ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ আষাঢ় ১৪৩১, ২৮ জুন ২০২৪, ২০ জিলহজ ১৪৪৫

রাজনীতি

নির্বাচনের দুই মাসেও মেটেনি কোন্দল, মুখোমুখি চন্দ্রগঞ্জ আ.লীগ

মো. নিজাম উদ্দিন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৫৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০২২
নির্বাচনের দুই মাসেও মেটেনি কোন্দল, মুখোমুখি চন্দ্রগঞ্জ আ.লীগ

লক্ষ্মীপুর: লক্ষ্মীপুরের চন্দ্রগঞ্জ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের কোন্দল চরম আকার ধারণ করেছে। এর জের ধরে পাল্টা-পাল্টি কমিটি গঠন এবং সমাবেশ করেছে দু'পক্ষ।

একপক্ষ আরেক পক্ষের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষেও জড়িয়ে পড়েছে। পাল্টা-পাল্টি হামলা ও মামলার ঘটনাও ঘটেছে।  

জেলা এবং থানা নেতারা কোন্দল মেটানোর উদ্যোগ না নিয়ে বরং আগুনে ঘি ঢালছেন। এতে মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে উভয় পক্ষ।  

দু'পক্ষের এক পক্ষের নিয়ন্ত্রণে রয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি এম আলাউদ্দিন। অন্য পক্ষের সমর্থন পাচ্ছে বহিষ্কৃত ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যান নুরুল আমিন।  

একইসঙ্গে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগকে নিয়ে বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্ম দিয়েছেন সদর থানা আওয়ামী লীগের সম্মেলন কমিটির আহ্বায়ক আবুল কাশেম চৌধুরী। তিনি নিজেকে থানা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক দাবি করে নিজের অপছন্দের লোককে ইউনিয়ন কমিটি থেকে বহিষ্কার করে পছন্দের লোক নিচ্ছেন।   

এসব বিষয় নিয়ে চন্দ্রগঞ্জ এলাকায় চরম উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। যার সূত্রপাত হয়েছে গত দু'মাস আগে চতুর্থ ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে দলীয় মনোনয়ন ও বিদ্রোহী প্রার্থীকে নিয়ে। আবার চন্দ্রগঞ্জ বাজারের নিয়ন্ত্রণ নিয়েও দ্বন্দ্বেও জড়িয়ে পড়েছেন দলের নেতাকর্মীরা।  

দলীয় ও স্থানীয় সূত্র জানায়, গেল বছরের ২৮ ডিসেম্বর লক্ষ্মীপুরের চন্দ্রগঞ্জ ইউপি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে আওয়ামী লীগ থেকে নৌকা প্রতীকে মনোনয়ন দেওয়া হয় জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি এম আলাউদ্দিনের ছেলে আইনুল আহমেদ তানভীরকে। কিন্তু দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে বিদ্রোহী হিসেবে প্রার্থী হন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভপতি নুরুল আমিন। এ সময় তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। তবে দলের অধিকাংশ নেতা তার পক্ষে কাজ করায় তিনি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।  

নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতারা দু'ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েন। একপক্ষের নিয়ন্ত্রণ নেয় থানা ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক কাজী মামুনুর রশিদ বাবলু। প্রত্যক্ষভাবে তাকে সহযোগিতা করেন জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি এম আলাউদ্দিন। এ গ্রুপে রয়েছে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ ও সাবেক ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী।  

অন্য আরেকটি পক্ষের নিয়ন্ত্রণে রয়েছেন বহিষ্কৃত ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ইউপি চেয়ারম্যান নুরুল আমিন। ইউনিয়নের কয়েকজন আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের কয়েকজন নেতাকর্মী রয়েছেন তার দলে।  

১৫ জানুয়ারি রাতে দূর্বৃত্তের হাতে হামলার শিকার হন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা কাজী মামুনুর রশিদ বাবলু ও আরেক ছাত্রলীগ নেতা সাইফুল ইসলাম জিকু। এ হামলার জন্য ইউপি চেয়ারম্যান নুরুল আমিন ও তার সহযোগীদের দায়ী করে মামলা করে কাজী বাবলু।  

এদিকে বাবলুর বিরুদ্ধে নুরুল আমিন সমর্থিত আরেক ছাত্রলীগ নেতাকে মারধর করে গুরুতর আহত করার অভিযোগ করে চেয়ারম্যান নুরুল আমিন। ওই হামলা এবং পাল্টা হামলার ঘটনা নিয়ে ১৫ জানুয়ারি রাতেই চন্দ্রগঞ্জ বাজারে টান টান উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। পরদিন বিকেলে চন্দ্রগঞ্জে দু'পক্ষই প্রতিবাদ সমাবেশ ডাকে। এক পর্যায়ে উভয়পক্ষ মুখোমুখি অবস্থান নিলে পু্লিশি হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একপক্ষ আরেক পক্ষের চরিত্র হনন অব্যাহত রেখেছে।  

অন্যদিকে চলতি মাসের শুরুতে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি পদ নিয়ে টানাটানি শুরু হয়। পৃথকভাবে দু'পক্ষ দুইজনকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে ঘোষণা দেয়।  

থানা আওয়ামী লীগের সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক আবুল কাশেম চৌধুরী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি গিয়াস উদ্দিন লিটনকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে ঘোষণা দেন।  

একই কমিটির সহসভাপতি জয়নাল আবেদিন কাজলকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির সদস্য ছাবির আহমেদ।

এ নিয়ে শুরু হয় নতুন বিতর্ক। সেই বিতর্কের রেশ না যেতেই সাধারণ সম্পাদক পদ নিয়েও সৃষ্টি হয় আরেক বিতর্ক।  

শুক্রবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) আবুল কাশেম চৌধুরী ইউনিয়ন কমিটির সাধারণ সম্পাদক কাজী সোলায়মানকে অব্যাহতি দিয়ে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক গৌতম চন্দ্র মজুমদারকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ঘোষণা দেন। পৃথক আরেকটি প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে কাজী সোলাইমানসহ সদস্য জয়লান আবেদীনকে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে অব্যাহতি দেন তিনি। জয়লান আবেদীনকে পূর্বে আরেকটি পক্ষ ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ঘোষণা করেন।  

নাম না প্রকাশের শর্তে কয়েকজন নেতাকর্মী বলেন, আবুল কাশেম চৌধুরী থানা আওয়ামী লীগের সম্মেলন কমিটির আহ্বায়ক। তিনি নিজ থেকে কাউকে পদ দিতে পারেন না এবং অব্যাহতিও দিতে পারেননা। কিন্তু রহস্যজনক কারণে তিনি একক সিদ্ধান্তে পদ দিয়েছেন, আবার কাউকে অব্যাহতিও দিয়েছেন।  

এ বিষয়ে আবুল কাশেম চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, গঠনতন্ত্র মোতাবেক বাদ দেওয়া হয়েছে এবং পদে আনা হয়েছে। এখানে কোনো অনিয়ম হয়নি।  

সাধারণ নেতাকর্মীরা জানায়, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের পাল্টাপাল্টি কমিটি ঘোষণা ও অব্যাহতি দেওয়ার বিষয়টি এখন স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়েছে। যে যার ইচ্ছে মতো পদ দিচ্ছেন আবার নিয়ে যাচ্ছেন। ফলে বিষয়টি নিয়ে সাধারণ জনগণের মধ্যে হাস্যরসের সৃষ্টি হলেও দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে বাড়ছে তিক্ততা। যা রূপ নিতে পারে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে। এর জের ধরে শুক্রবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) রাতে উত্তপ্ত অবস্থা বিরাজ করছিলো চন্দ্রগঞ্জ বাজারে। দু'পক্ষই পাল্টা-পাল্টি সমাবেশ এবং বিক্ষোভ মিছিল করে। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে বাজার এলাকায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অবস্থানে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়ানো সম্ভব হয়েছে। তবে দুপক্ষের মুখোমুখি অবস্থানকে কেন্দ্র করে যেকোন সময় অপ্রতিকর ঘটনা ঘটতে পারে।

আইনশৃঙ্খলার বিষয়ে চন্দ্রগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মোসলেহ উদ্দিন বলেন, আমি এ থানায় নতুন এসেছি। শুক্রবারের ঘটনার পর দু'পক্ষকে থানায় ডেকে সর্তক করে দিয়েছি। ভবিষ্যতে তাদের কারণে যেন আইনশৃঙ্খলা অবনতি না হয়। কেউ বিশৃঙ্খলা করতে চাইলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।  

স্থানীয়রা জানান, ইউপি নির্বাচন কেন্দ্রীক বিরোধ দুই মাস পার হলেও শীর্ষ নেতাদের পক্ষ থেকে সমস্যা নিরসনে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। রাজনৈতিকভাবে ইউনিয়নটি গুরুত্ব বহন করে। জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি এম আলাউদ্দিনের বাড়ি এ ইউনিয়নে। এছাড়া পাশ্ববর্তী হাজিরপাড়া ইউনিয়নের বাসিন্দা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি গোলাম ফারুক পিংকুর। আবার সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি আবুল কাশেম চৌধুরীর বাড়িটিও পাশের ইউনিয়ন উত্তর জয়পুরে। এসব শীর্ষ নেতারা তাদের পছন্দের লোকদের নিয়ে ব্যস্ত থাকায় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে।

জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নুর উদ্দিন চৌধুরী নয়ন বাংলানিউজকে বলেন, সংকট নিরসনে অচিরেই সকল নেতাকর্মীদের নিয়ে বৈঠকে বসা হবে। আলোচনার মাধ্যমেই সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দেন তিনি।  

বাংলাদেশ সময় ১৪৫৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০২২
এসআইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।