ঝালকাঠি: ঝালকাঠির বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ অঞ্চলে ইসলাম প্রচারের আদিপর্বে যে সকল মহাপুরুষদের আগমন তাদের মধ্যে হযরত দাউদ শাহ কোরেশী (রহ.) অন্যতম। ইতিহাস থেকে জানা যায় সিলেটে শায়িত হযরত শাহ জালাল ইয়েমেনী (রহ.) এ দেশে হিজরত করার ক্ষেত্রে যে ৩৬০ জন সফরসঙ্গী ছিলেন।
তবে কারো কারো মতে হযরত দাউদ শাহ্ কোরেশী (রহ.)সম্রাট শাহ সুজার আমলে ঝালকাঠিতে এসেছিলেন।
ঐতিহাসিক সিরাজ উদ্দীন আহমেদের বরাত দিয়ে গবেষক বদরুল আলম সাইফী বলেন, হযরত দাউদ শাহ কোন সময় চন্দ্রদ্বীপে ইসলাম ধর্ম প্রচার করতে আসেন তা নিয়ে মতান্তর রয়েছে। কেউ বলেন তিনি সুলতানী আমলে সুদূর ইরান থেকে এসে খড়ম পায়ে সুগন্ধা নদী অতিক্রম করে এ অঞ্চলে আগমন করেন। আবার কেউ বলেন তিনি মোঘল আমলে এ অঞ্চলে ইসলাম ধর্ম প্রচার করেন। কাহিনী ও মসজিদের নির্মাণ কৌশল দেখে মনে হয় হজরত দাউদ শাহ মোঘল আমলের প্রথম দিকে বাকলায় আগমন করেন। সুগন্ধিয়ায় সরদারদের পূর্বপুরুষ শ্রাবণ ঠাকুর দাউদ শাহের সমকালীন। সরদারের বংশতালিকা অনুসারে দেখা যায় দাউদ শাহ্ ১৬ শতকের শেষভাগে এ অঞ্চলে আসেন।
জনশ্রুতি আছে তিনি একজন শ্রমিকের ছদ্মবেশে শ্রাবণ ঠাকুরের বাড়িতে আশ্রয় নেন। একদিন শ্রাবণ ঠাকুরের স্ত্রী দেখতে পেলেন দাউদ শাহের হাতের ইশারায় নারিকেল গাছ নিচু হয়ে যায় এবং তিনি সে গাছ থেকে দাঁড়িয়ে নারিকেল পাড়েন। আর একদিন দেখা গেল দাউদ শাহ্ চুলায় কোনো কাঠ না দিয়ে তার নিজের পা জ্বালিয়ে ধান সেদ্ধ করছেন। এঘটনা দেখে শ্রাবণ ঠাকুর ও তার স্ত্রী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং তাঁর নাম হয় শ্রাবণ খাঁ। তারপর দাউদ শাহ শ্রাবণ খাঁ কর্তৃক নির্মিত খানকায়ে আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন হলেন।
এছাড়াও কথিত আছে গৌড়ের শাসনকর্তা হযরত দাউদ শাহ (রহ.) এর সাধনার কথা শুনে মুগ্ধ হন। তিনি রাজমহল ও রাজস্থান থেকে সাদা পাথর এনে মাজার নির্মাণ করেন। মাটি থেকে তিন ফুট উঁচু সাদা পাথর এবং কবরের মেঝে কালো পাথর দিয়ে বাঁধানো। সামনে তার খাদেম মতান্তরে সরদার বংশধর আলামত খাঁ ও নেয়ামত খাঁর কবর আছে। মাজারে দুই খণ্ড পাথর রয়েছে। প্রবাদ আছে পাথরগুলো এখানে ভেসে এসেছে। মাজারের সামনে মসজিদ আছে। পাশেই একটি দীঘি।
মাজারের তত্ত্বাবধায়নের জন্য মোগল সম্রাট লাখেরাজ সম্পত্তি দান করেন। চেরাগী দাউদ শাহ (কিসমত চরামদ্দি, পরগণা চন্দ্রদ্বীপ) নামে লাখেরাজ সম্পত্তি ছিল। শ্রাবণ খাঁর পুত্র আলামত খাঁর পুত্র আহম্মদ খাঁর নামে এই লাখেরাজ সম্পত্তি ছিল। আহম্মদের নামে চর আহম্মদিয়া বা চরামদ্দির নাম হয়েছিল। ইংরেজ সরকার এ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে নেয়। ইতিহাস থেকে জানা যায়, সরদারদের নিকট ফার্সি ভাষায় লেখা দুটি দলিল আছে।
আর এই স্থানীয় সরদার বংশ তথা যাদের পূর্বপুরুষ ছিলেন শ্রাবণ ঠাকুর তথা শ্রাবণ খাঁ, তারা মাজারের তত্ত্বাবধায়ক তথা খাদেম হিসেবে ছিলেন। বর্তমানে অবশ্য সরদার পরিবার নয় বরং খন্দকার পরিবার মাজারের খাদেম হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছে।
তথ্যসূত্র অনুযায়ী হযরত দাউদ শাহ্ কোরেশী ((রহ.) ) কর্তৃক এতদঞ্চলে তিন খানা মসজিদ নির্মাণ করেন বলে নজির পাওয়া যায়। ঝালকাঠি বন্দরে একটি মসজিদ স্থাপন করেছিলেন এবং সেখানে বসে দ্বীনের দাওয়াতের জন্য মানুষদেরকে আহ্বান জানাতেন। ঝালকাঠির তাবলীগ মসজিদের ঠিক কাছেই তিনি এই পাকা মসজিদ নির্মাণ করেন। একটি ছোট্ট পাকা খুপরির মতো নামাজের ঘর রূপে এই মসজিদ ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত দেখা গেছে। পরে সেই ঘরটি ভেঙে ঝালকাঠি মারকাজ মসজিদ নির্মিত হয়েছে।
এছাড়া হযরত দাউদ শাহ্ ঝালকাঠির শহরতলীর সুতালরীতে ও নলছিটিতে মসজিদ নির্মাণ করেছেন।
উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেম ও ঝালকাঠি এনএস কামিল মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা দার্শনিক হযরত কায়েদ সাহেব (রহ.) বহুবার এ মাজারে এসে নির্ধারিত তারিখে ওয়াজ মাহফিল করে মাজার সংশ্লিষ্ট আচার-আচরণকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত এর ধারায় পরিবর্তন করেন।
বাংলাদেশ সময়: ১০৫৯ এপ্রিল ০৭, ২০২২
এসআইএস