যশোর:‘ছোটবেলায় বাবা-মাকে খুব মনে পড়তো। ভাবতাম তাদের সঙ্গে কি কখনো দেখা হবে না! আস্তে আস্তে বড় হয়েছি আর মন থেকে তাদের ছবিটা হারিয়ে ফেলেছি।
দরকারও নেই। আমি কেনো তাদের মনে রাখবো। তারা তো আমার কথা মনে করেনি। দুজনই ছেড়ে চলে গেছে। এখন আমার একটাই চিন্তা পড়াশোনা শেষ করতে হবে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে’-কথাগুলো শিশু বয়সে ভারতে চলে যাওয়া সর্বজয়ার (ছদ্ম নাম)।
সর্বজয়ার বয়স যখন ছয় বা সাত তখন তার মা অন্য একটা লোককে বিয়ে করে চলে যান। বাবাও একদিন চলে যান তাকে একা ফেলে। তারপর রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করা, সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে যাওয়া, সেখানে খ্রিস্টান মিশনারি হয়ে সরকারি শেল্টারহোমে আশ্রয়লাভ এবং লেখাপাড়া শেখা-এক কঠিন সময় পার করা সর্বজয়া জীবনের গল্প বলার সময় তার চোখে পানি ভর করেছিল।
মানবাধিকার সংগঠন রাইটস যশোর কার্যালয়ে যখন সর্বজয়ার সঙ্গে কথা হচ্ছিল তখন তার মা-ও সেখানে ছিলেন। তিনি এসেছিলেন গাইবান্ধা থেকে। বর্তমান স্বামীর সঙ্গে থাকেন। সর্বজয়ার বাবার বাড়ি নেত্রকোনা। মায়ের প্রসঙ্গ তুলতেই সর্বজয়ার জবাব, ‘তিনি বলছেন আমার মা। আমি তার মুখ মনে করতে পারছি না। ’
রাইটস যশোর কলকাতার ওই শেল্টারহোম থেকে সর্বজয়ার তথ্য পায়। পরে দেশে ঠিকানা খুঁজে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ভারতে পাঠায়। তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি চেয়ে আবেদন করে। অনুমতি পাওয়ার পর কলকাতায় বাংলাদেশি উপ-হাই কমিশনের বিশেষ ট্রাভেল পারমিটের মাধ্যমে সর্বজয়াকে দেশে ফেরত পাঠায় ভারতীয় কর্তৃপক্ষ।
গত ৩০ জানুয়ারি সন্ধ্যায় বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে আরও বেশ কয়েকজন বাংলাদেশির (যারা ভারতে পাচার হয়েছিল) সঙ্গে দেশে ফেরেন সর্বজয়া। কিন্তু তাকে বুকে টেনে নেওয়ার জন্য সেখানে ছিলেন না মা, বাবা বা কোনো স্বজন। রাইটস যশোরের পক্ষে তাকে গ্রহণ করে যশোরে নিয়ে রাখা হয় শেল্টারহোমে।
স্মৃতি হাতড়ে সর্বজয়া বলেন, বাবা, মা আর আমরা তিনবোন ঢাকায় থাকতাম। বাবা রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। দুর্ঘটনায় বাবার পা ভেঙে যাওয়ার কয়েকদিন পর মা অন্য একটা লোককে বিয়ে করে চলে যান। তখন তিনবোনকে সঙ্গে নিয়ে যান মা। বাবার প্রতি মায়া হতো দেখে মা আমাকে বাবার কাছে দিয়ে যান। বাবা আমাকে সঙ্গে নিয়ে রাস্তায় ভিক্ষা করতেন। একদিন আমাকে একা ফেলে রেখে বাবাও চলে যান।
‘আমি অসহায় হয়ে পড়ি। বেঁচে থাকার জন্য রাস্তায় ভিক্ষা করতাম। একদিন বয়সে একটু বড় এক মেয়েবন্ধু জুটে গেল। সেও ভিক্ষা করত। তার সঙ্গে একদিন ঢাকা থেকে ট্রেনে জয়দেবপুর হয়ে যশোর, তারপর বাসে বেনাপোল আসি। ঘোরাঘুরির সুযোগে সীমান্ত পার হয়ে ঢুকে পড়ি ভারতে।
সেখানে গিয়ে শিয়ালদহ স্টেশনে ভিক্ষা করতাম। কয়েকদিন পর দুজন ইউরোপিয়ান আমাদের নিয়ে যান খ্রিস্ট্রান মিশনারি লরেটুতে। যাদের বাবা-মা নেই সেসব শিশু থাকে এখানে। এক সপ্তাহ পর পুলিশ আমাকে লরেটু থেকে কলকাতার সরকারি শেল্টারহোম ‘সুকন্যা’য় নিয়ে যায়।
সর্বজয়ার বর্তমান বয়স ২০ বছর। এই সুকন্যাতেই শুরু হয় সর্বজয়ার পড়াশোনা ‘সুকন্যা বিদ্যাপীঠ’ এ। নবম শ্রেণি পাশ হলে ২০২২ সালে তাকে ভর্তি করা হয় রবীন্দ্র মুক্ত বিদ্যালয়ে। এখানে মাধ্যমিক শেষ করে ভর্তি হন বেথুন কলেজিয়েট স্কুলে। ভারতের প্রথম দুজন নারী স্নাতকের একজন ও দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম নারী ডাক্তার কাদম্বিনী গাঙ্গুলি, রাজা রামমোহন রায়ের দুই নাতনি, বিপ্লবী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার পড়তেন বেথুনে। এই স্কুল থেকে ২০২৩ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর তাকে ভর্তি করা হয় সারদা মিশন বিবেকানন্দ বিদ্যা ভবনে। তিনি বেথুন ও বিবেকানন্দ বিদ্যাভবনের হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া করতেন।
সর্বজয়া জানান, তিনি লেখাপড়ার পাশাপাশি ভরতনাট্যম, রবীন্দ্র নৃত্য, জুম্বা নৃত্য (শারীরিক কসরত), ইয়োগা, ডান্স মুভমেন্ট থেরাপি, কারাতে (গ্রিন বেল্ট), সেলফ ডিফেন্স, কাবাডি, ব্যাডমিন্টন, ফুটবল খেলা শিখেছেন। তিনি আর্ট অ্যান্ড গ্রাফট (শিল্প ও কারুশিল্প) এবং চিত্রকলায়ও বেশ পারদর্শী।
সর্বজয়া যখন সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার মিশনে এগিয়ে যাচ্ছিলেন তখনই তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় বাংলাদেশে। তিনি দেশে ফিরতে না চাইলে সুকন্যার চাইল্ড ওয়েলফেয়ার অফিসার সংযুক্তা বলেন, ‘জাতীয় পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর আমরা তোমাকে আর রাখতে পারি না। তোমাকে দেশে ফিরতে হবে। ’
সর্বজয়া জানান, কলকাতা থেকে দেশে আসার সময় তাকে ফোনে সুকন্যা’র মধুমিতা বলেছিলেন ‘আমরা চেষ্টা করছি বাংলাদেশে ভারতীয় হাই কমিশনকে বলে তোমার ভিসার ব্যবস্থা করতে। তার আগে তোমার পাসপোর্ট করা দরকার। ’
রাইটস যশোর কার্যালয়ে সর্বজয়ার সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল তখন পুরোটা সময় তার মা পাশে বসেছিলেন। তিনি মেয়েকে নিজের কাছে নিয়ে বিয়ে দেবেন বলে জানান। সর্বজয়া রাজি হননি। মেয়ে চিনতে না পারায় একা ফিরে যাওয়ার সময় মা সর্বজয়ার মাথায় হাত রেখে দোয়া করে যান যাতে তার মনের আশা পূরণ হয়। যাওয়ার আগে মেয়েটার সঙ্গে শুধু একটা ছবি তুলে দিতে বলেছিলেন তিনি!
রাইটস যশোরের নির্বাহী পরিচালক বিনয় কৃষ্ণ মল্লিক বলেন, সর্বজয়ার বিষয়টা বেশ জটিল। সে বেশ ছোট থাকতে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। সে কারণে মা, বাবা, ভাইবোন কারও কথা মনে নেই। কলকাতার হোমে প্রথম যাওয়ার পর তার কাছ থেকে যে তথ্য তারা পেয়েছিল এর ভিত্তিতে তার মাকে খুঁজে বের করে রাইটস যশোর। অনেক সময় লেগেছে। ততদিনে মেয়েটি সেখানে পড়াশোনা করে বেশ এগিয়ে যাচ্ছিল। দেশে ফিরে সে তার মাকে দেখে চিনতেও পারেনি।
তিনি জানান, রাইটস যশোরের শেল্টারহোমে রেখে তার জাতীয় পরিচয়পত্র এবং পাসপোর্ট করা হয়। ফের লেখাপড়া শিখে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর স্বপ্নে বিভোর সর্বজয়া গত ২২ এপ্রিল পাড়ি জমান কলকাতায় নিজের পছন্দের বিদ্যায়তনে। সেদিনও নিজের কোনো স্বজন বেনাপোল বন্দরে তাকে বিদায় জানায়নি। এপার থেকে রাইটস যশোর তাকে বিদায় দেওয়ার পর ওপারে গ্রহণ করেন সুকন্যার প্রতিনিধিরা।
আরএ/জেএইচ