ঢাকা, শনিবার, ২১ আষাঢ় ১৪৩২, ০৫ জুলাই ২০২৫, ০৯ মহররম ১৪৪৭

সারাদেশ

গণপিটুনিতে মা-ছেলে-মেয়ে খুন: কেউ না থাকায় কবর খুঁড়ল গ্রামপুলিশ

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২:০৭, জুলাই ৫, ২০২৫
গণপিটুনিতে মা-ছেলে-মেয়ে খুন: কেউ না থাকায় কবর খুঁড়ল গ্রামপুলিশ

কুমিল্লা: মা ও ছেলে-মেয়েকে পিটিয়ে হত্যা করার পর গ্রেপ্তার আতঙ্কে পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার কড়ইবাড়ি গ্রাম।

ফলে শুক্রবার (৪ জুলাই) সন্ধ্যায় ময়নাতদন্ত শেষে লাশগুলো বাড়িতে নেওয়া হয়।

কিন্তু স্থানীয় জনতার গণপিটুনিতে নিহত চিহ্নিত মাদক বিক্রেতা রোকসানা আক্তার রুবি ও তার ছেলে-মেয়ের দাফনের জন্য কবর খোঁড়ার জন্য মানুষ পাওয়া যায়নি। তাই বাধ্য হয়ে বাঙ্গরা বাজার থানা পুলিশের সহযোগিতায় গ্রামপুলিশ দিয়ে তাদের কবর খোঁড়া হয়।

এদিকে ঘটনার একদিন পার হলেও এখনো কোনো মামলা করা হয়নি। নিহতদের পরিবারের জীবিত সদস্যরা কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকায় পরিবারের পক্ষ থেকে একজন সদস্য পুলিশের সঙ্গে মরদেহ গ্রহণের জন্য গ্রামে যান।  
 
তবে গ্রেপ্তার আতঙ্কে পুরুষশূন্য হয়ে গেছে কড়ইবাড়ি গ্রাম। বৃহস্পতিবার দিনভর ঘটনাস্থলে অন্যান্য গ্রামের মানুষের আনাগোনা, কড়ইবাড়ি গ্রামের মানুষের অল্প উপস্থিতি থাকলেও শুক্রবার সকাল থেকে ওই গ্রামে ছিল সুনসান নীরবতা। মাঝে মধ্যে পুলিশ, র‌্যাবের টহল গাড়ি দেখা গেলেও রাস্তাঘাটে কোনো মানুষকে চলাচল করতে দেখা যায়নি।

শুক্রবার রাত ৮টার দিকে মুরাদনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহফুজুর রহমান বলেন, মরদেহ পুলিশের উপস্থিতিতে দাফন করা হবে। মামলার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। এখনো পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি।

এদিকে নিহত রুবি ও তার পরিবারের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল প্রাঙ্গণ। একই পরিবারের তিন সদস্যকে হত্যার পর নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে পরিবারটি। তাদের আশঙ্কা, তাদেরও মেরে ফেলা হবে।

নিহত জোনাকির স্বামী আলমগীর হোসেন বলেন, লাশের গাড়ির সঙ্গে পরিবারের একজন ছাড়া কেউ যেতে পারেনি। বাড়িতে গেলে বাকিদের হত্যা করা হতে পারে। বৃহস্পতিবার মেয়েকে নিয়ে স্কুলে যাই। হামলার খবর শুনে আমি কোনোরকমে প্রাণে বেঁচে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হই। বৃহস্পতিবার রাতেও তারা মিটিং করেছে। হামলাকারীরা সবাই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত।

বৃহস্পতিবার মাদক ও ছিনতাই নিয়ে সালিশের বিরোধ থেকে স্থানীয় চেয়ারম্যান এবং মেম্বারের গায়ে হাত তোলা হয়। এ নিয়ে কুমিল্লার মুরাদনগরের কড়ইবাড়ি গ্রামে একই পরিবারের তিনজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।  
 
নিহতরা হলেন-কড়ইবাড়ি গ্রামের হাবিবুর রহমানের স্ত্রী রোকসানা বেগম রুবি (৪৭), রুবির মেয়ে তাসপিয়া আক্তার হ্যাপি ওরফে জোনাকি (২৯) ও রুবির ছেলে মো. রাসেল মিয়া (৪০)। এ ঘটনায় রুবির আরেক মেয়ে রুমা আক্তারকে (২৭) গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। জোনাকির স্বামী হায়দারাবাদ গ্রামের আবদুল হামিদের ছেলে মনির হোসেন ওরফে আলমগীর হোসেন।  

আলমগীর হোসেন, নিহত তিনজন ও হাবিবুর রহমানের আরেক মেয়েসহ তাদের পরিবারের পাঁচ সদস্যের নামে ৪৩টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে নিহত তিনজনের নামে মামলার সংখ্যা ৩০টি। তাদের বিরুদ্ধে মাদক বিক্রির অভিযোগ রয়েছে।

এর আগে বৃহস্পতিবার (৩ জুলাই) রুবিদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, রুবিদের সাততলা ভবনের বেশির ভাগ জানালার কাঁচ ভাঙা। তিনটি স্থানে ছোপছোপ রক্তের দাগ। বাড়ির আঙিনায় একটি মোটরসাইকেল ভাঙাচোরা অবস্থায় পড়ে আছে। বাইরে অসংখ্য মানুষের জটলা।
স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি জানান, দীর্ঘদিন ধরে শুনে আসছি এ পরিবার মাদক কেনাবেচার সঙ্গে সম্পৃক্ত। কমপক্ষে ৪০ বছর ধরে তারা মাদকবিক্রি করে আসছিলেন। অনেকবার শুনেছি, তাদের ক্রসফায়ার দেওয়া হবে। কিন্তু তারা বারবার বেঁচে যান। তারা সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত না হলেও আওয়ামী লীগের রাজনীতি করা ব্যক্তিদের সঙ্গে ওঠাবসা ছিল।  

সম্প্রতি এক স্কুল শিক্ষকের মোবাইল ছিনতাই হয়। ওই ছিনতাইকারীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিল রুবিদের পরিবারের। রুবিদের পরিবার ওই ছিনতাইকারীকে তাদের বাড়িতে আশ্রয়ও দেয়। গত মঙ্গলবার কড়ইবাড়ি গ্রামে এ ঘটনাসহ তাদের অপকর্ম নিয়ে সালিশ হয়। সেখানে তাদের অপকর্মের বিষয়ে মানুষজন অভিযোগ তোলেন। এ পরিবারের মাদক ছড়িয়ে দেওয়ায় গ্রামের আটজন রিহ্যাব সেন্টারে আছেন বলেও অভিযোগ করা হয়।  

বৃহস্পতিবার সকালে হায়দারাবাদ-কড়ইবাড়ি সড়কের কাজ দেখতে আসেন আকুবপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শিমুল বিল্লাল। এ সময় শিমুল বিল্লাল ও স্থানীয় বাচ্চু মেম্বারের গায়ে সালিশের ঘটনা নিয়ে আচমকা হাত তোলেন রোকসানা বেগম রুবি। স্থানীয়রা প্রতিবাদ করলে, রুবি নিজের হাত কেটে মামলার ভয় দেখান। এরপর পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে যায়।

নিহত রাসেলের স্ত্রী মীম আক্তার জানান, ননদের দোকানে চাকরি করা এক যুবক মোবাইল চুরির অভিযোগে ধরা পড়ে। অভিযুক্তের বাবা এ ঘটনায় আমাদের বাড়িতে এসে বলেন, আমি এক লাখ টাকা জরিমানা দেব। আমার স্বামী রাসেল যাতে বিষয়টি মীমাংসা করে দেন। গত পরশু বিষয়টি সুরাহার জন্য সবাই বসে। আমার শাশুড়ি বিষয়টি নিয়ে কথা বললে, স্থানীয় বাছিরের সঙ্গে ঝামেলা হয়। বাছির আমার শাশুড়ি ও ননদকে মারধর করে। এ সময় তর্কাতর্কি ও ঝামেলার একপর্যায়ে আমার এক বছরেরও কম বয়সী মেয়েকে মেরে হাত ভেঙে দেয় তারা। আমার স্বামী তখন বাইরে ছিল। তিনি এটি জানতে পারার পর খুবই উত্তেজিত হয়ে যান। এ নিয়ে খুব ঝামেলা হয়। তবে ওইদিন রাতের মধ্যে পরিস্থিতি শান্ত হয়ে যায়। পরে বৃহস্পতিবার সকালে এক-দেড়শ লোক বাঁশ ও ছুরি নিয়ে হাজির হয়। তারা প্রথমে ঘরের ভেতর ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে। এরপর ঘরে ঢুকে আমার শাশুড়িকে হত্যা করে। ঘরের বাইরে নাশতার জন্য যাওয়া ননদকেও হত্যা করা হয়। এরপর আলমারিতে লুকিয়ে থাকা স্বামীকেও হত্যা করে তারা। আমার স্বামী ছোট সন্তানের জন্য বারবার প্রাণভিক্ষা চাইলেও লাভ হয়নি। এখনও পর্যন্ত আমার শ্বশুর নিখোঁজ। আমি এ ঘটনায় মামলা করব।


এসআই
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।