ঢাকা: খুলনা ১হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ নিয়ে প্রশাসন ও স্থানীয়রা মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে। আরেকটি আড়িয়ল বিলের ক্ষেত্র তৈরি হতে পারে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্টরা।
সরেজমিন ঘুরে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছে এলাকাবাসী। জাতীয় রাজনীতির মাঠ গরম হয়ে উঠলে বড় প্রতিরোধের মুখে পড়তে পারে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির নির্মাণ কাজ।
ভূমি অধিগ্রহণ নিয়েও রয়েছে স্থানীয়দের বিস্তর অভিযোগ। তারা বলেছেন বাগেরহাটের ডিসি সৎ হলেও এডিসি(রাজস্ব)ওবায়দুর রহমান অসৎ ব্যক্তি। তাকে ঘুষ না দিলে টাকা ছাড় করা হচ্ছে না। নির্ধারিত কমিশন বুঝে দিলে তবেই মিলছে ভূমি অধিগ্রহণের টাকা।
এডিসির এই স্বেচ্ছাচারিতার কারণে এখনও প্রায় ৬’শ একর জমির টাকা উত্তোলন করেনি। অনেক জমির পূর্বের মালিককে টাকা দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে মালিকানা নিয়ে মামলা বিচারাধীন রয়েছে এ ধরনের জমির বিপরীতে চেক ইস্যু করা হয়েছে। এ কারণে ক্ষোভে ফুঁসছে স্থানীয়রা।
বড় দূর্গাপুর গ্রামের রবিউল ইসলাম দাবি করেছেন তার মায়ের বাড়ির ক্ষতিপুরণের টাকা তুলতে ১০ শতাংশ ঘুষ দিতে বাধ্য হয়েছেন। তার নিজের জমির বিষয়ে টাকা ঘুষ না দেওয়ার কারণে চেক ইস্যু করা হচ্ছে না।
রবিউল ইসলাম আরও জানান, “ঘুষের বিনিময়ে এক জনের জমির টাকা অন্যজনকে দেওয়া হচ্ছে। এমন অনেককে টাকা দেওয়া হয়েছে যারা তাদের জমি অনেক আগেই বিক্রি করে গেছেন। ”
তার নিজের জমির টাকাও অন্যকে দেওয়ার জন্য কাগজ জমা নেওয়া হয়েছে। তিনি অভিযোগ দিয়েছেন। তারপরও কি হবে বুঝতে পারছেন না।
বর্নি গ্রামের মইনুল হক বাংলানিউজকে জানান, তার ২৩.২৭ একর জমির বিপরীতে ৭৬ লাখ টাকা কাদের খোলা গ্রামের আনোয়ার বেগমকে দেওয়ার সব প্রক্রিয়া শেষের পরে তিনি জানতে পারেন। পরে ডিসির কাছে গেলে শেষ পর্যন্ত তিনি আটকাতে পেরেছেন।
বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ হবে সেই বড়দূর্গাপুর গ্রাম পার্শ্ববতী গ্রাম শাপমারি, বাশেরহুলাসহ পার্শ্ববতী গ্রামের লোকজনের অবস্থান বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির বিপক্ষে। কেন চায়না এ নিয়ে একেক জন একেক ধরনের মত প্রকাশ করেছে।
কেউ বলেছেন এখানে এতবড় কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র হলে এলাকার পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাবে। পশুর নদীর পানি লবনাক্ত হওয়ায় ব্যবহার করতে পারবেনা। মাটির নিচ থেকে তোলা হবে পানি। এতে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়াসহ নানারকম মত। অনেক ক্ষেত্রে অপপ্রচারও ছড়িয়ে পড়ে বলে জানা গেছে।
এদিকে জমি অধিগ্রহণের টাকা পরিশোধ না হলেও বাধ দিয়ে সীমানা তৈরি করা হয়েছে। জমির প্রকৃত মালিকদের জমিতে যেতে দিচ্ছেনা আনসার বাহিনীর সদস্যরা। অন্যদিকে বিশাল এই এলাকা আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা চিংড়ি ঘের হিসেবে ব্যবহার করছে। এতে করে ক্ষোভ বাড়ছে সাধারণ মানুষের মধ্যে।
বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত হাইকোর্টে তিনটি রিট দাখিল হয়েছে বলে জানিয়েছেন কৃষি জমি রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি সুশান্ত কুমার দাস। তিনি বাংলানউজকে জানান, “ যারা টাকা তুলছে না তাদের হুমকি ধামকি দিচ্ছে প্রশাসনের লোকজন। ”
সুশান্ত দাস দাবি করেন, গত বছরের ১২ ডিসেম্বর প্রথম রিটটি দাখিল করে সেন্টার ফর হিউম্যান রাইটস কমিশন। তিনি দাবি করেন সরকার তাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। অ্যাটর্নি জেনারেল সময় চেয়ে নেন।
তিনি জানান, “ ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী সফরে আসার আগে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে হাইকোটে গেলে অ্যাটর্নি জেনারেল কোর্টে বলেন, যেহেতু বিদ্যুতের প্রয়োজন। চুক্তি না হলে দেশের ক্ষতি হবে। আমরা সুন্দরবনের ক্ষতি হলে আমরা অন্যত্র বিদ্যুৎ কেন্দ্র করব। চুক্তি করতে দেওয়া হোক। পরে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। ”
তখন বিচারপতি সামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক উভয় পক্ষকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বসে ফয়সালা করতে বলেছিলেন। কিন্তু এরপর আর অ্যাটর্নি জেনারেল আগ্রহ দেখাননি। এরমধ্যে ৩৩২ বার শুনানির তারিখ নির্ধারণ হলেও তিনি আর হাজির হননি।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ এবং ভারত সরকারের যৌথ উদ্যোগের খুলনা ১৩২০ মেগাওয়াট এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ১হাজার ৮৩৪ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। প্রথম ইউনিট নির্মাণ কাজ শেষ হলে সেখানে সমান ক্ষমতার আরেকটি ইউনিট স্থাপন করা হবে। এতে মোট বিনিয়োগের প্রয়োজন পড়বে প্রায় ১দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার।
কয়লার বর্তমান দর অনুযায়ী প্রায় ৫ টাকার ওপরে পড়বে এই কেন্দ্রের বিদ্যুতের দাম। সব বিদ্যুৎ কিনবে বাংলাদেশ সরকার।
আমদানি নির্ভর কয়লা দিয়ে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালনা করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এর জন্য অষ্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ইন্দোনেশিয়ার কয়লা বিবেচনা করা হচ্ছে।
অধিগ্রহণকৃত জমির মূল্য বাবদ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৬২ কোটি ৪৫ লাখ ৮০ হাজার ২২৬ টাকা। অধিগ্রহণকৃত জমির মালিকের সংখ্যা রয়েছে ৩ হাজার ৪৮ জন। নভেম্বর পর্যন্ত ৬৪২ টি চেকের মাধ্যমে ২ হাজার জনকে ৪০ কোটি ৫১ লাখ ৫৫ হাজার ৬৩৫ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে।
বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পেট্রোবাংলার সাবেক এক পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলানিউজকে জানান, “ এখানে ক্ষতি কারক তেমন কিছু নেই। যা রয়েছে বেশিরভাগই গুজব। তবে সরকারের উচিত হবে পরিবেশগত যে সমীক্ষা হয়েছে তা ব্যাপকভাবে প্রচারের উদ্যোগ নেওয়া। ”
আর সরকার যদি তা করতে ব্যর্থ হয় বা বিষয়টি গোপন রাখার চেষ্টা করে তাহলে নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে বলে তিনিও আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৩০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর, ২০১২
ইএস./সম্পাদনা: নূরনবী সিদ্দিক সুইন, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর [email protected]