ঢাকা, শনিবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি

ভূতের উল্টোপায়ে হাঁটছে বাপেক্স!

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭২৯ ঘণ্টা, আগস্ট ২৬, ২০১৫
ভূতের উল্টোপায়ে হাঁটছে বাপেক্স!

ঢাকা: ভূত না-কি উল্টো দিকে চলে। ভূতের উল্টো পা।

ভূত সেতো অবাস্তব, উল্টো চলাও স্রেফ কল্পনা কিন্তু  বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন এন্ড প্রোডাকশন কোম্পানি (বাপেক্স)-এ সত্যিই মিলেছে সেই ভুতের দেখা। ভূতের মতোই উল্টো দিকে চলছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এই প্রতিষ্ঠান।

রাষ্ট্রের একমাত্র তেল-গ্যাস অনুসন্ধ্যান ও উত্তোলনকারি বাপেক্স নিয়ে তাই সংশ্লিষ্ট মহলে এখন ভুতেই গল্পই বেশ চলছে।

গল্পের উৎস শ্রীকাইলে কূপ। এটি বাপেক্সের নিজস্ব গ্যাস ক্ষেত্র। কথা ছিলো নিজেই এই ক্ষেত্রের গ্যাস উত্তোলন করবে। সে অনুযায়ী ৬৪ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি)ও  অনুমোদন নেয় বাপেক্স। এরপর কাজও এগিয়ে চলে। খননের জন্য রিগ নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতিও সম্পন্ন হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘটা করে এই গ্যাসক্ষেত্রের উদ্বোধন করেন। কিন্তু হঠাৎই ভূতের মতো উল্টো হাঁটতে শুরু করলো প্রতিষ্ঠানটি। নিজেরা না করে কাজটি তুলে দিলো রুশ প্রতিষ্ঠান গাজপ্রমকে। শুধু তাই নয়। প্রকল্প বাজেট প্রাথমিক অনুমোদনের চেয়ে বেড়ে গেলো তিন গুনেরও বেশি অংকে।

দায়িত্বশীল সূত্র জানায় বাপেক্স নিজে সম্পন্ন করার জন্য যে ব্যয় ধরা হয় ৬৪ কোটি টাকা তা ২’শ কোটি টাকা হয়ে যায় গাজপ্রমকে দেওয়ার পর। আর সে অর্থও নেওয়া হচ্ছে ‌ঋণ হিসেবে। যা সুদসমেত পরিশোধ করতে হবে বাপেক্সকেই।

গল্পটা এখানেও শেষ হলো না। ভূতের আছর পড়ার মতো বেঘোরে বাপেক্স নিয়ে চলেছে আরও কিছু অদ্ভুতুরে উদ্যোগ। তার অন্যতম হচ্ছে- যে শ্রিকাইল ছেড়ে দিলো গাজপ্রমকে তারই মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে বাঙ্গুরা গ্যাস ফিল্ডে ৬ ও ৭ নম্বর কূপ খননের কাজ নিয়ে নিলো বাপেক্স। অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে ওই ফিল্ডে কাজ শুরু করারও পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে ফেলেছে সরকারি এই সংস্থাটি।

বাঙ্গুরা সিঙ্গাপুরভিত্তিক বহুজাতিক তেল গ্যাস কোম্পানি ক্রিস এনার্জির মালিকানার গ্যাসক্ষেত্র।  

অবাক করা তথ্য হচ্ছে, এই প্রথম বাপেক্স কোন বিদেশি কোম্পানির গ্যাস কূপ খননের কাজ করতে যাচ্ছে। সে নিয়ে বাপেক্সে আনন্দেরও সীমা নেই। বড় কোনও অর্জন হয়ে গেছে এই খুশিতে বাপেক্স এরই মধ্যে উৎসবে মেতেছে।   এর আগে বাপেক্স বিদেশি কোনও কোনও কোম্পানির গ্যাসকূপ ওয়ার্কওভারের কাজ করলেও আন্তর্জাতিক কোন কোম্পানির গ্যাসক্ষেত্রে খননের কাজ করেনি। আর সে কারণেই এই উৎসব।

বাপেক্স ব্যবস্থাপনা পরিচালক আতিকুজ্জামান সাংবাদিকদের ডেকে বলেছেন, আন্তর্জাতিক কোম্পানির সাথে প্রতিযোগিতা করে আমরা এ কাজ পেয়েছি। এ কাজ করে আমাদের দক্ষতা এবং আত্মবিশ্বাস বাড়বে, দেশের বাইরেও আমাদের পরিচিতি বাড়বে। ভবিষ্যতে এই অভিজ্ঞতা নিয়ে বিদেশের মাটিতেও কাজ করবে বাপেক্স।

কূপ খনন করে কত টাকা পাওয়া যাবে সে প্রশ্ন এসেছিলো সাংবাদিকদের তরফ থেকে। কিন্তু এমডি’র বক্তব্য ছিলো, ‘সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না। ’

তিনি জানালেন, দৈনিক হিসেবে দরপত্র জমা দিয়েছে বাপেক্স। এখন ক্রিস এনার্জির সাথে আলোচনা করে ঠিক করা হবে কত দিন লাগবে কাজ শেষ করতে। আর সে হিসাবেই অর্থ আয়ের হিসাব কষা হবে।  

বিশেষ করে কাজটি পাওয়ার পর সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি আকষ্মিকভাবে বাপেক্স ভবনে গিয়ে সবাইকে শুভেচ্ছা জানান। এতেই সেলিব্রেশন বেড়ে যায়।

তবে জ্বালানি বিভাগের ওই কর্তার অতি উৎসাহী ভাব অনেকের মধ্যে সন্দেহও বাড়িয়ে দিয়েছে। কেউ কেউ এতে কমিশনের গন্ধও খুঁজছেন। তাদের মতে, বাপেক্স যাতে নিজের ফিল্ডে মনযোগ দিতে না পারে, আর সেই সুযোগে বিদেশি কোম্পানিকে কাজ দিয়ে কমিশন হাতিয়ে নেওয়া যায় সেটাই এর উদ্দেশ্য।

এ প্রসঙ্গে তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা কমিটির নেতা আনু মুহাম্মদ বাংলানিউজকে বলেন, বাপেক্স সব সময়ই উল্টো পথে চলেছে। দেশীয় কোম্পানি সক্ষম নয় বলে বাঙ্গুরা ফিল্ড ক্রিস এনার্জিকে দেওয়া হয়েছিলো। বাপেক্স যদি কূপ খনন করতে সমর্থই হয় তাহলে কেন ক্রিসকে গ্যাস ক্ষেত্রটি দেওয়া হয়েছে এটাই এখন বড় প্রশ্ন।

কৌশলে বিদেশি কোম্পানিকে মালিকানা দিয়ে বাপেক্সকে ভাড়ায় খাটানো হচ্ছে। বাপেক্সের মালিকানায় থাকলে অনেক কম দামে গ্যাস পাওয়া যেতো।

কমিশনের ধান্ধায় সেই পথগুলো রূদ্ধ করা হলো বলে মনে করছেন তেল-গ্যাস রক্ষা কমিটির নেই শীর্ষ পর্যায়ের নেতা।

তিনি বলেন, রাষ্ট্রীয় এই কোম্পানিকে নীতি নির্ধারকরা ভাড়ায় খাটা কোম্পানিতে রূপান্তর করছে। এর পরিণতি অনেক ভয়াবহ।

নিজের কূপ গাজপ্রমকে দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাপেক্স খনন করলে তাদের কমিশন খাওয়ার সুযোগ থাকবে না। যে কারণে গাজপ্রমকে বেশি দামে কাজ দেওয়া হয়েছে।

ক্রিস এনার্জি সূত্র জানায়, স্থলভাগের ১১ নম্বর ব্লকের অন্তর্ভুক্ত বাঙ্গুরা গ্যাস ক্ষেত্র থেকে দৈনিক ১০ কোটি ঘনফুট (এমএমসিএফডি) গ্যাস তোলা হচ্ছে।

পুরোনো কূপগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা কমে যাওয়ায় সম্প্রতি নতুন দুটি কূপ খননের উদ্যোগ নেয় ক্রিস এনার্জি। এই দুটি কূপ খননের জন্য আহ্বান করা দরপত্রে অংশ নিতে ১০টি কোম্পানি দরপত্র নেয়।

যোগ্য বিবেচনায় চারটি কোম্পানিকে সংক্ষিপ্ত তালিকায় রাখা হয়। যারমধ্যে থেকে বাপেক্সকে চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় ক্রিস এনার্জি।

বাংলাদেশ সময়: ০৭৩০ ঘণ্টা, আগস্ট ২৬, ২০১৫
এসআই/এমএমকে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।