চাঁপাইনবাবগঞ্জ: আমের রাজ্য খ্যাত জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার কানসাটে আম সম্মেলন হয়েছে।
দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে উদ্যোক্তারা মঙ্গলবার (৬ মে) কানসাট ক্লাব স্টেডিয়ামে এসে সম্মেলনে যোগ দেন।
সেখানে গিয়ে দেখা যায়, কেউ তুলছেন আমের সঙ্গে ছবি, কেউ সেলফি আবার অনেকে গ্রুপ ধরে ছবি তুলছেন। একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছেন। মাঠ জুড়ে সাজানো হয়েছে বিভিন্ন জাতের আমের ছবি। বড় বড় প্ল্যাকার্ডে আম সম্পর্কে দেওয়া আছে ধারণাও। জেনে নিচ্ছেন একে অপরের সম্পর্কে।
পাশাপাশি আমন্ত্রিত অতিথি, বিজ্ঞানী ও সংশ্লিষ্টদের কাছে থেকে শুনে নিচ্ছেন অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। এ ধরনের উদ্যোগে দারুণ খুশি তারা।
শিবগঞ্জ উপজেলার কানসাট ঐতিহাসিক রাজবাড়ি সংলগ্ন ক্লাব স্টেডিয়ামে গিয়ে জানা গেল, গত কয়েক বছর ধরেই চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমচাষিরা আমে লোকসান গুণছেন। আম চাষে যখন চাষিরা নিরুৎসাহিত হচ্ছেন, ঠিক এ সময় দিনব্যাপী ক্লাব স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল একদিনের ‘আম সম্মেলন-২০২৫’। ম্যাংগো ডেভেলপমেন্ট ফোরামের আয়োজনে অনুষ্ঠিত এ সম্মেলনে দেশের ৪৪ জেলার প্রায় ৩৫০ জন আম উদ্যোক্তা অংশ নেন।
নিরাপদ আম উৎপাদন, বাজারজাতকরণ, বিদেশে রপ্তানি এবং আম প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে কীভাবে আম শিল্পকে এগিয়ে নেওয়া যায়, তা নিয়েই মূলত এ সম্মেলন।
শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মো. তৌফিক আজিজের সভাপতিত্বে চাঁপাইনবাবগঞ্জের জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. আব্দুস সামাদ সম্মেলনের উদ্বোধন করেন। সম্মেলনে বক্তারা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় রপ্তানিমুখী জোন চিহ্নিতকরণ, প্রশিক্ষিত রপ্তানিকারক তৈরি, আধুনিক প্যাকিং হাউস স্থাপন এবং সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে অবকাঠামো উন্নয়নের ওপর জোর দেন। তারা আশা প্রকাশ করেন, এ সম্মেলন রপ্তানির নতুন দিগন্ত উন্মোচনে একটি মাইলফলক হয়ে উঠবে।
প্রধান অতিথি জেলা প্রশাসক মো. আব্দুস সামাদ চাষিদের কাছে আম পরিবহনে বিভিন্ন সমস্যা, আমের ওজন পদ্ধতি ও রপ্তানিতে বিভিন্ন সমস্যার কথা শোনেন এবং তা নিরসনে উদ্যোগ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।
তিনি বলেন, আম কিনতে এ বছর চীনের আগ্রহ বেড়েছে। বেড়েছে অন্যান্য দেশেও চাহিদা। দ্রুত বাংলাদেশ রপ্তানি ব্যুরোর কর্মকর্তারা চাঁপাইনবাবগঞ্জ পরিদর্শন করবেন এবং এ সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান আসবে। চাষিদের বাধ্য করে ৫৫ কেজি মণ ধরে যে আম কেনা হয়, তা বিভাগীয় কমিশনারকে জানানো হয়েছে। আশা করা যায়, দ্রুত এর সমাধান মিলবে। এছাড়া পরিবহনসহ বিভিন্ন স্তরে যে সমস্যা রয়েছে, তা ধীরে ধীরে সমাধানে কাজ করছে প্রশাসন।
বারবার এ ধরনের আয়োজনের প্রত্যাশা করে বরিশালের আম উদ্যোক্তা ও আজিজ ফুডের স্বত্বাধিকারী আবদুল্লাহ জানান, এ সম্মেলনে চাঁপাইনবাবগঞ্জের প্রকৃত আমচাষি ও ব্যবসায়ী এবং স্থানীয় উদ্যোক্তাদের সঙ্গে জেলার বাইরের উদ্যোক্তাদের যে সেতুবন্ধন তৈরি হচ্ছে, তার ফলে বাজারে যে সিন্ডিকেট রয়েছে, তা যেমন ভেঙে পড়বে, তেমনি ভোক্তারা ভালো আম পাবার সুযোগ পাবে।
ঢাকার উত্তরা থেকে আসা সাইয়েদুল বাশার জানান, ঢাকার বাজারে আম খেয়ে প্রকৃত স্বাদ পেতেন না। পরে অনলাইনে আম কেনা-বেচার উদ্যোগ নেন তিন বছর আগে। এ সম্মেলনে এসে তিনি স্থানীয় বেশ কিছু চাষির সঙ্গে পরিচিত হতে পেরে এবং আমের বিভিন্ন জাত সম্পর্কে জানতে পেরে দারুণ খুশি।
রংপুরের আম উদ্যোক্তা ও সেরা আম পেজের অ্যাডমিন মৌসুমি আক্তার জানান, তিনি পাঁচ বছর ধরে অনলাইনে আমের ব্যবসা করলেও এবারই প্রথম এ ধরনের আয়োজনে আসতে পেরেছেন, এতে তিনি খুশি। অনলাইনে আম কেনা-বেচা ও রপ্তানিতে যেসব সমস্যায় তিনি পড়েছেন, তার সমাধান পেতে এবং সেরা আম পেতেই এ সম্মেলনে তার আসা।
নাটোরের উদ্যোক্তা হায়দার হোসেনের ভাষ্য, আমকে যারা ভালোবাসে ও আমের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তেই মূলত এখানে আসা। পাঁচ বছর ধরে নিরাপদ আম নিয়ে কাজ করছি, তাই যারা নিরাপদ আম উৎপাদন করেন, তাদের খুঁজতেই এ সম্মেলনে আসা।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ও বরেন্দ্র কৃষি উদ্যোগের স্বত্বাধিকারী মুনজের আলম মানিক বলেন, আমরা চাঁপাইনবাবগঞ্জের চাষিরা আমের দাম পাই না বলে হতাশ। আবার রপ্তানিতেও নানান বাধা।
তিনি আম থেকে তার ফার্মে উৎপাদিত আম, ম্যাংগো বার, আমের পাউডারসহ আমের বিভিন্ন পণ্য এ সম্মেলনে নিয়ে এসেছেন। এতে করে তার পণ্যের চাহিদা যেমন বাড়বে, অন্যান্য উদ্যোক্তারা এ পথে আসতে উৎসাহিত হবেন বলে মনে করেন মুনজের আলম মানিক।
সম্মেলন আয়োজক কমিটির আহ্বায়ক শহীদুল হক হায়দারী শহিদ মিয়া জানান, আম সংশ্লিষ্টদের হতাশা কাটাতে, আম উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও রপ্তানিতে বিভিন্ন সমস্যা দূর করতে ও এর সমাধান পেতে এবং সারাদেশের আম উদ্যোক্তাদের মধ্যে একটি সেতুবন্ধন তৈরি করতেই আজকের এ সম্মেলন। সম্মেলনে ব্যাপক সাড়া পাওয়া গেছে। ভবিষ্যতে এ ধরনের আয়োজন অব্যাহত থাকবে।
আর অনলাইন ভিত্তিক আম বিক্রির সংগঠন ম্যাংগো ডেভেলপমেন্ট ফোরামের অ্যাডমিন এবং শিবগঞ্জ ম্যাংগো প্রোডিউসার কো-অপারেটিভ সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল খান শামীম জানান, তাদের প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে সারাদেশ থেকে প্রায় সাড়ে তিনশ আম উদ্যোক্তা সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন। অনলাইনে তাদের নিয়মিত যোগাযোগ থাকলেও এ ধরনের সম্মেলনের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক আরও গভীর হবে। পাশাপাশি আমরা যারা আম উদ্যোক্তা আছি, তারা উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও রপ্তানিতে যেসব সমস্যায় পড়ি, সেগুলোর সমাধান দিতে আমন্ত্রিত হয়েছেন স্থানীয় প্রশাসন, গবেষক, আম বিজ্ঞানী এবং ব্যবসায়ী নেতারা।
তবে রপ্তানির সম্ভাবনা বাড়লেও কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ, আধুনিক প্যাকেজিং, হ্যান্ডেলিং সমস্যা এবং শীততাপ নিয়ন্ত্রিত গুদাম ও পরিবহনের ঘাটতি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে রয়েছে। তাছাড়া অনেক আম উদ্যোক্তা চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিভিন্ন ভালো জাতের দেশীয় জাতের আম, জিআই সনদপ্রাপ্ত আম ও তাদের গবেষণায় উদ্ভাবিত বিভিন্ন হাইব্রিড জাতের রপ্তানিযোগ্য আম নিয়ে স্পষ্ট ধারণা নাই। আর এসব বিষয় তুলে ধরতেই তিনিসহ কয়েকজন গবেষক এ সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন এবং এ ধরনের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন বলে জানান বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ অফিসের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. জি এম মোরশেদুল বারী।
২০২৪ সালে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১৩০০ মেট্রিক টন আম ইউরোপ, যুক্তরাজ্য, কানাডা এবং মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়েছে।
এসআই