মাদারীপুর: ‘আইজ এক বছর হইয়া গেল, আমার বাবায় নাই। মোবাইলে আমার বাবার ভিডিও দেহি।
কাঁদতে কাঁদতে নাছিমা বেগম তার জুলাই শহীদ একমাত্র ছেলে হৃদয় আহমেদ শিহাবের (১৮) স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এ কথা বলেন।
বুধবার (৯ জুলাই) দুপুরে হৃদয়ের বাড়িতে এ প্রতিবেদককে দেখেই আহাজারি করতে থাকেন নাছিমা বেগম। এসময় হৃদয়ের কবর সরকারিভাবে পাকা করে নামফলক লাগানোর আকুতি জানান তিনি।
তিনি জানান, এলাকার গোরস্তানে দাফন করা হয়েছে হৃদয়কে। একপর্যায়ে কবরের ওপর অন্য কবরও দেওয়া হতে পারে। সে ক্ষেত্রে আর ছেলের কবরের চিহ্ন থাকবে না। স্মৃতি ধরে রাখতে কবরটি ইট দিয়ে ঘিরে নামফলক লাগানোর দাবি জানান তিনি।
হৃদয়ের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, রান্না ঘরে রান্না করছেন নিহত হৃদয়ের মা নাছিমা বেগম। পাশেই বসে আছেন বাবা শাহ আলম হাওলাদার। মাদারীপুর জেলার সন্যাসীরচর ইউনিয়নের রাজারচর আজগর হাওলাদারকান্দি গ্রামে নিহত হৃদয়ের বাড়িতে সুনসান নিরবতা। শাহ আলম-নাছিমা দম্পতির একমাত্র ছেলে হৃদয়। আর এক মেয়ে রয়েছেন। হৃদয়ের বড়। যার বিয়ে হয়ে গেছে। হৃদয়ের বাবা দুর্ঘটনাজনিত কারণে কাজ করতে অক্ষম। মা নাছিমা বেগম পোশাক সেলাই করে উপার্জন করেন। আর শহীদ পরিবার হিসেবে সরকারি অনুদান পাওয়া পাঁচ লাখ টাকা ব্যাংকে এফডিআর করে রেখেছেন। সেখান থেকে যতটুকু ইন্টারেস্ট আসে, তা দিয়েই এখন দুজনের সংসার চলে।
নাছিমা বলেন, ‘আমার ছেলের বিদেশে যাওয়ার খুব ইচ্ছা ছিল। করোনার সময় এইট পর্যন্ত পড়া অবস্থায় স্কুল ছাড়ে। ঢাকায় ফার্নিচারের দোকানে কাজ শিখতে যায়। ওর এক চাচা সৌদি থাকেন। কাজ শেখা শেষ হলে আর বয়স একটু বাড়লে সৌদি পাঠামু- এ স্বপ্ন ছিল সবার। টাকাও জমাইতে শুরু করি। হৃদয়ের স্বপ্ন ছিল ইতালি যাবে। বাড়ির আশেপাশের অনেকেই ইতালি থাকে। কিন্তু বাবার আর বিদেশ যাওয়া হইলো না। চিরতরেই চইলা গেলো। ’
তিনি বলেন,‘কিস্তি তুইলা একটা ফ্রিজ কিনি তখন। হৃদয়রে জানাইলে ও খুবই খুশি হয়। কয়, মা কিস্তির টাকা আমি শোধ করমু। আমি কম খাইয়া টাকা জমাইয়া কিস্তি শোধ করমু। তুমি চিন্তা কইরো না। আর বিদেশ যাইতে পারলে ঘর দিমু। দাদার ঘরে আর থাকা লাগবে না। ’
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে নাছিমা বেগম বলেন, ‘১৮ জুলাই বৃহস্পতিবার দিন ফোনে কথা হয় হৃদয়ের সঙ্গে। শুক্রবার সকালে বাড়ি আসার কথা বলে। আমি ছেলের জন্য খাবার-দাবার তৈরির আয়োজন করি। অনেকদিন পর আমার বাবায় আসবো। পরদিন শুক্রবার ভোরে ফোন দিয়া বলে রোববার আসবো, আব্বার সাথে। তখন আমিও বলি, ঢাকার অবস্থা ভালো না। তুমি তোমার আব্বার সাথেই আইসো। বিকেলে হৃদয়ের মোবাইল থেকে কেউ ফোন করে জানায় আমার বাবায় গুলি খাইছে। প্রথমে ভাবছি, তেমন কিছু হবে না। রাইতে শুনি বাবায় নাই! মইরা গেছে! গুলিতে ওর পাজরের নিচে গর্ত হইয়া গেছিলো!’
‘কত মায়ের বুক খালি করছে। আমার হৃদয়ের লাশটা পাইছি। অনেকে তাও পায় নাই। হৃদয়রে যখন বাড়ি আনছে, পা দুইটা জড়ায় ধরছি। ঠান্ডা বরফের মতোন হয়ে গেছে। শুনছি, ঢাকায় কোথাও আমার বাবারে চিকিৎসা দেয় নাই। যদি চিকিৎসা দিতো, তয় আমার বাবায় বাঁচতো’, আক্ষেপ করেন নাসিমা।
২০২৪ সালের ১৯ জুলাই শুক্রবার দুপুরে ঢাকার বাড্ডায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান হৃদয়। দুপুরের খাবার খেয়ে ফার্নিচারের কারখানায় নিজ কর্মস্থলে ফিরছিলেন তিনি। আন্দোলনকারীদের মিছিল দেখে এগিয়ে যান হৃদয়। এমন সময় আন্দোলনকারীদের দিকে পুলিশের ছোড়া একটি গুলি এসে হৃদয়ের বুকের নিচের দিকে বিদ্ধ হয়ে পিঠ দিয়ে বের হয়ে যায়। মৃত্যু হয় হৃদয়ের। পরদিন অনেকটা নিভৃতেই নিজ এলাকার গোরস্তানে দাফন হয় তার।
ছেলে হারানোর এ এক বছরে সরকারি অনুদান পাঁচ লাখ টাকাসহ বেসরকারি একাধিক অনুদান পেয়েছে হৃদয়ের পরিবার। সন্তান হারানো বেদনা আমৃত্যু বয়ে বেড়াতে হবে তার বাবা-মাকে। হৃদয়ের মা ও বাবা তার সন্তানের কবর সংরক্ষণের আকুতি জানিয়েছেন।
বাড়ি থেকে বেশ কিছুটা দূরে এলাকার গোরস্তান। প্রতিবেদককে হৃদয়ের কবর দেখাতে নিয়ে যান তার বাবা। তার চোখ ছলছল করছিল। আকাশজুড়ে কালো মেঘ। কিছুক্ষণের মধ্যে শুরু হলো গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। বৃষ্টির পানির ফোঁটা আর চোখের জল মিশে একাকার ছেলে হারা বাবা শাহ আলম হাওলাদারের। সন্তানের জন্য শুধু দোয়া চেয়ে বিদায় দিলেন এ প্রতিবেদককে।
এসআই