ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

অপার মহিমার রমজান

মাসয়ালা

চাঁদ দেখে রোজা শুরু ও শেষ করতে হবে

কাজী আবুল কালাম সিদ্দীক, অতিথি লেখক, ইসলাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৪১ ঘণ্টা, জুন ১৭, ২০১৫
চাঁদ দেখে রোজা শুরু ও শেষ করতে হবে

পবিত্র রমজান মাসের মর্যাদা ও মাহাত্ম্য বলার অপেক্ষা রাখে না। এ মাস আল্লাহতায়ালার অধিক থেকে অধিকতর নৈকট্য লাভের উত্তম সময়, পরকালীন পাথেয় অর্জনের উৎকৃষ্ট মৌসুম।



যেকোনো আমল কবুল হওয়ার জন্য শর্ত হচ্ছে, সেটি শরিয়তের নির্দেশনা মোতাবেক সম্পন্ন হওয়া। মনগড়া মতো কোনো আমল করলে সেটা যত বড় আমলই হোক না কেন, আল্লাহর কাছে তা গ্রহণযোগ্য হয় না। পবিত্র রমজানের রোজাও এর ব্যতিক্রম নয়। এ মাসের শুরু ও শেষ নির্ভর করবে চাঁদ দেখার ওপর। এ প্রসঙ্গে হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) বলেন, হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, (রমজানের) চাঁদ না দেখা পর্যন্ত রোজা রাখবে না এবং (শাওয়ালের) চাঁদ না দেখা পর্যন্ত রোজা রাখা বন্ধ করবে না। -সহিহ মুসলিম ১/৩৪৭

অন্য হাদিসে আছে, ‘(শাবানের ২৯ দিন পূর্ণ করার পর) তোমরা যদি রমজানের চাঁদ না দেখ তাহলে শাবান মাস ৩০ দিন পূর্ণ করবে। ’ -মুসান্নাফ আবদুর রাজ্জাক : হাদিস নং ৭৩০১

মাসয়ালা : রমজানের শুরু ও শেষ নির্ণয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানের হিসাব গ্রহণযোগ্য নয়, কেননা এ সংক্রান্ত হাদিসগুলোতে স্পষ্টত ‘চাঁদ দেখা’র কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অতএব চোখে দেখার ওপর ভিত্তি করে চান্দ্রমাসের শুরু ও শেষ নির্ধারিত হবে, অন্য কোনোভাবে নয়। -মাজমু ফাতাওয়া ওয়া মাকালাত; শেখ আবদুল আজিজ বিন বায : ১৫/৬৮, ১২১, ১২৭

মাসয়ালা : আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকলে রোজা শুরুর জন্য এমন একজন ব্যক্তির চাঁদ দেখাই যথেষ্ট হবে, যার দ্বীনদার হওয়া প্রমাণিত কিংবা অন্তত বাহ্যিকভাবে দ্বীনদার। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘একজন মরুবাসী ব্যক্তি হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট (রমজানের) চাঁদ দেখার সাক্ষ্য দিল। রাসূলুল্লাহ (সা.) তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি কি এ কথার সাক্ষ্য দাও যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই এবং আমি আল্লাহর রাসূল?’ সে বলল, ‘হ্যাঁ। ’ রাসূলুল্লাহ (সা.) তখন সকলকে রোজা রাখার নির্দেশ দিলেন। ’ -মুসতাদরাকে হাকিম- ১/৪২৪

মাসয়ালা : যদি ২৮ দিন পর শাওয়ালের চাঁদ দেখা যায়, সেক্ষেত্রে বোঝা যাবে যে, রমজানের শুরু নির্ণয়ে ভুল হয়েছিল। তাই পরবর্তীতে একদিনের রোজ কাজা করে নিতে হবে, কেননা মাস কখনও ২৯ দিনের কম হওয়া সম্ভব নয়।

মাসয়ালা : আকাশ পরিষ্কার থাকলে একজনের খবর যথেষ্ট নয়; বরং এত লোকের খবর প্রয়োজন, যার দ্বারা প্রবল বিশ্বাস জন্মে যে, চাঁদ দেখা গেছে। কেননা, যে বিষয়ে অনেকের আগ্রহ ও সংশ্লিষ্টতা থাকে তাতে দু’একজনের খবরের ওপর নির্ভর করা যায় না। নিম্নোক্ত হাদিসে এই মূলনীতি পাওয়া যায়। হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) একদিন আসরের নামাজে দু’রাকাতের পর সালাম ফেরালেন। তখন যুলইয়াদাইন (রা.) বললেন, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ! নামাজ কি দু’রাকাত করা হয়েছে, না আপনি ভুলে গেছেন?’ হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন শুধু যুলইয়াদাইন (রা.)-এর কথার ওপর নির্ভর না করে অন্যান্য সাহাবিদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন যে, ‘যুলইয়াদাইন কি ঠিক বলেছে? ... ’ -সহিহ বোখারি : ১/২১২

মাসয়ালা : কোনো ব্যক্তি একাকী চাঁদ দেখেছে, কিন্তু তার সাক্ষ্য গৃহিত হয়নি, এক্ষেত্রে তার জন্য ব্যক্তিগতভাবে রোজা রাখা জরুরি নয়। কেননা নবী (সা.) বলেছেন, ‘রোজা হলো সে দিন, যে দিন তোমরা সকলে রোজা রাখো, আর ইফতার হলো সে দিন, যে দিন তোমরা সকলে ইফতার করো, আর কোরবানি হলো সে দিন, যে দিন তোমরা তোমাদের পশু জবেহ করো। ’ –তিরমিজি

এছাড়া মুসান্নাফ আবদুর রাজ্জাক নামক হাদিস গ্রন্থের চতুর্থ খন্ডের ১৬৮ নং পৃষ্ঠার হাদিস থেকেও উক্ত মতের পক্ষে প্রমাণ মেলে।

মাসয়ালা : শাবান মাসের ২৯ ও ৩০ তারিখে রোজা রাখবে না; না রমজানের নিয়তে না নফলের নিয়তে। অবশ্য যে পূর্ব থেকেই কোনো নির্দিষ্ট দিবসে (যথা সোম ও মঙ্গলবার) নফল রোজা রেখে আসছে, আর ঘটনাক্রমে শাবানের ২৯ ও ৩০ তারিখে ওই দিন পড়েছে তার জন্য এই তারিখেও নফল রোজা রাখা জায়েয। এ প্রসঙ্গে নবী (সা.) বলেন তোমরা রমজান মাসের একদিন বা দুই দিন পূর্ব থেকে রোজা রেখো না। তবে কারো যদি পূর্ব থেকেই নির্দিষ্ট কোনো দিন রোজা রাখার অভ্যাস থাকে তাহলে সে ওই দিন রোজা রাখতে পারে। ’ -সহিহ বোখারি : ১/১৫৬

সহিহ তিরমিজিতে হাদিসটি এভাবে এসেছে, নবী (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা একদিন বা দু’দিনের মাধ্যমে (রমজান) মাস এগোবে না, তবে সেদিন যদি সওমের দিন হয়, যা তোমাদের কেউ পালন করত...। ’

ভিনদেশে চাঁদ দেখার বিধান
মাসয়ালা : যে দেশে চাঁদ দেখা গেল, তার অধিবাসীদের ওপর রোজা ওয়াজিব। যে দেশে চাঁদ দেখা যায়নি, তার অধিবাসীদের ওপর রোজা ওয়াজিব নয়, কারণ রোজার সম্পর্ক চাঁদ দেখার সাথে, দ্বিতীয়ত চাঁদের কক্ষপথ বিভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন। সারাবিশ্বে একই দিনে রোজা পালন ও ঈদ উদ্যাপনের বিষয়ে মতবিরোধ থাকলেও এ বিষয়ে রাবেতার ইসলামি ফিকহ কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত হচ্ছে, মুসলিম উম্মতের চাঁদ দেখা ও ঈদ উৎসবসমূহকে একদিনে করার দাবি অপ্রয়োজনীয়। কেননা ঈদের দিন এক হওয়া মুসলিম উম্মতের একতাবদ্ধতার নিশ্চয়তা নয়; যেমনটি চাঁদ দেখা ও ঈদ উৎসব একদিনে করার প্রস্তাবকারীদের অনেকেই ভুলবশত ধারণা করে থাকে। বরং চাঁদ দেখার বিষয়টি মুসলিম দেশগুলোর সরকার, নিজ নিজ ফতোয়া ও আইন বিভাগের হাতে ছেড়ে দেয়া উচিৎ। কেননা তা সার্বজনীন দ্বীনি কল্যাণের অধিক নিকটবর্তী। আর উম্মতের একতাবদ্ধতার নিশ্চয়তা নিহিত রয়েছে সকল ক্ষেত্রে কোরআন-সুন্নাহ্ অনুযায়ী আমল করার মাঝে। -বিস্তারিত দেখুন: ফিকহুস সিয়াম : পৃষ্ঠা ৪৬, তাওজিহুল আহকাম : ৩/৪৫৫

মাসয়ালা : অমুসলিম দেশে বসবাসকারী মুসলিমগণ সেখানকার ইসলামিক সেন্টার কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্তের অনুসরণ করবেন। যদি এ রকম কোনো মুসলিম জনগোষ্ঠী চাঁদ দেখতে সক্ষম না হয়, তবে তারা এমন দেশের চাঁদ দেখার অনুসরণ করবেন যে দেশের চাঁদের উদয়াচল ও অস্তাচল তাদের অনুরূপ। যদি এরূপ কোনো মুসলিম দেশ পাওয়া না যায়, তবে তারা তাদের নিকটতম মুসলিম দেশের অনুসরণ করবেন। -সৌদি স্থায়ী কমিটির ফতোয়া সমগ্র : ১০/৯৭-১০৪, মাজমু ফাতাওয়া শায়খ মুহাম্মাদ বিন সালেহ আল উসাইমিন : ১৯/৪১

মাসয়ালা : যদি কারও পক্ষে চান্দ্রমাসের শুরু কিংবা শেষ জানা সম্ভব না হয় (যেমন ধরা যাক কোনো অমুসলিম দেশে কারাবন্দী আসামী ক্ষেত্রে) তবে সে আন্দাজ করে রোজা রাখবে। পরবর্তীতে যদি দেখা যায় যে, সে রোজা গণনা শুরু করেছে প্রকৃত রমজান শুরুর পরে, তবে তার রোজা আদায় হয়ে যাবে। কিন্তু যদি সে রমজানের আগে শুরু করে থাকে, সে ক্ষেত্রে রমজানের পূর্বের রোজাগুলো নফল হিসেবে গণ্য হবে এবং তাকে পরবর্তীতে তা আদায় করতে হবে। কেননা প্রথম ক্ষেত্রে যে রোজাগুলো সে রমজানের পরে পালন করেছে, সেগুলো কাজা হিসেবে গণ্য হবে। কিন্তু দ্বিতীয় ক্ষেত্রে রমজানের পূর্বের রোজা দ্বারা তার ফরজ রোজা আদায় হবে না, কেননা নির্ধারিত ওয়াক্তের পূর্বে পালনকৃত ইবাদত আদায় হয় না।

চান্দ্র মাস ৩০ বা ২৯ দিনের হয়ে থাকে
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী (সা.) বলেছেন, ‘মাস এরূপ, এরূপ ও এরূপ। অর্থাৎ ত্রিশ দিন। অতঃপর তিনি বলেন, এরূপ, এরূপ ও এরূপ। অর্থাৎ ঊনত্রিশ দিন। তিনি বলেন, কখনো ত্রিশ দিন, কখনো ঊনত্রিশ দিন। ’ -বোখারি ও মুসলিম

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘নবী (সা.)-এর সাথে আমরা অধিক সময় ঊনত্রিশ দিন সওম পালন করেছি, ত্রিশ দিনের তুলনায়। ’

সুতরাং হাদিসে আলোকে বুঝা গেলো, চান্দ্র্রমাস শরিয়তের বিধান যার ওপর নির্ভরশীল, তা কখনো ত্রিশ, আবার কখনো ঊনত্রিশ দিনের হয়। এদিকে মাস যখন অসম্পূর্ণ হয়, সওয়াব পরিপূর্ণ হয়।

ইবনে মাসউদ (রা.) সংবাদ দিয়েছেন, তারা নবী (সা.)-এর সাথে অধিক সময় ঊনত্রিশ রোজা পালন করেছেন, ত্রিশ দিনের তুলনায়। উপরোক্ত হাদিসগুলো জ্যোতিষ্ক ও গণকদের প্রত্যাখ্যান করে। এ হাদিস আরো প্রমাণ করে যে, শরয়ি বিধান রোজা, ফিতর ও হজ ইত্যাদি চাঁদ দেখার ওপর নির্ভরশীল, গণনার ওপর নয়।

বাংলাদেশ সময়: ১৫৪১ ঘন্টা, জুন ১৭, ২০১৫
এমএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।