ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

রাজনীতি

জৌলুস হারাচ্ছে মধুর ক্যান্টিনের রাজনীতি

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৫১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৮, ২০১৯
জৌলুস হারাচ্ছে মধুর ক্যান্টিনের রাজনীতি মধুর ক্যান্টিন। ছবি: শাকিল আহমেদ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: মধুর ক্যান্টিন। স্বাধীন বাংলাদেশের গৌরবময় ইতিহাসের অংশ। ঢাকার নবাবদের পরিত্যক্ত বাগানবাড়িতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মধুর ক্যান্টিনের স্থায়ী ঠিকানা করে। ১৯৭২ সালে প্রশাসন, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নেতাদের প্রচেষ্টায় লাগানো হয় সাইনবোর্ড ‘মধুর রেস্তোরা’। স্বাধীনতার আগে গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতার পরবর্তী স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ ছাত্রবান্ধব সব কর্মসূচির পরিকল্পনা হতো এই মধুর ক্যান্টিন ঘিরে। সময়ের পরিক্রমায় ‘ছাত্ররাজনীতির আঁতুড়ঘর’ খ্যাত সেই মধুর ক্যান্টিনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিয়ে কথা বলার পাশাপাশি ছাত্রনেতাদের পদচারণা অনেকটা হ্রাস পেয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে প্রাণ হারানো মধুদার ছেলে অরুণ দা ১৯৭২ সাল থেকে ছাত্রনেতাদের কার্যক্রম দেখে আসছিলেন। জানতে চাইলে বাংলানিউজকে তিনি বলেন, আগের ছাত্রনেতাদের সঙ্গে রাজনীতির বর্তমানের কোন কিছুই মিলবে না।

তখনকার সঙ্গে বর্তমানের দিনরাত তফাত। আগের কেন্দ্রীয় নেতারা সারাক্ষণ মধুতে থাকতেন। সকালে আসতেন, আবার বিকেলেও প্রোগ্রাম থাকলে আসতেন। রাতেও নেতাকর্মীদের সঙ্গে বসতেন। এখন সবারই কথা মধুতে কেন্দ্রীয় নেতারা কম আসেন।

একই ধরনের কথা বলছেন ‘বিতর্কমুক্ত’ ছাত্রলীগ আন্দোলনের মুখপাত্র রাকিব হোসেন। ২০১১ সালে ছাত্রলীগের সোহাগ-নাজমুল, ২০১৫ সালে সোহাগ-জাকির কমিটির নেতা ছিলেন। দুই কমিটির সঙ্গে বর্তমান ছাত্রলীগের তুলনা করে বাংলানিউজকে তিনি বলেন, বর্তমান সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক মধুতে আসেন মাঝে মাঝে। নেতাকর্মীদের যে সময় দেওয়ার কথা ছিল, তা হচ্ছে না। নির্বাহী সংসদের সঙ্গে সমন্বয় না থাকায় সংগঠনের কাঠামো ভেঙে পড়েছে। আগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকরা নিয়মিত বেলা ১১টা থেকে ১টা পর্যন্ত মধুর ক্যান্টিনে বসতেন। কর্মীদের সঙ্গে কথা বলতেন। এখন সেটা হয়ে গেছে নেতাদের বাসা কেন্দ্রিক।

সাম্প্রতিক বছরগুলোর কয়েকটি ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যাপক অংশগ্রহণের আন্দোলন ছিল কোটা সংস্কার আন্দোলন ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলন। এই দুই আন্দোলনের সূচনা কোনো ছাত্র সংগঠনের মধ্য থেকে শুরু হয়নি। গত বছরের ১৭ জুলাই ছাত্রলীগ আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে সংগঠনটির অতীত ভূমিকার কথা উল্লেখ রেখে কোটা সংস্কারের মতো একটি যৌক্তিক আন্দোলন ছাত্রলীগ কেন করলো না, সে প্রশ্ন রাখেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুন অর রশীদ। অন্যদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজধানীর সরকারি সাত কলেজের অন্তর্ভুক্তি ও সান্ধ্যকালীন কোর্স নিয়ে শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশের ক্ষোভ রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে আন্দোলন করলেও জুলাইয়ে একাডেমিক ভবনে তালা ঝুলিয়ে ক্লাস পরীক্ষা বর্জন করেন শিক্ষার্থীরা। সেসময় ডাকসু নেতারা আন্দোলন বন্ধ করার আহ্বান জানালেও শিক্ষার্থীরা সায় দেননি। এসব আন্দোলনের দানা বাঁধে মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারকে ঘিরে। মধুর ক্যান্টিন।  ছবি: শাকিল আহমেদবিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করা আল মাসুদ সজীব ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি মনে করেন সময়ের বিবর্তনে সব যৌক্তিক ও ন্যায্য আন্দোলনের তীর্থ কেন্দ্র মধুর ক্যান্টিনের পরিবর্তে এখন লাইব্রেরি থেকে শুরু হচ্ছে। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধসহ অসংখ্য আন্দোলনের সূতিকাগার মধুর ক্যান্টিন। ছাত্রদের সমস্যা নিয়ে কথা আসত এখান থেকেই। বর্তমানে রাজনীতি হয়ে গেছে ‘ভাই’ কেন্দ্রিক। এর ফলে নেতাদের কেউ রাষ্ট্র, সমাজ, ছাত্রদের সমস্যা নিয়ে ভাবার প্রয়োজন মনে করছেন না। সৃজনশীল চিন্তার পতন হচ্ছে। জ্ঞানচর্চার অভাবের কারণে নেতাদের বক্তব্য, ভাষণেও নতুনত্ব নেই। ফলে সাধারণ ছাত্রদের কাছে তারা পৌঁছাতে পারছেন না। সঙ্গত কারণেই লাইব্রেরি থেকে এখন ‘সাউন্ড’ হচ্ছে।

ছাত্র সংগঠনগুলোর মাঝে আদর্শগত বিরোধ থাকলেও আগে মধুর ক্যান্টিনে সহাবস্থান নিশ্চিত ছিল। সেসময় মধুদার স্মরণসভার জন্য সব ছাত্র সংগঠনের নেতাদের নিয়ে প্রোগ্রাম বাস্তবায়নের জন্য কমিটি গঠন করা হতো। যার মধ্য দিয়ে পরস্পরের মধ্যে সহিষ্ণুতা বিদ্যামান ছিল। এটি বন্ধ রয়েছে বছর তিনেকের মতো।  

ক্যাম্পাসে দীর্ঘদিন ধরে ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতি করে এ বছর বিদায় নেন লিটন নন্দী। মধুর ক্যান্টিনের আগের পরিবেশ না থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলানিউজকে তিনি বলেন, ক্যাম্পাসে যখন আসি তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল। মধুতে ছাত্রলীগ, ছাত্রদলসহ সব সংগঠনের সক্রিয় সহাবস্থান ছিল। স্টুডেন্টরাও সকালে আসতেন। শিক্ষকরাও আসতেন বিকেলে। এক ধরনের আড্ডা হতো। পরবর্তীতে নতুন সরকার আসার পর গণতান্ত্রিক চর্চার পথ সংকুচিত হয়। ডাকসু নির্বাচন ঘিরে ছাত্রদল আবার ফিরল। সবই সরব হচ্ছিল। দীর্ঘ এ সমেয় মধুর ক্যান্টিনের যে গুরুত্ব, সেটা হ্রাস পেয়েছে। মধুর ক্যান্টিন।  ছবি: শাকিল আহমেদমধুর ক্যান্টিনে এখন অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আগে আমরা দেখতাম ক্যান্টিনের বাইরে স্লোগান দিত, ভেতরে না। এখন দেখা যায়, স্লোগান দিতে দিতে ভেতরে চলে যায়, বসলে চেয়ার নিয়ে যায়। আমি মনে করি, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামসহ ছাত্ররাজনীতির ক্ষেত্রে মধুর ক্যান্টিনের একটা বিশাল অবদান আছে। সেক্ষেত্রে প্রতিটা সংগঠনকেই মধুর ক্যান্টিনের ঐতিহ্য ধরে রেখে সুস্থ ছাত্ররাজনীতি চর্চার মধ্য দিয়ে কীভাবে আরও প্রাণবন্ত করা যায়, সেজন্য ছাত্রলীগসহ সব সংগঠনের কেন্দ্রীয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতাদের একসঙ্গে বসতে হবে। সাধারণ ছাত্ররা যেন আসতে পারেন। আড্ডা দেন, এরকম একটা পরিবেশ তৈরি করতে হবে।

মধুর ক্যান্টিন ঘিরে নিজেদের কার্যক্রম নিয়ে মন্তব্যের জন্য ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীকে ফোন দেওয়া হলেও রিসিভ করা হয়নি।

ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, মধুর ক্যান্টিন আগের মতোই প্রাণচঞ্চল আছে। এখানে নতুন বিষয় যোগ হয়েছে, সাধারণ শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ। আগে রাজনৈতিক সংগঠনের লোকজন আসত, এখন সাধারণ শিক্ষার্থীরাও আসেন। আগে নেতারা মধুর ক্যান্টিনের গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকতেন। সেই রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন হয়েছে। ছাত্রনেতারা এখন বিভিন্ন বিভাগ, লাইব্রেরি, হলের ক্যান্টিনসহ সব জায়গায় যাতায়াত করেন। রাজনীতি যেখানে কেন্দ্রীভূত ছিল, তার চেয়ে বেশি বিকেন্দ্রীকরণ হয়েছে। ডাকসু সচল হওয়ার কারণে শিক্ষার্থীদের আনাগোনা বেড়েছে। মধুর ক্যান্টিনের ঐতিহ্যও বহাল আছে।

রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকাকালে বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলের অবস্থান ছিল সুসংহত। ১৯৮৭ সাল থেকে ৯০ সাল পর্যন্ত সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন ড. আসাদুজ্জামান রিপন। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, এখন আমি কোনো ছাত্ররাজনীতিই দেখি না। আমাদের সময় আমরা দুটো বিষয় করতাম। আমরা ছাত্ররাজনীতি করতাম না, ছাত্র আন্দোলন করতাম। স্টুডেন্ট মুভমেন্ট আর পলিটিক্স এক না। ছাত্ররা একটা রাষ্ট্র, সমাজে বসবাস করে। সেই সমাজের একটা অসঙ্গতি, সংকট বিরাজমান ইস্যুর ওপরে ছাত্ররা হয় ‘অ্যাক্ট’ করে না হয় ‘রিঅ্যাক্ট’ করে। যা কোরিয়া, পশ্চিমা, এশিয়ার অনেক দেশে আমরা দেখতে পাই। আমাদের দেশে ষাটের দশকে ছয় দফা, ১১ দফা কেন্দ্রিক, আর আমাদের সময়ে সামরিক শাসনের প্রেক্ষাপটে গণতন্ত্র আনার জন্যে আন্দোলন করেছি।

বর্তমান ছাত্রনেতারা ইস্যু ঠিক করতে পারে না উল্লেখ করে ছাত্রদলের সাবেক এ নেতা বলেন, সাধারণ ছাত্রদের সমস্যার সঙ্গে ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনের সংশ্লিষ্টতা না থাকায় পাশাপাশি চিন্তাভাবনার পার্থক্য থাকার কারণে ইস্যুগুলো নিয়ে তারা সামনে এগিয়ে যেতে পারে না। মূলত ছাত্রদের ইস্যু নিয়ে যারা কথা বলেন, তারাই জনপ্রিয়তা পান। ছাত্রসংগঠনগুলো এসব ইস্যু ঠিক করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণেই বর্তমান ছাত্র আন্দোলনের এ অবস্থা। আগের দিনে কৃষকের পাটের মূল্য কমে গেলেও ছাত্ররা আন্দোলন করতেন।

কয়েকদিন পরে সম্মেলন হবে, এরপরও ক্যাম্পাসে কোনো প্রভাব দেখা যায় না কেন- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, গণতান্ত্রিকভাবে আমরা কাউন্সিল করে ছাত্রদলের নতুন নেতৃত্বকে ক্যাম্পাস, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানমুখী করে দিতে চাই। দীর্ঘদিন ক্যাম্পাসের বাইরে অবস্থান করায় কাউন্সিলের প্রভাব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে না বলে তিনি মনে করেন।

বাংলাদেশ সময়: ০৮৪৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৮, ২০১৯
এসকেবি/টিএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।