লালমনিরহাট: সরকার দলীয় শ্রমিক আন্দোলনের নামে লালমনিরহাটে আওয়ামী লীগের দু’গ্রুপের মধ্যে চলছে চরম উত্তেজনা। ফলে বড় ধরনের সংঘর্ষের আশঙ্কায় আতঙ্কিত জেলা শহরবাসী।
জেলা বাস-মিনিবাস শ্রমিক ইউনিয়নের মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি এবং সংগঠনটির নামে কেনা ৮ শতাংশ জমি গোপনে বিক্রি করাকে কেন্দ্র করে সরকার দলীয় শ্রমিকদের চলমান আন্দোলনে পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ছে জেলা আওয়ামী লীগের দু’গ্রুপ। ফলশ্রুতিতে জেলার রাজনৈতিক পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। যে কারণে বড় ধরনের সংঘর্ষের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
জানা গেছে, লালমনিরহাট জেলা বাস-মিনিবাস শ্রমিক ইউনিয়নের শ্রমিকদের সুরক্ষার নামে আদায় করা চাঁদার অর্থ আত্মসাৎ করার অভিযোগ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে সংগঠনে অসন্তোষ দেখা দেয়। সেই সঙ্গে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির সভাপতি আমিনুল ইসলাম ও সম্পাদক বুলবুল আহম্মেদ গোপনে সংগঠনের ৮ শতাংশ জমি বিক্রয় করায় ক্ষুব্ধ সাধারণ শ্রমিকরা। তাই মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি ভেঙে দেওয়া ও গোপনে জমি বিক্রির প্রতিবাদে গত ২০ মার্চ বিক্ষুব্ধ সাধারণ শ্রমিকরা সড়কে বিক্ষোভ করেন। এতেই শ্রমিক আন্দোলনের সূচনা ঘটে।
ওইদিন রাতে সংগঠনটির মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির নেতারা পাল্টা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে টার্মিনাল এলাকায় জেলা মোটর মালিক সমিতির সম্পাদক ও জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি সিরাজুল হকের বিনিময় ফিলিং স্টেশনে হামলা ও ভাঙচুর চালায়। সে সময় পুলিশের হস্তক্ষেপে পরিবেশ শান্ত হয়। এ ঘটনায় ফিলিং স্টেশনটির ম্যানেজার আনোয়ারুল ইসলাম দুলু বাদী হয়ে জেলা ট্রাক মালিক সমিতির সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন সুমন খানসহ ২১ জনের নামে লালমনিরহাট সদর থানায় একটি মামলা দায়ের করেন।
নিজ ফিলিং স্টেশনে হামলা হওয়ায় সাধারণ শ্রমিকদের আন্দোলনে সমর্থন দেন জেলা মোটর মালিক সমিতির সম্পাদক ও জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি সিরাজুল হক। যিনি জেলা আওয়ামী লীগের দু’টি গ্রুপের একাংশের নেতৃত্ব দেন। তার গ্রুপে রয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক গোলাম মোস্তফা স্বপন ও পৌরসভার মেয়র রেজাউল করিম স্বপন।
ফলে জেলা আওয়ামী লীগের অপর গ্রুপটি শ্রমিক সংগঠনের বর্তমান কমিটির পক্ষে অবস্থান নেয়। কারণ শ্রমিক আন্দোলনের মামলার অন্যতম বিবাদী সাখাওয়াত হোসেন সুমন খান জেলা আওয়ামী লীগের সম্পাদক অ্যাডভোকেট মতিয়ার রহমানের আশির্বাদপুষ্ট শ্রমিক নেতা। এভাবেই শ্রমিক আন্দোলনে দু’পক্ষে জড়িয়ে পড়ে জেলা আওয়ামী লীগের দুইটি গ্রুপ। ফলে জেলা শহরজুড়ে উত্তেজনা আর আতঙ্ক কয়েকগুণ বেড়ে গেছে বলে স্থানীয়দের দাবি।
সাখাওয়াত হোসেন সুমন খান জেলাজুড়ে আলোচিত একটি নাম। যিনি ছাত্র অবস্থায় ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকলেও ২০০২-০৫ পর্যন্ত বিএনপিতে যোগ দিয়ে দলীয় প্রভাব খাটিয়ে চোরাচালান ও হুন্ডি ব্যবসার মাধ্যমে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন। পরিচিত হন হুন্ডি সুমন নামে। পরে সরকার পরিবর্তন হলে তিনি পুনরায় আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে দলীয় প্রভাব কাজে লাগিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য, ঠিকাদারি, হুন্ডি ও চোরাচালানির মাধ্যমে আলিশান বাড়ি-গাড়ির মালিক হয়েছেন। গড়ে তুলেছেন ব্যক্তিগত ক্যাডার বাহিনী। তাই নিজেদের অবস্থান ঠিক রাখতে দলীয় শীর্ষ নেতারা তাকে প্রশাসনিক সহায়তা দিয়ে থাকেন বলে অভিযোগ আছে।
জেলা আওয়ামী লীগের সম্পাদক অ্যাডভোকেট মতিয়ার রহমানের ‘ডান হাত’ খ্যাত সুমন খানকে জেলা কমিটির পদ দিতে গত বছরের জুন মাসে ৩ নম্বর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদে প্রস্তাব করা হয়। পরে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সম্পাদক স্বাক্ষরিত ৭৫ সদস্য বিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ কমিটি কেন্দ্রে পাঠানো হয়। কিন্তু সন্ত্রাস, টেন্ডারবাজি, মাদক ও হুন্ডি ব্যবসা, হত্যা মামলা ও বিভিন্ন অভিযোগে প্রস্তাবিত কমিটি থেকে সাখাওয়াত হোসেন সুমন খানকে বাদ দিয়ে ৭৪ সদস্যের চূড়ান্ত কমিটি অনুমোদন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরে জেলা আওয়ামী লীগ আবারও তার নাম প্রস্তাব করে কেন্দ্রে পাঠালে এখন পর্যন্ত কোনো নির্দেশনা না এলেও নিজেকে যুগ্ম সম্পাদক দাবি করেন সুমন খান। এ কমিটি নিয়েও ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়ায় জেলা শহরে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি হয়েছিল।
এভাবে দলীয় প্রভাব খাটিয়ে তার গ্রুপের শীর্ষ নেতাদের সন্তুষ্ট রাখতে বিভিন্ন সময় জেলার পরিবেশ অস্থিতিশীল করেন সুমন খান। তার বিরুদ্ধে গত ১০-১২ বছরে হত্যা, চোরাচালান, মারামারি আর মাদকের প্রায় ডজনখানেক মামলা রয়েছে। কিন্তু সরকার দলীয় শীর্ষ নেতার আশির্বাদ থাকায় তিনি দেদারছে ঘুরছেন। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কয়েক দফায় ব্যবস্থার প্রস্তুতি নিলেও তিনি গ্রেফতার হননি।
শ্রমিকদের দু’গ্রুপে সরকারি দলের শীর্ষপদের দু’টি গ্রুপ সম্পৃক্ত হওয়ায় গত সপ্তাহজুড়ে উত্তপ্ত পরিস্থিতি ছিল। দু’পক্ষই পাল্টা-পাল্টি মিছিল ও সংঘর্ষে জড়িয়ে শহরে আতঙ্ক তৈরি করে। দু’টি গ্রুপের পাল্টা-পাল্টি মামলা নিয়েও চরম জটিলতায় পড়েছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।
সম্প্রতি সুমন খানের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ায় লালমনিরহাট সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহ আলমকে প্রত্যাহারের দাবি তুলে স্মারকলিপি দিয়েছেন তার গ্রুপের নেতাকর্মীরা। জেলার পরিবেশ শান্ত করতে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ ও সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের হস্তক্ষেপ কামনা করছেন সাধারণ মানুষ।
সাধারণ শ্রমিকদের দাবি, মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি বিলুপ্ত ও গোপনে জমি বিক্রির প্রতিবাদে তারা শান্তিপূর্ণ মিছিল করেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে জেলার ত্রাস সাখাওয়াত হোসেন সুমন খান তার বাহিনী দিয়ে একটি পাম্পসহ চারটি কাউন্টারে হামলা ও ভাঙচুর চালান।
প্রবীণ রাজনীতিবিদদের দাবি, দু’চারজন দুষ্টু লোকের জন্য দলের সুনাম ও জেলাবাসীর শান্তি নষ্ট করা উচিত নয়। যারা কালো টাকা সাদা করতে আর নিজের অপকর্ম ঢাকতে দলে ভিড়তে চান, তাদের বিতাড়িত করা দরকার। এরা বসন্তের কোকিল। দলের আদর্শ তাদের ভেতরে থাকে না।
জেলার শান্তি ফেরাতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও কঠোর হওয়ার আহ্বানও জানান প্রবীণ নেতারা।
সদর থানার ওসি শাহ আলম বাংলানিউজকে বলেন, সাখাওয়াত হোসেন সুমন খানের বিরুদ্ধে বেশ কিছু মামলা রয়েছে। শ্রমিকদের চলমান দ্বন্দ্বের বিষয়টি কঠোরভাবে নজরদারি করা হচ্ছে। শহরের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুলিশের নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে।
জেলা মোটর মালিক সমিতির সম্পাদক ও জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি সিরাজুল হক বাংলানিউজকে বলেন, সন্ত্রাসীরা আমার ব্যক্তিগত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট করেছে। তাই প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার আনোয়ারুল ইসলাম দুলু বাদী হয়ে মামলা করেছেন। এটা ব্যবসায়ীক বিষয়, তাই ব্যক্তিগতভাবে আইনের সহায়তা নিয়েছি।
এ ব্যাপারে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মতিয়ার রহমান বাংলানিউজকে বলেন, সাখাওয়াত হোসেন সুমন খান আমার ডান হাত খ্যাত কথাটি সত্য নয়। তবে, আমরা তাকে জেলা আওয়ামী লীগের মিটিংয়ের মাধ্যমে কমিটিতে নিয়েছি। সুমন খান ৩ নম্বর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক।
এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত জানার জন্য প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আমি মোবাইলে ইন্টারভিউ দিই না। এরপর তিনি ফোন রেখে দেন।
বাংলাদেশ সময়: ২১১৫ ঘণ্টা, মার্চ ৩১, ২০২২
এসআরএস