ব্রাসেলস (বেলজিয়াম) থেকে: বাংলাদেশের বড় বাণিজ্য অংশীদার ইউরোপীয় ইউনিয়ন। ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে কুটনীতি ও বাণিজ্য সম্পর্ক জোরদারের মাধ্যমে আমরা ইউরোপে বাংলাদেশকে অনন্য উচ্চতায় প্রতিষ্ঠা করেছি।
বলছিলেন, বেলজিয়ামে নিযুক্ত বাংলাদেশের বিদায়ী রাষ্ট্রদূত ইসমাত জাহান। ১৯৮২ ব্যাচের পেশাদার এই নারী কুটনীতিককে সম্প্রতি বদলী করা হয়েছে যুক্তরাজ্যে, বাংলাদেশের হাইকমিশনার হিসেবে।
দেশের প্রথম নারী হিসেবে ইতিহাস সৃষ্টি করে দায়িত্ব পালন করেছেন জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে। তার দায়িত্ব পালনকালে নিউইয়র্কে নিজস্ব ভবনে আলোর মুখ দেখে বাংলাদেশ মিশন।
ব্রাসেলসে বাংলাদেশ দূতাবাসে বাংলানিউজ মুখোমুখি হয় রাষ্ট্রদূত ইসমাত জাহানের।
আলাপ হয় পারস্পারিক কুটনৈতিক সম্পর্ক, বাণিজ্য, অভিবাসী নীতি, প্রবাসীদের সম্ভাবনার নানা দিক নিয়ে।
একাধারে জনপ্রশাসনের জ্যেষ্ঠ ও দেশের নারী কুটনীতিকদের মধ্যে একমাত্র জ্যেষ্ঠ এই কর্মকর্তা প্রথম রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ২০০৫ সালে নেদারল্যান্ডে।
বিয়ে করেন সেখানকার নাগরিক জোহানেস ডেনহেয়ারকে। যিনি বেলজিয়ামের খ্যাতনামা লুভান লা নভ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।
নারীর অধিকার ও ক্ষমতায়ন নিয়ে কাজ করে আন্তর্জাতিকভাবে সুনাম অর্জন করেন এই কুটনীতিক।
ভিনদেশি কুটনীতিকদের কাছে যার পরিচয় ‘ক্যারিশমেটিক ডিপ্লোম্যাট’।
মোস্ট সিনিয়র হিসেবে সুদীর্ঘ ৩৪ বছরের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের অধিকারী ইসমাত জাহান।
দু’ দফায় ইলিমেনেশন অব অল ফর্মস অব ডিসক্রিমিনেশন এগেইনস্ট ওমেন (সিডো), নারীর প্রতি সহিংসতা বিলোপ বিষয়ক জাতিসংঘের কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। দেশে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালকের দায়িত্ব ছাড়াও বিভিন্ন মিশনে সফল এই কুটনীতিক জানান, বেলজিয়ামের মিশনে দীর্ঘ সময় দায়িত্ব পালনে চ্যালেঞ্জগুলো কি ছিলো।
‘তাজরীন গার্মেন্টস অগ্নিকাণ্ড’ এবং ‘রানা প্লাজা ধস’ পরবর্তীতে ইউরোপে বাংলাদেশি তৈরি পোশাক অর্থাৎ আরএমজি’র বিশাল বাজার হুমকির মুখে পড়ে।
বিভিন্ন মহলে শুরু হয় নেতিবাচক প্রচারণা। বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চলে এখানকার ক্রেতা ও ভোক্তাদের। মিশনের দক্ষতা, অভিজ্ঞতা, বিশেষ করে যোগ্যতাকে কাজে লাগিয়ে ব্রাসেলসে ইউরোপিয়ান কমিশন ও ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় সে সময় আমরা বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষায় অভাবনীয় সাফল্য দেখাতে পেরেছি। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে চাই, বেলজিয়াম প্রবাসীদের কথা।
তারাও বিভিন্নভাবে আমাদের সহায়তা করেছেন, যোগ করেন তিনি।
আরও বলেন, আসলে প্রবাসীরাই তো এক-একজন বাংলাদেশের দূত, আমার কাছে এটাই সত্য।
আমি মাত্র একজন। আর প্রবাসীরা হাজার হাজার। তারাই তো দূর প্রবাসে থেকে দেশের সমৃদ্ধির জন্যে কাজ করছেন। প্রবাসে থেকে সত্যিকার অর্থে দেশের জন্য অনেক কিছু করছে তারা।
ইউরোপ থেকে ৮০ হাজার অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসীকে ফিরিয়ে নেবার বিষয়ে তৎপরতা দেখিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকও হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে কি ভাবছে দূতাবাস, এমন প্রশ্নে জবাবে ইসমাত জাহান বলেন, আসলে সংখ্যাটি নিয়ে আমাদের প্রশ্ন আছে। এটা নিয়ে এই মুহুর্তে উদ্বেগের কিছু নেই। আমরা লিখিতভাবে প্রমাণসহ তথ্য চেয়েছি। এখন তো নানা কারণে মানুষ অভিবাসী হচ্ছে, আর মূল কারণ অর্থনৈতিক। তবে এখানে এসে সবাই চাইছেন রাজনৈতিক আশ্রয়। ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর
সেটা নিয়েই যত আপত্তি।
তারা আমাদের বলছে, বাংলাদেশে তো সিরিয়া বা ইরাকের মতো পরিস্থিতি হয়নি। তাহলে তাদের সংখ্যা এত কেন! আমরা তাদের বুঝিয়েছি। বলেছি, নানা কারণেই এটা হচ্ছে। আসলে অভিবাসীদের বাড়তি চাপ পড়ছে ইউরোপে। ফলে আর্থিক মন্দাবস্থা প্রকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইউরোপের নাগরিকরাই এক দেশ থেকে আরেক দেশে যাচ্ছেন উন্নত জীবন আর কাজের সন্ধানে।
সে কারণে কর্মক্ষেত্রে ভিন্নদেশ থেকে আসা অভিবাসীদের সাথে প্রতিযোগিতামূলক আচরণ ভালোভাবে নিচ্ছেন না অনেকেই।
পাশাপাশি বেআইনি কর্মকাণ্ডও রয়েছে।
ইসমাত জাহানের জন্ম হয় ১৯৬০ সালে। তিনি ছিলেন হলিক্রস স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নেওয়ার পর ১৯৮২ সালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগ দেন তিনি। পরে যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন থেকে ল’ অ্যান্ড ডিপ্লোম্যাসিতে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন ওয়াশিংটনের জর্জ টাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ‘ফেলো’ ইসমাত জাহান।
দুই ভাই চার বোনের মধ্যে তিনি সর্ব কনিষ্ঠ। রাষ্ট্রদূত ইসমাত জাহানের আর্দশ তার মা অ্যাডভোকেট মেহেরুন্নেসা খাতুন। যিনি ১৯৬১ সালে ঢাকা হাইকোর্টের প্রথম নারী আইনজীবী হিসেবে নিয়োগ পেয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেন। ছিলেন প্রাদেশিক পরিষদে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচিত এমপি।
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন মেহেরুন্নেসা খাতুন।
নারী শিক্ষা, নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং মুক্তিযুদ্ধে গৌরবময় অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১১ সালে বাংলাদেশ সরকার অ্যাডভোকেট মেহেরুন্নেসাকে ‘বেগম রোকেয়া পদক’-এ ভূষিত করে।
ইসমাত জাহানের নানা খান বাহাদুর আবদুল গোফরান ছিলেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক সরকারের মন্ত্রী। আর বাবা এম ফজলুর রহমান ছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান।
মায়ের অাদর্শকে লালন করে জীবনের শেষদিনটি পর্যন্ত দেশের সেবায় কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন এই নারী কুটনীতিক।
বাংলাদেশ সময়: ২২১৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৭, ২০১৬
এটি