ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

রাজনীতি

বঙ্গবন্ধু প্রেমিক এক দিনমজুরের গল্প

মো. নিজাম উদ্দিন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৫০ ঘণ্টা, মার্চ ১২, ২০২২
বঙ্গবন্ধু প্রেমিক এক দিনমজুরের গল্প ফয়েজ আহমেদ।

লক্ষ্মীপুর: রিকশাচালক ফয়েজ আহমেদ। জীবনের শুরু থেকেই রাজনীতি করতেন আওয়ামী লীগের।

তবে কোনো পদ, পদবী বা সুবিধা পাওয়ার জন্য রাজনীতি করেননি তিনি। বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসে আওয়ামী লীগ করেছেন এই ব্যক্তি।  

পরে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে ভালোবেসে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দলের জন্য কাজ করে গেছেন। এলাকায় প্রবীণ এবং নবীনদের কাছ তিনি পরিচিতি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে।  

মিছিল মিটিং থেকে শুরু করে যেকোনো দলীয় অনুষ্ঠানে থাকতেন সম্মুখভাগে। আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় জামায়াত-বিএনপির লোকজনের হাতে নির্যাতনের শিকারও হয়েছেন তিনি। দলের জন্য এই নিবেদিত কর্মী পুরো জীবনটাই পরিবার-পরিজন নিয়ে পার করেছেন দুঃখ-কষ্টে।  

হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে অর্থ সংকটে সুচিকিৎসার অভাবে ৮৫ বছর বয়সে মারা যান ফয়েজ আহমেদ। গত ৯ মার্চ রাত ২টার দিকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। তবে তার মৃত্যুর খবরে জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা ছুটে গেলেও জীবদ্দশায় কেউ খবর রাখেনি তার।  

ফয়েজ আহমেদের বাড়ি লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার লাহারকান্দি ইউনিয়নের কুমিদপুর গ্রামের পিয়ারাপুর বাজার এলাকায়। তিনি ওই ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সদস্য ছিলেন।

ত্যাগী এ নেতার মৃত্যুর খবর শুনে তার বাড়িতে শুক্রবার (১১ মার্চ) দুপুরে ছুটে যান বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও জাতীয় সংসদের হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন এমপি।  

দলীয় নেতা এবং স্থানীয়দের কাছ থেকে তার রাজনৈতিক জীবন এবং ত্যাগের কথা শুনে আবেগে আপ্লূত হন তিনি। তাৎক্ষণিক নিজ থেকে এবং দলীয় নেতাকর্মীদের কাছ থেক চাঁদা তুলে ফয়েজ আহমদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা করেন। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী কাছে তার পরিবারের জন্য সাহায্যের আবেদন করার কথা জানান।  

শনিবার (১২ মার্চ) দুপুরে ফয়েজ আহমদের বাড়িতে গিয়ে দেখা য়ায় তার পরিবারের সদস্যদের করুণ চিত্র। জরাজীর্ণ ছোট্ট একটি টিনের ঘরে বসবাস করতেন ফয়েজ আহমেদ ও তার বৃদ্ধ স্ত্রী নুর নাহার (৬০)। তাদের পাঁচ ছেলে এবং তিন মেয়ে। ছেলেদের মধ্যে কেউ দিনমজুর এবং কেউ সিএনজি অটোরিকশা চালক। ফয়েজ আহমদের মালিকানাধীন প্রায় সাত শতাংশ জমির ওপর তিনটি পৃথক ঘর তুলে আলাদাভাবে বসবাস করছেন তার পাঁচ ছেলে এবং তাদের সন্তানেরা।  

ফয়েজ আহমদের ভাতিজা ইব্রাহিম, শাহ আলম ও জহিরুল ইসলাম টিপু বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের চাচার পরিবারে প্রতিনিয়ত অভাব অনটন লেগেই থাকতো। ভাড়া করা রিকশা চালিয়ে যা আয় হতো তা দিয়ে কোনমতে সংসার চালানোর পাশাপাশি রাজনীতির পেছনেও ব্যয় করতেন। দলীয় কোনো সভা সমাবেশ নেতাদের সহযোগিতার দারস্থ না হয়ে নিজের রোজগারের টাকা খরচ করে লোকজনকে অনুষ্ঠানস্থলে নিয়ে যেতেন।  

ফয়েজ আহমদের বড় ছেলে ওসমান বাংলানিউজকে বলেন, আমার বাবা একজন দিনমজুর ছিলেন। ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি- উনি রিকশা চালিয়ে যা আয় করতেন তা দিয়ে আমাদের সংসার চলতো না। আমরা আট ভাই-বোন। অভাব অনটনের মধ্যে বড় হয়েছি। এরপরেও বাবা আয়ের একটা অংশ রাজনীতির পেছনে খরচ করতেন।  

ফয়েজ আহমদের স্ত্রী নুর নাহার বলেন, খুব দুঃখ কষ্টে সংসার চালিয়েছি। আমার স্বামী বেশিরভাগ সময় রাজনীতি নিয়ে চিন্তা করতেন। কিন্তু শেষ বয়সে এসে ওনার চিন্তা কেউ করেনি। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। টাকার অভাবে উন্নত চিকিৎসা করাতে পারিনি।  

ফয়েজ আহমদের পুত্রবধূ কুলছুম আক্তার বাংলানিউজকে বলেন, গত ৭ মার্চ আমার শ্বশুর অসুস্থ হয়ে যান। তাকে আমরা জেলা সদর হাসপাতালে ভর্তি করি। হাসপাতালের চিকিৎসকরা উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নেওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু ঢাকায় নিয়ে যাওয়া কিংবা সেখানে চিকিৎসা করানোর মতো পর্যাপ্ত টাকা না থাকায় সদর হাসপাতালে রেখে দিই। ৯ মার্চ রাত ২টার দিকে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ১০ মার্চ দুপুর ২টায় পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।  

ফয়েজ আহমদের ভাই মনির উদ্দিন বলেন, আমার ভাইকে শেষ বয়সে একটি মামলার আসামি হতে হয়েছে। প্রতিহিংসার জেরে জমি নিয়ে বিরোধকে কেন্দ্র করে প্রতিবেশী মুরাদ হোসেন সোহেল আদালতে আমার নামে এবং আমার ভাই ফয়েজ আহমদ ও ভাতিজা ইব্রাহিমসহ ছয়জনের নামে মামলা দায়ের করে। থানা পুলিশ ও ডিবি পুলিশের পক্ষ থেকে দুইবার তদন্ত প্রতিবেদনে আমাদের নির্দোষ উল্লেখ করে তদন্ত প্রতিবেদন দেয়। তারপরেও একজন আওয়ামী লীগের কর্মী হয়ে হয়রানিমূলক এ মামলার আসামি হয়ে আমার ভাইকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। যা অত্যন্ত দুঃখজনক।  

ফয়েজ আহমদের বাল্যবন্ধু কালা মিয়া বলেন, আমি এবং ফয়েজ একসঙ্গে রাজনীতি করেছি। আমাদের মধ্যে কোনো চাওয়া পাওয়া ছিল না। দলকে ভালোবেসে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত রাজনীতি করে যাবো।  

লাহারকান্দি ইউনিয়ন যুবলীগের আহ্বায়ক মো. তফসির আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, আমি ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি ফয়েজ আহমেদ আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে কাজ করে গেছেন। তৃণমূলের এ কর্মী শুধু দলের জন্য নিজের জীবনের সময় ব্যয় করেছেন। বিনিময়ে তিনি জীবনে কিছু পাননি। তার মৃত্যুতে আমরা গভীর শোকাহত। তার পরিবারের লোকজন অসহায়। দলের শীর্ষ নেতারা যেন পরিবারের সদস্যদের দিকে সুদৃষ্টি দেন।  

এদিকে শুক্রবার ফয়েজ আহমদের কবর জিয়ারত করতে গিয়ে আবেগে আপ্লূত হয়ে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও জাতীয় সংসদের হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন রাতে তাকে নিয়ে ফেসবুকে একটি মানবিক পোস্ট করেছেন। তাঁর লেখাটি হুবহু তুলে ধরা হলো।  

'প্রয়াত অবহেলিত তৃণমূলের ফয়েজ আহমেদ, একটি চাঁদাবাজি .........

আমরা লক্ষ্মীপুরে সাংগঠনিক সফরে। দুপুরে রামগতি উপজেলার শেখের কেল্লা এলাকায় অবস্থিত নবনির্মিত অসাধারণ স্থাপত্যশৈলী সম্পন্ন আস-সালাম জামে মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করতে যাই। পথিমধ্যে একটি সেতু পার হওয়ার সময় লক্ষ্মীপুর জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি গোলাম ফারুক পিংকু সাহেব জানালেন, এই এলাকার একজন রিকশাচালক আওয়ামী লীগের কর্মী ছিলেন, গত মঙ্গলবার মৃত্যুবরণ করেছেন।  

জনাব ফয়েজ আহমেদ পেশায় একজন রিকশাচালক ছিলেন। সারাদিন শরীরের বিন্দু বিন্দু ঘাম ঝড়িয়ে যেটুকু উপার্জন করতেন, তার একটি অংশ দিয়ে তিনি সন্ধ্যায় এলাকার লোকজনকে চা খাওয়াতেন এবং বঙ্গবন্ধু ও নেত্রীর গল্প শুনাতেন। মানুষকে সংগঠিত করতেন। নিজে রিকশা চালিয়ে অন্যদের আওয়ামী লীগের মিটিং নিয়ে যেতেন।  

তার স্বপ্ন ছিল, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার দেখে যেতে চান। তিনি বলতেন, তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার দেখেছেন, তার জীবনের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে।  

নামাজ শেষে প্রয়াত ফয়েজ আহমেদ সাহেবের কবর জেয়ারত করলাম। কবর জেয়ারতের আগেই জেলা নেতৃবৃন্দকে পরিবারের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী বরাবর একটি সাহায্যের দরখাস্ত দিতে বলেছিলাম।  

জেয়ারতের পর তার বাড়িতে যাওয়ার সময় হঠাৎই মনে হল, নেত্রী তো দেবেনই, আমরাও তো সামান্য পারি।  

লজ্জা ভেঙে চাঁদাবাজি করলাম। সফরে আছি, পকেট বেশি সমৃদ্ধ না। পকেট থেকে সামান্য ১০ হাজার টাকা বের করে, জেলা সভাপতি গোলাম ফারুক পিংকু এবং সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নুর উদ্দিন চৌধুরী নয়ন এমপির কাছে ১০ হাজার টাকা চাইলাম, লক্ষ্মীপুর পৌরসভার মেয়র মোজাম্মেল হায়দার মোল্লা মাসুমকে বললাম, আমাকে ২০ হাজার টাকা দাও। তারা তিন জন সঙ্গে সঙ্গে দিলেন। হয়ে গেল পঞ্চাশ হাজার।

প্রকাশ্য দিবালোকে গ্রামের মানুষ জনের সামনে চাঁদাবাজি করে সেই টাকা প্রয়াত ফয়েজ ভাইয়ের স্ত্রীর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।

চাঁদাবাজি ভালো কাজ নয়, জানি। এরপরও করেছি। আমার খুব ভাল লাগছে যে, আজ একটি ভালো কাজ করেছি। আইনের দৃষ্টিতে মন্দ কাজ, কিন্তু মানবিকতার দিক থেকে ভালো কাজ।  

নিজের ঢোল পেটানোও ভালো কাজ নয়। তবুও করলাম, হয়ত অনেকে হাসবেন, টিপ্পনী কাটবেন। তবুও একটি আহ্বান জানানোর জন্য প্রচার করছি।  

রাব্বুল আ'লামীন আমাদের যাদের কিছুটা সামর্থ্য দিয়েছেন, আসুন আমরা আওয়ামী লীগের প্রাণশক্তি তৃণমূলের কষ্টে থাকা সোনার মানুষদের পাশে যৌথভাবে সাধ্যমত দাঁড়াই। '

বাংলাদেশ সময়: ১৬৪২ ঘণ্টা, মার্চ ১২, ২০২২
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।