ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি

বিদ্যুতে ভূতুড়ে প্রকল্প!

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২১৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ৯, ২০১৫
বিদ্যুতে ভূতুড়ে প্রকল্প!

ঢাকা:  প্রয়োজনীয় অনুমোদন ছাড়াই এক ভূতুড়ে প্রকল্প শুরু হয়েছিলো আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানিতে (এপিএসসিএল)। এতে আপত্তি দিয়েছিলো আইন মন্ত্রণালয়।

পরে অনুমোদন নেওয়ার শর্তে ভেটিং দিয়েছিলো লেজিসলেটিভ বিভাগও। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। ঠেকানো যায়নি অনুমোদনহীন সেই প্রকল্প।

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, অনুমোদনের সময়ে কোম্পানিটির চেয়ারম্যান ছিলেন বিদ্যুৎ বিভাগের সদ্য বিদায়ী অতিরিক্ত সচিব আনোয়ার হোসেন। আর এমডি ছিলেন তার বন্ধু নুরুল আলম। তারা আইনকে পাশ কাটিয়ে ইচ্ছামতো সব কিছু করে গেছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, অনিয়মে ভরপুর যাকে বলে ঠিক যেন তাই আশুগঞ্জ উত্তর ৪৫০ মেগাওয়াট পাওয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণ প্রকল্পটি। হেন অনিময় নেই যা করা হয়নি এখানে।

আনোয়ার হোসেন বোর্ডে চেয়ারম্যান হিসেবে অনুমোদন দিতেন। আর সেই ফাইল মন্ত্রণালয়ে এলে নিজেই পাশ করতেন। অন্য কারো এর মধ্যে কথা বলার কোন সুযোগ ছিলো না। যে কারণে যাচ্ছে তাই করে গেছেন দুই বন্ধু মিলে।

কিন্তু সম্প্রতি এমডি নুরুল আলম অবসরে গেছেন। আর অপকর্মের অভিযোগে আনোয়ার হোসেনকে এপিএসসিএল’র চেয়ারম্যান ও বিদ্যুৎ বিভাগের যুগ্ম সচিব (উন্নয়ন) পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এতেই একে একে বেরিয়ে আসছে থলের বিড়াল।

আশুগঞ্জ ৪৫০ মেগাওয়াট (দক্ষিণ) পাওয়ার প্ল্যান্টের নির্মাণ প্রকল্পটি একনেক অনুমোদন দেয় ২০১১ সালে ১ নভেম্বর। সেটি ভেটিংয়ের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ বিভাগে পাঠানো হয়। লেজিসলেটিভ বিভাগ ২০১৩ সালের ২৭ নভেম্বর প্রয়োজনীয় অনুমোদন না থাকার বিষয়টি নজরে আনে।

পরে মতামত নেওয়ার নির্দেশনা দিয়ে আইন মন্ত্রণালয় ভেটিং দেয় ফাইলটিতে। প্রকল্পটির কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে এলেও ফাইলটিতে প্রয়োজনীয় অনুমোদন নেওয়া হয়নি।

অনুমোদন না নেওয়া প্রসঙ্গে এপিএসসিএল’র সদ্য বিদায়ী বোর্ড চেয়ারম্যান (বর্তমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব) আনোয়ার হোসেন বলেন, অনেকদিন আগের কথা, মুখস্ত বলা কঠিন। দেখলে বলতে পারব, কি অবস্থা।

এদিকে কোম্পানিটি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়াই ৪৫০ মেগাওয়াট আশুগঞ্জ (দক্ষিণ)পাওয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণ প্রকল্প নিয়েছে। যাতে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার মতো ব্যয় হবে। অথচ নিয়ম রয়েছে কোন উন্নয়ন প্রকল্পে ২৫ কোটি টাকার বেশি ব্যয় হলে একনেকের অনুমোদন বাধ্যতামূলক। এ বিষয়ে আনোয়ার হোসেন দাবি করেন, কোম্পানির ক্ষেত্রে অনুমোদন ছাড়াও প্রকল্প হতে পারে।

কোম্পানিটির টেন্ডারে জালিয়াতির ঘটনা অনেক পুরনো। জালিয়াতির অর্থ পাচার করা হয়েছে ক্যালিফোর্নিয়ার একটি ব্যাংকে। ইতোমধ্যে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। তদন্ত কমিটি সেই অর্থের সন্ধানে কাজ শুরু করেছে। মূল হোতা নুরুল আলম (কোম্পানিটির সাবেক এমডি) এখন পলাতক রয়েছেন। তার সন্ধান পাচ্ছে না তদন্ত কমিটি।

বিদ্যুৎ বিভাগ জানিয়েছে, ওই পাওয়ার প্ল্যান্টের কাজটি টেন্ডারে পায় স্প্যানিশ কোম্পানি টিএসকে। বাংলাদেশের পিপিআর অনুযায়ী, চূড়ান্ত দর অনুমোদনের পর আপোসরফার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু আশুগঞ্জে ৪৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতার নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ২২শ’ ২৬ কোটি টাকার দর পরিবর্তন করে ৩২শ’ কোটি টাকা করা হয়েছে। এ কারণে বাড়তি ১ হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করতে হবে বাংলাদেশকে।
 
অভিযোগ উঠেছে, এই অনিয়মের কারণে রাষ্ট্রের হাজার কোটি টাকা লোকসান হলেও কোম্পানিটির বোর্ড চেয়ারম্যান ও বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব আনোয়ার হোসেন এবং  সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরুল আলম ৪৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।

ঘুষের দুই মিলিয়ন ডলার লেনদেন হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের সানফ্রান্সিসকো শহরে অবস্থিত ওয়েল ফারগো ব্যাংকে। ব্যাংকটিতে রয়েছে এপিএসসিএলের সাবেক এমডি প্রকৌশলী নুরুল আলমের ছেলে মাহফুজ আলমের অ্যাকাউন্ট। ওই অ্যাকাউন্টেই ২ মিলিয়ন ডলার পাঠানো হয়েছে স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদ থেকে।
 
ওই দুর্নীতি নিয়ে বাংলানিউজ রিপোর্ট প্রকাশ করে ২৫ মে। ওই দিনই বিকেলে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি প্রথম দফায় বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে তথ্য চেয়ে চিঠি দিয়েছিলো আমেরিকায়। কিন্তু তথ্য না দিয়ে তারা মাহফুজ আলম’র পাসপোর্ট নম্বরসহ বেশ কিছু তথ্য চেয়ে পাঠিয়েছে। কিন্তু নুরুল আলম পলাতক থাকায় সেই তথ্য উদ্ধার করতে পারছে না কমিটি। বাধ্য হয়ে এটর্নি জেনারেলের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা চলছে বলে তদন্ত কমিটির এক সদস্য জানিয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ১২১৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ৯, ২০১৫
এসআই/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।