতিক সময় পার করছে বিএনপি। দীর্ঘ একযুগ ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটির চেয়ারপারসন কারাবন্দি, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশের বাইরে।  

দলের শীর্ষ থেকে তৃণমূল পর্যন্ত সব স্তরের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলার পাহাড়। ক্ষমতার বাইরে থাকার পাশাপাশি চরমভাবে সংকুচিত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের অধিকার। সরকারের কঠোর নিপীড়নের মুখে খাদের একেবারে কিনারে অবস্থান করছে দলটি।  

এই ধরনের একটি পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে দলের শক্তিশালী নীতি-নির্ধারক ফোরামের প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা।  

বাংলাদেশ সময়: ১১২৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২২, ২০১৯
এমএইচ/এমএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।