জাপান থেকে ফিরে: নারিতা আন্তজার্তিক বিমানবন্দর থেকে বেরোতেই জাপানি কায়দায় কুরিহারার কুর্নিশ! তার হাসিমুখে আন্তরিক অভিবাদনের ঝিলিক। হাসি খুশি মানুষটি যে ক’দিন জাপান ছিলাম ছায়ার মতো লেগেছিলেন।
জাপানে প্রথম ভ্রমণ হিসেবে এতটুকু অসুবিধা হলো না যার কারণে তিনি সেই কুরিহারা।
১৬ মে যখন জাপানের মাটিতে পা রাখি তখন স্থানীয় সময় বিকেল সাড়ে ৫ টা। এর আগে সিঙ্গাপুরে যাত্রাবিরতি শেষে স্থানীয় সময় পৌনে ১১টায় যাত্রা শুরু করেছিলাম। ভ্রমণের ক্লান্তি উবে গিয়েছিলো কৌতূহলে।
জাপানিদের নিয়ে কত গল্প, কাহিনী পড়েছি, শুনেছি। তার সঙ্গে মিলিয়ে দেখার অদম্য একটি ইচ্ছে ছিলো মনে।
কুরিহারার কুর্নিশে অভিভূত আমরা সবাই। আমরা মানে বাংলাদেশের সাংবাদিক প্রতিনিধিদল। এরপর ‘সিনাগাওয়া প্রিন্স হোটেল’ অভিমুখে এসি বাসে সোয়া একঘণ্টার যাত্রা। দু’পাশে বিউটিফুল সিনারি। যানজট, জনজটের চিহ্নই চোখে পড়লো না। হোটেলে পৌঁছতেই সন্ধ্যা। ডিনারের প্যাকেট হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন বিশ্বসেরা কাচ উৎপাদক আশাহি গ্লাস কোম্পানির (এজিসি) স্ট্যাটেজি বিভাগের ম্যানেজার টেকো ওহাশি।
বলে রাখা ভালো, জাপানিরা স্থানীয় সময় ১১-১২টায় লাঞ্চ এবং সন্ধ্যা সাত-আটটায় ডিনার করেন। আমাদের হোটেলটি সিনাগাওয়া স্টেশন থেকে হাঁটাপথে দুই মিনিটের দূরত্বে।
পরদিন এজিসির কারখানা পরিদর্শনে গেলাম আমরা। দুই ঘণ্টার দূরত্ব, কাশিমা ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোনে। কথা ছিলো আমাদের বাস যাত্রা শুরু করবে সকাল ৮ টায়। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ পিএইচপি পরিবারের নির্বাহী পরিচালক মি. ইদ্রিস বারবার তাগিদ দিয়েছিলেন, জাপানিরা নির্দিষ্ট সময় পছন্দ করে।
কিন্তু খাঁটি বাঙালি হিসেবে, সময়জ্ঞানে যে আমরা দুর্বল তা-ই প্রমাণিত হলো। অবশ্য এর সঙ্গে ভ্রমণের ক্লান্তি আর আলস্যের যোগসূত্রও থাকতে পারে। যাই হোক কারও পাঁচ, আবার কারও সাত মিনিট লেট। এভাবে পুরো দলের প্রায় পৌনে একঘণ্টা নেই হয়ে গেলো।
আশাহি প্ল্যান্টে যখন আমাদের বহনকারী বাস থামল তখন আবার সহযাত্রীদের চোখেমুখে বিস্ময়। এজিসির দুই নারী ও এক পুরুষ কর্মকর্তা বাসের সামনে দাঁড়িয়েই কুর্নিশ করে স্বাগত জানালেন।
একটি মিনি হলরুমে গেলাম আমরা। টেবিলে দুই দেশের পতাকা আড়াআড়িভাবে রাখা। পরিচিতি পর্ব শুরু হলো। এজিসির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পরিষ্কার বাংলায় বললেন, ‘কেমন আছেন?’
ইশ! এতো আনন্দ কোথায় রাখি। একজন বিদেশি, তা-ও জাপানি কর্মকর্তা, তার দেশে আমাদের ভাষায় জানতে চাইলেন কেমন আছি। আমরাও বেশ মজা পেলাম। বললাম ‘ভালো আছি। ’ তিনি হাসলেন। সবাই হাসলাম।
এজিসির টেকো ওহাশি, সিনিয়র ম্যানেজার (মেটেরিয়াল টেকনোলজি বিভাগ) ইওশিকি ইনোই, ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ডেভেলপমেন্ট বিভাগের ম্যানেজার ইওশিকি ইশিকাওয়া প্রমুখের কণ্ঠে ছিলো জাপান নিয়ে গর্ব আর বাংলাদেশের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা।
তারা বলেন, বাংলাদেশ ও জাপান দু’টি বন্ধুপ্রতিম দেশ। দুই দেশের পতাকার মধ্যেও অদ্ভুত মিল। এজিসি বাংলাদেশে যৌথভাবে বিনিয়োগ করতে চায়।
এরই মধ্যে ভারত, ইন্দোনেশিয়া, তাইওয়ান, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে যৌথ বিনিয়োগ করেছে এজিসি।
টেকো ওহাশি বললেন, বাংলাদেশে দিন দিন তাপমাত্রা উচ্চ থেকে উচ্চতর হচ্ছে। তাই আমাদের ধারণা, দেশটিতে এনার্জি সেভিং গ্লাসের চাহিদা দিন দিন বাড়বে। এ ধারণা থেকেই বাংলাদেশে বিনিয়োগের চিন্তাভাবনা এজিসির।
৮ লাখ ৩০ হাজার বর্গমিটার এলাকা জুড়ে এজিসি প্ল্যান্ট। যেখানে কর্মসংস্থান হয়েছে ৬৫০ জনের। ১৯৭৪ সাল থেকে ধাপে ধাপে কারখানাটি শিট গ্লাস, মিররস, হিট রিফ্লেকটিভ গ্লাস, কেমিক্যালসহ রকমারি পণ্য তৈরি করে বিশ্বব্যাপী সরবরাহ করে আসছে।
কাশিমা পোর্টের সঙ্গে লাগানো কাশিমা প্ল্যান্ট। পরিবেশ-বান্ধব চারপাশ। ছিমছাম গোছানো।
মতবিনিময় অনুষ্ঠানে ছিলো সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর পর্বও। তারপর আমাদের মাথায় নিরাপত্তা ক্যাপ এবং শব্দযন্ত্র পরিয়ে দেন। ফলে আমরা একটি আধুনিক কাচ কারখানার ভেতরে যেখানেই অবস্থান করি না কেন, সবাই শুনতে পাচ্ছিলাম এজিসির জাপানি কর্মকর্তার নির্দেশনা, ব্রিফিং।
জাপানের লাঞ্চ টাইম অনুযায়ী ১২টা বাজতেই প্যাকেট লাঞ্চ গ্রহণের জন্যে আহ্বান জানালেন টেকো ওহাশি। বাংলাদেশ সময় তখন মাত্র সকাল ৮টা! বলে কী, অসময়ে লাঞ্চ!
আমরা অনুরোধ করলাম, যাতে স্থানীয় সময় তিনটার দিকে লাঞ্চ সরবরাহ করা হয়। তা-ই করলেন তারা। লাঞ্চ শেষে আমরা সিনাগাওয়া স্টেশনের একটি শপিং সেন্টারে প্রবেশ করি।
জিনিসপত্রের দামটা বড্ড বেশি মনে হলো। এরপর জানানো হলো ডিনার আগেই বুকিং দেওয়া হয়েছে। তাই ৮টার মধ্যেই আমাদের পৌঁছাতে হবে ‘মহারাজা রেস্টুরেন্ট’ এ। কী আর করা। মহারাজায় মহাভোজ সারতে হলো।
টোকিওতে রয়েছে এজিসি স্টুডিও, যা হয়তো বিশ্বের বিস্ময় ‘কাচ সংগ্রহশালা। বর্ণিল কাচের রকমারি জৌলুস দেখে মুগ্ধ আমরা।
সিঁড়ি, দেয়াল থেকে শুরু করে কাচ দিয়ে কিনা হয়! ২০১০ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। এজিসির নির্বাহী মিসাও মিশোনো বিভিন্ন প্রকারের কাচের ব্যবহার সম্পর্কে ধারণা দিলেন সহজে।
একই সঙ্গে এজিসির শ্রেষ্ঠত্ব, কাচের মানের উৎকর্ষের লক্ষ্যে নিরন্তর গবেষণা, নতুন নতুন কাচ উদ্ভাবন, পুরুত্ব, টেম্পার ইত্যাদির পাশাপাশি প্রযুক্তিবিদ্যাকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী কাচের রাজত্বের বিষয়েও ধারণা দিলেন তিনি।
আরেকটি সেশন ছিলো এজিসির করপোরেট অফিস পরিদর্শন। অসাধারণ সেই অনুভূতি। এজিসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানালেন, বর্তমান সভ্যতার সঙ্গে কাচের নিবিড় বন্ধুত্ব। মুঠোফোন, গাড়ি, টেলিভিশন থেকে স্থাপত্যবিদ্যায় রকমারি কাচের রাজত্ব চলছে এখন।
প্রয়োজন বুঝে কাচ তৈরির আয়োজনে ব্যস্ত এজিসি। জাপান শুধু নয়, বিশ্বের সুউচ্চ টাওয়ার ‘টোকিও স্কাইট্রি’ থেকে শুরু করে বহুতল ভবনগুলোতে ব্যবহৃত হয়েছে এজিসির গ্লাস।
স্কাইট্রির কথা এলো। সেটি না দেখে জাপান থেকে যাই কীভাবে। ওই দিনই পরিদর্শনের ব্যবস্থা হলো। এক কথায় অসাধারণ। ৬৩৪ মিটারের আকাশছোঁয়া গাছটি স্থাপত্যবিদ্যার বিস্ময়কর সৃষ্টি। ২০১২ সালে পর্যটকদের জন্যে উন্মুক্ত করা হয় এটি।
স্কাইট্রি’র ভেতরে-বাইরে দুই ধরনের সৌন্দর্য। যত উপরে উঠবেন ততোই শিহরণ জাগানো অনুভূতি। মাঝখানে চিত্তবিনোদন আর নির্ভার, রিফ্রেশ হওয়ার জন্যে আছে শপ, ক্যাফে, রেস্টুরেন্ট, ছেলে-মেয়েদের আলাদা বিশ্রামাগার, নার্সিং রুম, স্মোকিং এরিয়া, ফটোগ্রাফির নান্দনিক আয়োজন।
সকাল ৮টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত খোলা থাকে স্কাইট্রি। চার বছরের নিচের শিশুদের জন্যে টিকেট নিতে হয় না। বয়সের ওপর নির্ভর করে টিকেটের দামে ভিন্নতা আছে। আমাদের টিকেটের দাম ছিলো ২ হাজার ৮২০ ইয়েন।
একটি মজার অভিজ্ঞতা হলো স্কাইট্রিতে। ওপরে উঠেছি আমরা। গ্লাসের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়াতে হবে এবার। স্বচ্ছ গ্লাস, কিন্তু পুরুত্ব বেশ। নিচে টোকিও শহর। ইতস্তত করছেন সবাই।
পা দিলে যদি হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে। কুরিহারা তো নির্ভয়ে নামলেন। শুধু কি নামা, আমাদের সাহস দিতে লাফালাফি শুরু করলেন। না, ভাঙা দূরে থাক কাঁপলো না পর্যন্ত। পরে আমরাও দাপিয়ে বেড়ালাম কাচের মেঝেতে।
স্কাইট্রি দেখার পরদিন আমরা ‘নিপ্পন ট্রাভেলস’র তত্ত্বাবধানে পরিদর্শন করি জাপানের সবচেয়ে উঁচু পর্বত ফুজি মাউন্টেন ও ঐতিহ্যবাহী হাকুনি মাউন্টেন। অভিজ্ঞতা হলো বুলেট ট্রেনে (সুপার এক্সপ্রেস ট্রেন) ভ্রমণেরও।
জাপান ভ্রমণের পর থেকে মনে হচ্ছে, আমাদের দেশে প্রাকৃতিক যে সম্পদ আছে তার সঙ্গে যদি উন্নত প্রযুক্তির মেলবন্ধন ঘটে তবে আমরা জাপানের মতো উন্নত হবো।
বিশেষ করে, বুলেট ট্রেনের আদলে যদি দ্রুতগতির ট্রেন সার্ভিস ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে নিশ্চিত করা যায় তবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে অর্থনীতিতে।
বৃহত্তর চট্টগ্রামের কক্সবাজার, রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, চট্টগ্রাম শহর ও উপজেলায় যেসব দর্শনীয় স্থান আছে সেগুলো যদি একটু টেকসইভাবে সাজানো যায়, নিরাপদ জোনে রূপান্তর করা যায় তবে পর্যটকদের আকর্ষণ করতে পারবো আমরা। এর বাইরে সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা পর্যটনস্পটগুলো তো আছেই।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৪৯ ঘণ্টা, মে ২২, ২০১৬
টিসি/
**টোকিও স্কাইট্রি, ফুজি-হাকুনি মাউন্টেনে মুগ্ধ পর্যটক
** জাপানিদের উন্নতির মূলমন্ত্র ‘সময় জ্ঞান’
** ভূমিকম্পেও বিকার নেই জাপানিদের
** জাপানে জীবনযাত্রার ব্যয় বেশি