ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি

আল্লাহর দোহাই, লাইট কমান

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৪৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২২, ২০১৫
আল্লাহর দোহাই, লাইট কমান

ঢাকা: আল্লাহর দোহাই, লাইট কমান। দেখলে মনে হয় বিয়ে বাড়ি।

এভাবে অপচয় করবেন না। বৃহস্পতিবার (২২ জানুয়ারি) বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ওপর গণশুনানিতে সিএনজি ফিলিং স্টেশন মালিকদের প্রতি এ আহবান জানান বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) চেয়ারম্যান এআর খান।

রাজধানীর কারওয়ানবাজারে অবস্থিত টিসিবি ভবনে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির বিষয়ে পর্যায়ক্রমে এ গণশুনানি গ্রহণ করছে বিইআরসি। বিভিন্ন কোম্পানি ও সংস্থার দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবের ওপর সুপারিশ করছে বিইআরসি’র কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি।

সিএনজি ফিলিং স্টেশনের মালিক একে আলমগীর খান গণশুনানিতে অংশ নিয়ে বলেন, বিদ্যুতের দাম বাড়ালে ব্যয় বেড়ে যায়। কিন্তু তাদের কমিশন বাড়ছে না। এ কারণে দাম না বাড়ানোর অনুরোধের জবাবে বিইআরসি’র চেয়ারম্যান এ আহবান জানান।

শুনানিতে ক্যাবের জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. শামসুল আলম বলেন, একমাত্র কমিশন ছাড়া আমাদের ভোক্তাদের দেখার কেউ নেই। দয়া করে আপনারা একটু দেখেন।

তিনি বলেন, বিদ্যুতের দাম সামান্য বাড়লে প্রভাব অনেক বেশি পড়ে। বাড়ির মালিক দ্বিগুণ বিল আদায় করেন। সব পণ্যের দাম বেড়ে যায়। এমনকি বাস ভাড়া পর্যন্ত বেড়ে যায়।

তিনি বলেন, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) হিসেবে দেখা গেছে, পাইকারি বিদ্যুতের দাম না বাড়ালে তাদের ১ হাজার ১৭ কোটি টাকা লোকসান হবে (২০১৪-১৫ অর্থবছরে)। তারা এটাও বলেছে, তেলের দর বেশি পড়ায় বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বেশি পড়ছে।

অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম ৭০ শতাংশ কমে গেছে। সে কারণে বিপিসি (বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন) অনেক মুনাফা করছে। হয় তেলের দাম কমানো হোক, না হয় তেলের টাকা এনে বিদ্যুতে ভর্তুকি দেওয়া হোক।

শামসুল আলম বলেন, বুধবার (২১ জানুয়ারি) গণশুনানিতে ওয়েস্টজোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ওজোপাডিকো) বলেছে, পাইকারি বিদ্যুতের দাম বাড়ানো না হলে তাদের দাম বাড়ানোর প্রয়োজন নেই।

ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) হিসেবে দেখা গেছে, পাইকারি দাম না বাড়লে তারা মুনাফায় থাকবে। অতএব, বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে মানুষের ভোগান্তি বাড়াবেন না। অহেতুক পরিস্থিতিকে আর উস্কে দেবেন না।

বিইআরসি’র চেয়ারম্যান এর জবাবে বলেন, অধ্যাপক শামসুল আলম আপনার আবেগকে স্বাগত জানাই।

ডিপিডিসি’র গণশুনানিতে কমিশনের কারিগরি মূল্যায়ন কমিটিকে হিসেবের বেড়াজালে আটকে দেন শামসুল আলম। তিনি বলেন, দেখেন, আপনারা নিশ্চয়ই আমার সঙ্গে একমত হবেন যে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রয়োজন নেই।

কারিগরি কমিটির আহবায়ক পরিচালক (বিদ্যুৎ) মোস্তাক আহমেদ কোনো উত্তর দিতে পারছিলেন না। একইভাবে ডিপিডিসি’র কর্তাদেরও প্রশ্নবানে জর্জরিত করে একই অবস্থায় নিয়ে যান শামসুল আলম।

এ সময় বিইআরসি’র চেয়ারম্যান মুচকি হেসে বলেন, আপনি ধাওয়া করে নদীর তীরে নিয়ে স্বীকারোক্তি আদায় করছেন। এ কথা শুনে অন্যরা হাসিতে ফেটে পড়েন।
গণশুনানির প্রথম দিন ২০ জানুয়ারি থেকেই সোচ্চার অধ্যাপক শামসুল আলম। তিনি টেকনিক্যাল প্রশ্ন তুলে ঘাম ঝরিয়ে ছাড়ছেন কর্মকর্তাদের। অন্যরা সকলেই তা উপভোগ করেন। খোদ বিইআরসি’র চেয়ারম্যান মন্তব্য করেন, ‘শামসুল আলম সবার বিবেক, সবার মুখপত্র’।

পিডিবি’র পাইকারি বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির আলোচনায় শামসুল আলম বলেন, সরকার জনগণকে বোঝাচ্ছে, তারা বিদ্যুতে ভর্তুকি দিচ্ছে। কিন্তু আজকে দেখলাম, তারা এ পর্যন্ত কোনো ভর্তুকি দেয়নি। যা দিয়েছে সবই ৩ শতাংশ হারে ঋণ। বিইআরসি বলার পরও সরকার মানছে না। কার এতো বড় সাহস! কমিশন নির্দেশ দিক, না হলে ক্যাব হাইকোর্টে রিট করবে।

এ প্রসঙ্গে কমিশনের সদস্য সেলিম মাহমুদ বলেন, বিষয়টি আমাদের নজরের বাইরে নয়। বিষয়টি দেখা হবে।

পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন ঠিকমতো বিদ্যুৎ বিল দিচ্ছে না। রাজনৈতিক চাপের কারণে তারাও বিল আদায় করতে পারছেন না- গনশুনানিতে এমন অভিযোগ তোলে বিতরণ কোম্পানিগুলো।

জবাবে সেলিম মাহমুদ বলেন, আপনারা চাইলে কমিশনে অভিযোগ দিতে পারেন। কমিশন তাদের নোটিশ করে ব্যবস্থা নেবে। পৌর মেয়রদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার এখতিয়ার কমিশনের রয়েছে।

কমিশনের সদস্য প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন বলেন, আপনারা ঠিকাদারের বিল ঠিকই দেন। কিন্তু পিডিবিকে বিদ্যুতের বিল এবং পিজিসিবিকে হুইলিং চার্জ দিতে গড়িমসি করেন কেন? জবাবে আমতা আমতা করে উত্তর দেন ডিপিডিসি’র লোকজন। এ সময় নিয়মিত বিল পরিশোধ করার নির্দেশ দেন তিনি।

মঙ্গলবার (২০ জানুয়ারি) শুরু হওয়া গণশুনানিতে ঘুরে ফিরে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ নিয়ে আলোচনা উঠছে। আর আলোচনা পর্বে বারবার একটি প্রসঙ্গ উঠছে তা হচ্ছে, ২০১৪ সালে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সময় যুক্তি দেওয়া হয়েছিল, তেলের দাম বেড়েছে তাই বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। আর সঙ্গত কারণে দাম বাড়ানো প্রয়োজন। সেই যুক্তিতে দাম বাড়ানো হয়েছে।

তখন অপরিশোধিত প্রতি ব্যারেল তেলের মূল্য ছিল ১২৩ ইউএস ডলার। আর এখন দাম কমে ৪৭ ডলারের এসেছে। তাহলে বিদ্যুতের দাম না কমিয়ে কেন বাড়ানো হচ্ছে? এ সময়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কোনো যৌক্তিকতা নেই।

একজন নিজেকে ভুক্তভোগী উল্লেখ করে বলেন, ভোক্তার পাশাপাশি ভুক্তভোগী শ্রেণিও রয়েছেন। তাদের কথাও চিন্তা করতে হবে কমিশনকে। তিনি বলেন, আমি ভাড়া বাসায় থাকি। আমার বাসার মালিক প্রতি মাসে দেড় হাজার টাকা বিদ্যুৎ বিল দিতে বাধ্য করেন। কথা বলতে গেলে বলেন, আমি ক্যাচাল পছন্দ করি না। আপনার না পোষালে আপনি বাসা ছেড়ে দেন। আপনার সঙ্গে ক্যাচাল করার ইচ্ছে নেই। বিদ্যুতের মূল্য বাড়লে তিনি তার ইচ্ছা মতো বাড়াবেন। না মানলে বাসা ছাড়তে হবে।

এ বিষয়ে ডিপিডিসি’র দৃষ্টি আকর্ষণ করে কমিশন। ডিপিডিসি’র এমডি নজরুল হাসান বলেন, প্রত্যেক গ্রাহকের আলাদা মিটার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। যদি না পান আমাদের অফিসে যোগাযোগ করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

গত ২০ জানুয়ারি গণশুনানি শুরু করে বিইআরসি। প্রথম দিনে বিপিডিবির পাইকারি বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবের ওপর এবং দ্বিতীয় দিন বুধবার (২১ জানুয়ারি) পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) ও ওয়েস্ট-জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ওজোপাডিকো) মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাবের ওপর গণশুনানি গ্রহণ করা হয়।
 
২৫ জানুয়ারি শেষ দিনে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি)ও ঢাকা ইলেক্ট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানির (ডেসকো) প্রস্তাবের ওপর গণশুনানি গ্রহণ করা হবে।

বাংলাদেশ সময়: ২১৩৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২২, ২০১৫

** পিডিবি’র বিদ্যুতের মূল্য ৩.০৯ শতাংশ বৃদ্ধির সুপারিশ
** বিদ্যুতের দাম ২২.৪৫ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব বিপিডিবির
** বিদ্যুতের দাম ১৭.৮৫ শতাংশ বাড়াতে চায় ডিপিডিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।