ঢাকা, শনিবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

রাজনীতি

নৌকায় ভোট না দেয়ার অজুহাতে হামলা, অবরুদ্ধ শতাধিক পরিবার

স্বপন চন্দ্র দাস, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৩১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৯, ২০২১
নৌকায় ভোট না দেয়ার অজুহাতে হামলা, অবরুদ্ধ শতাধিক পরিবার

সিরাজগঞ্জ: একমাসেরও বেশি সময় ধরে শয্যাশায়ী ভ্যানচালক আয়নাল হক। মাথায় প্রচণ্ড আঘাত নিয়ে হাসপাতালে দীর্ঘদিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে বেঁচে ফিরলেও স্বাভাবিক হতে পারেননি তিনি।

স্ত্রী ও ছেলে-মেয়ের ভরণ পোষণ এবং তার চিকিৎসা চলছে অন্যের দয়ার ওপর। কথা বলতে না পারলেও ইশারায় তার করুণ অবস্থার কথাই বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন।

সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার সোনাখাড়া ইউনিয়নের হাজীপুর গ্রামে নির্বাচনী সহিংসতার স্বীকার আয়নালের মতো অনেকেই আঘাতের যন্ত্রণা নিয়ে কাতরাচ্ছেন। আবারও হামলার ভয়ে গ্রাম থেকে বের হচ্ছেন না তারা। অবরুদ্ধ অবস্থায় মানবেতর জীবনযাপন করছে আয়নাল হকের মতো প্রায় শতাধিক পরিবার।

সম্প্রতি সরেজমিনে হাজীপুর গ্রামে গেলে বাড়িঘর ভাঙচুরের এমন ভয়াবহ চিত্র দেখা যায়। সাংবাদিকের কথা শুনে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসে ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা। তারা অভিযোগ করেন, নৌকায় ভোট না দেয়ার অজুহাত তুলে আওয়ামী লীগের সভাপতি ও পুননির্বাচিত চেয়ারম্যান আবু হেনা মোস্তফা কামাল রিপনের নির্দেশে এসব হামলার ঘটনা ঘটেছে।  

ভুক্তভোগী, এলাকাবাসী ও আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সোনাখাড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু হেনা মোস্তফা কামাল রিপন ও সহ-সভাপতি সরোয়ার হোসেনের মধ্যে পূর্ব থেকে বিরোধ চলছিল। ১১ নভেম্বর ইউপি নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে আবু হেনা মোস্তফা কামাল রিপন পুননির্বাচিত হন। ৪ নম্বর ওয়ার্ডের (হাজীপুর) ইউপি সদস্য হিসেবে পুননির্বাচিত হন সরোয়ার হোসেন। এদিকে পূর্ব বিরোধের জের ধরে ভোটের দিন রাতে চেয়ারম্যান রিপন বাহিনী নৌকায় ভোট না দেওয়ার অজুহাত তুলে হাজীপুর গ্রামে সরোয়ার হোসেনের সমর্থকদের বাড়ি বাড়ি হামলা চালায়।

তারা প্রায় ৫-৭টি বসতবাড়ি, ভাঙচুর করে। এ হামলায় আহত হন ইউপি সদস্য সরোয়ার হোসেন, অ্যাডভোকেট লোকমান হাকিম, আয়নাল হক, রহমত আলী, রিয়াজ উদ্দিন, মালেক, মজিবরসহ অন্তত ১০ জন। একই সময়ে নিমগাছী বাজারে হাজিপুর গ্রামবাসীর দোকানে দোকানে হামলা ও লুটপাট চালানো হয়। হাজিপুর গ্রামবাসীর একটি পুকুরে জাল ফেলে জোরপূর্বক মাছও মেরে নেয় রিপন বাহিনী। এখানেই থামেনি সহিংসতা। নির্বাচনের প্রায় একমাস অতিবাহিত হলেও হাজীপুর গ্রামে শতাধিক পরিবার অবরুদ্ধ জীবনযাপন করছে।  

এ হামলার ঘটনায় আহত ৪ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম বাদী হয়ে ২৬ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত নামা আরও ১৫ জনের বিরুদ্ধে থানায় মামলা দায়ের করেন।  

মামলার বাদী জাহাঙ্গীর আলম বাংলানিউজকে বলেন, আমরা আমাদের সেন্টারে বিপুল ভোটে নৌকাকে বিজয়ী করেছি। এরপরও চেয়ারম্যান রিপন বাহিনী আমাদের গ্রামবাসীর ওপর হামলা চালিয়েছে যা পাকিস্তানিদের বর্বরতাকেও হার মানায়। আমার বসত-বাড়ি ও ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর চালানো হয়েছে।  

ছালমা খাতুন নামে আহত এক নারী বলেন, রাতের বেলায় রামদা, লাঠিসোটা নিয়ে হামলা চালায় রিপন চেয়ারম্যানের আত্মীয় স্বজন। তারা নারীদেরও শ্লীলতাহানি করে, বাড়িঘর, সব আসবাবপত্র ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছে।

নিমগাছি বাজারে পোল্ট্রি মুরগি ব্যবসায়ী আব্দুর রাজ্জাক বাংলানিউজকে বলেন, আমার সব মুরগি লুট করে নিয়ে গেছে, এখন আর দোকান চালু করতে দিচ্ছে না, রিপন চেয়ারম্যান বলছে ১০ হাজার টাকা দিতে হবে না হলে দোকান করতে দেবে না। একই বাজারে সুতার দোকানি আব্দুল কাইয়ুমও এক মাস ধরে দোকান খুলতে পারছেন না বলে জানান।  

সোনাখাড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও ইউপি সদস্য সরোয়ার হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, গত পাঁচ বছর আমি ইউপি সদস্য এবং আবু হেনা মোস্তফা কামাল রিপন চেয়ারম্যান ছিলেন, পাঁচটি বছর আমাকে আমার এলাকায় কোনো উন্নয়ন কাজ করতে দেননি। এবার নির্বাচনে আমার কেন্দ্রে নৌকাকে বিজয়ী করেছি, আমিও বিপুল ভোটে জিতেছি। কিন্তু রিপন চেয়ারম্যান তার বিএনপি-জামায়াতের আত্মীয় স্বজনদের দিয়ে আমার সমর্থকদের ওপর বর্বর হামলা চালিয়েছে। আবারও হামলার ভয়ে শতাধিক পরিবার একমাস ধরে অবরুদ্ধ রয়েছে।

সোনাখাড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রোকনুজ্জামান রোকনী বাংলানিউজকে বলেন, ন্যাক্কারজনক এ হামলার আমি তীব্র নিন্দা জানাই, আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী নির্বাচিত হয়ে আওয়ামী লীগ কর্মীদের ওপরে জামায়াত-বিএনপি দিয়ে হামলা চালাবে এটা মেনে নেওয়ার মতো না।  

সোনাখাড়া ইউপি চেয়ারম্যান আবু হেনা মোস্তফা কামাল রিপন বলেন, ওই গ্রামে আওয়ামী লীগ নামধারী কিছু মানুষ যারা নৌকার কাজ করে না কিন্তু আওয়ামী লীগের বড় বড় পোস্ট নিয়ে থাকে। ভোটের দিন চারটা সেন্টারে ঘোড়া মার্কা এগিয়ে থাকার খবর পেয়ে আওয়ামী লীগের কিছু লোকজন সন্ত্রাসীদের নিয়ে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের দুই নেতাকে মেরে রক্তাক্ত করে। এ কারণে পরবর্তীকালে কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটতে পারে। আমি আওয়ামী লীগের সভাপতি, সহ-সভাপতির সঙ্গে গ্যাঞ্জাম থাকার কথা না। এখানে যেটা হয়েছে সেটা বিদ্রোহী প্রার্থীর লোকজনের সঙ্গে।  

রায়গঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শহিদুল ইসলাম বাংলানিউজকে জানান, পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে কাজ করছে পুলিশ। কাউকে অবরুদ্ধ করা হলে বা হাট বাজারে যেতে বাধা দেয়া হলে, তার বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বাংলাদেশ সময়: ২০১৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৯, ২০২১
এনটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।