ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

স্পেন

থাইল্যান্ড থেকে জেসমিন পাপড়ি

থাই রাজার জন্য বাংলাদেশের প্রার্থনা

জেসমিন পাপড়ি, ডিপ্লোম্যাটিক করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮০১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৯, ২০১৫
থাই রাজার জন্য বাংলাদেশের প্রার্থনা ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

Jasmin_papri_1ব্যাংকক থেকে: থাইল্যান্ডে বাংলাদেশ দূতাবাস প্রতিষ্ঠার ৪০ বছর পূর্ণ হলো। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের শুভক্ষণে থাই রাজা ভূমিবল আদুলইয়াদেজ, যিনি ‘কিং রামা নাইন’ নামেও পরিচিত- তার সুস্বাস্থ্য, দীর্ঘায়ু ও মঙ্গল কামনা করে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের দ্বারা একটি বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করে বাংলাদেশ দূতাবাস।



ভূমিবলের ৮৮তম জন্মদিনের এই বিশেষ প্রার্থনাটি ছিল একদমই ভিন্নধর্মী। যেখানে প্রাচীন বৌদ্ধ ধর্মীয় কায়দায় প্রায় দুই শতাধিক বাংলাদেশি বৌদ্ধ ভিক্ষু মন্ত্রজপে অংশ নেন।

এই অভিনব অনুষ্ঠানের নামকরণ করা হয় বাংলাদেশ থাইল্যান্ড বৌদ্ধ-মৈত্রী। যা দু’দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে একটি নতুন মাত্রা সূচনা করেছে।

প্রার্থনা অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন থাই প্রধানমন্ত্রীর সংযুক্ত মন্ত্রী ও রাজ পরিবারের সদস্য মমলুয়াং পানাড্ডা ডিসকুল। এ অনুষ্ঠান সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, বাংলাদেশ দূতাবাসের ৪০তম বার্ষিকী উপলক্ষে থাই রাজার প্রতি যে ভালোবাসা প্রদর্শন করা হয়েছে, তা এখানকার জনগণের হৃদয় ছুঁতে সক্ষম হয়েছে। এমন একটি অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য আমরা বাংলাদেশ দূতাবাস ও বাংলাদেশ সরকারের প্রতি দারুণভাবে কৃতজ্ঞ।

থাই জাতীয় বৌদ্ধ কাউন্সিল মিলনায়তনে দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় পুরোহিতের নেতৃত্বে থাইল্যান্ডে অধ্যয়নরত প্রায় তিন শ’ ভিক্ষু এই বিশেষ প্রার্থনা সভায় অংশ নেন। এ সময় মিলনায়তনে আরও প্রায় তিন শ’ আমন্ত্রিত অতিথি, কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রদূত, থাইল্যান্ডে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশি, থাই পররাষ্ট্র মন্ত্রীর স্ত্রী এবং ইউনাইটেড নেশনস ইকোনমিক অ্যান্ড সোস্যাল কমিশন ফর এশিয়া অ্যান্ড দ্য প্যাসিফিক (ইউএনইএসসিএপি), জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি-ইউএনডিপিসহ আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধি, স্কুল শিক্ষার্থী এবং ব্যবসায়ীরা উপস্থিত ছিলেন।

এই প্রার্থনা সভায় বাংলাদেশ থেকে ১১ সদস্যের প্রতিনিধি নিয়ে অংশ নেন বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি-প্রচার সংঘ ও মহাধ্যক্ষ ধর্মরাজিক বৌদ্ধ মহাবিহারের সভাপতি সংঘনায়ক শুদ্ধানন্দ মহাথেরো। প্রায় আধা ঘণ্টাব্যাপী প্রার্থনায় পুরোহিত ও ভিক্ষুদের সঙ্গে গলা মেলান মিলনায়তনে থাকা থাই নাগরিকরাও।

প্রার্থনা সভার পর রাজা ভূমিবলের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে থাইল্যান্ডের বাংলাদেশ কমিউনিটি। মোমবাতি হাতে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রার্থনামূলক দু’টি গান পরিবেশন করেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। এ সময় পুরো মিলনায়তন দুই জাতির সাংস্কৃতিক মিলন স্থলে পরিণত হয়।

এ সময় থাইল্যান্ডের পক্ষ থেকে বাংলাদেশেকে একটি বৃহৎ আকারের ব্রোঞ্জের তৈরি বৌদ্ধ মূর্তি উপহার দেওয়া হয়। বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এবং শুদ্ধানন্দ মহাথেরো তা গ্রহণ করেন।

দুই পর্বের অনুষ্ঠানের প্রথমভাগে ‘বাংলাদেশ-থাই শ্রী বৌদ্ধ মৈত্রী: সাংস্কৃতিক কানেক্টিভিটি জোরদারকরণ:’ শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। এই পর্বে বাংলাদেশ দূতাবাসের আমন্ত্রণে প্রধান অতিথি হিসেবে অংশ নেন থাই সংস্কৃতি মন্ত্রী ভীরা রজপোজানারাত।

অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে বৌদ্ধ ধর্মের উৎপত্তি ইতিহাস এবং পালি ভাষার বিস্তার ও শিক্ষা বিষয়ক দু’টি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশের বৌদ্ধ গবেষক করুণাংশ বড়ুয়া এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পালি স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান ড. দীপঙ্কর বড়ুয়া।

সেমিনারে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সাইদা মুনা তাসনিম বৌদ্ধ মৈত্রী সম্পর্কে বলেন, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হিসেবে আমরা গর্বিত। কিন্তু আমাদের সংবিধানের অন্যতম মূলনীতি ধর্ম নিরপেক্ষতা। মুসলিমদের পাশাপাশি বৌদ্ধ, হিন্দু, খ্রিস্টানসহ বিভিন্ন ধর্মের মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে বাংলাদেশে বসবাস করছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বাস করেন- ধর্ম যার যার, উৎসব সবার। এ নীতি অনুসারে আজ একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ বাংলাদেশ ও একটি বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ থাইল্যান্ড ধর্মীয় সম্প্রীতি উদযাপন করছে।

তিনি বাংলাদেশে থাইল্যান্ডের বৌদ্ধ মৈত্রীর ইতিহাস তুলে ধরে বলেন, দু’দেশের বৌদ্ধ মৈত্রীর ইতিহাস বাংলাদেশের জন্মেরও অনেক আগে থেকে শুরু হয়েছে। বর্তমান রাজা, এমনকি রাজপুত্রও বাংলাদেশের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের আমন্ত্রণে ঢাকা সফর করেছেন। এই অনন্য অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডের মধ্যকার শত বছরের পুরোনো যোগসূত্রকে অনুপ্রাণিত করা হচ্ছে।

শতকের পর শতক ধরে কিছুটা ফিকে হয়ে যাওয়া এই বৌদ্ধ যোগসূত্র আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

করুণাংশ বড়ুয়া বলেন, বাংলাদেশের বৌদ্ধদের ইতিহাস হাজার বছরের পুরোনো। কিন্তু তার কোনো প্রচার নেই, ইতিহাসের চর্চা নেই। পণ্ডিত অতীশ দিপঙ্করের শৈশব কেটেছে মুন্সীগঞ্জের বিক্রমপুরে। পরে তিনি বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারে তিব্বতের দিকে চলে যান। সারাবিশ্ব এই পণ্ডিত মানুষটিকে চেনে, কিন্তু আমরা কতটুকু জানি তার সম্পর্কে?

আসিয়ান অঞ্চলের মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বুদ্ধিজমে উচ্চ শিক্ষা নিতে থাইল্যান্ডে আসেন। এদেশের মহাচুলা, মহামঙ্কুটও মাতিল বিশ্ববিদ্যালয় ও ইন্টারন্যাশনাল বুদ্ধিজম কলেজ এবং অসংখ্য বৌদ্ধ ধর্মীয় মন্দিরে প্রায় পাঁচশ বাংলাদেশি ভিক্ষুসহ হাজার হাজার বিদেশি ভিক্ষুরা পড়াশোনা করছেন। এর মধ্যে, মায়ানমার থেকে আগত ভিক্ষুর সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি।

এ পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রদূত তার সেমিনারে বলেন, দূতাবাসের ৪০তম বার্ষিকীতে বাংলাদেশ-থাই বৌদ্ধ মৈত্রী উদযাপনের পেছনে প্রধানত তিনটি উদ্দেশ্য রয়েছে। থাইল্যান্ডে বসবাসরহ বাংলাদেশি ভিক্ষুদের থাই ধর্মীয়, রাজনৈতিক অঙ্গনে তুলে ধরা এবং তাদের জন্য আরও থাই স্কলারশিপের সংখ্যা বাড়ানো। এদেশে বসবাসরত প্রবাসী বাঙালিদের একটি শান্তিকামী ধর্মনিরপেক্ষ এবং প্রগতিশীল রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থাপন করা। আর থাইল্যান্ডসহ আশেপাশের বৌদ্ধ ধর্মগরিষ্ঠ আসিয়ান দেশগুলোর কাছে বাংলাদেশের প্রাচীন এবং বর্তমান বৌদ্ধ কৃষ্টির প্রতি আকৃষ্ট করা। যাতে বাংলাদেশের বৌদ্ধ ধর্মীয় ট্যুরিজম বৃদ্ধি পায়।

অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী ভিক্ষুরা ছিলেন আবেগ-আপ্লুত। অনেকের চোখে আনন্দাশ্রুও দেখা যায়। এর কারণ ব্যাখ্যায় থাইল্যান্ডে বসবাসরত বাংলাদেশি আমেরিকান সিনিয়র একজন ভিক্ষু বলেন, গত ৪০ বছর ধরে থাইল্যান্ডে বসবাস করছি। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়ে বাংলাদেশকে এমন কোনো অনুষ্ঠান আয়োজন করতে দেখিনি। এই ধরনের অনুষ্ঠান ভবিষ্যতে বাংলাদেশের প্রতি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী দেশগুলোর মনোভাবের আমূল পরিবর্তন আনতে পারে।

অনুষ্ঠান শেষে দু’দেশের ধর্মীয় গুরু, বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও থাই মন্ত্রীর সঙ্গে ছবি তোলায় মেতে ওঠেন বৌদ্ধ ভিক্ষুরা। অংশ নেন বাংলাদেশি ও থাই নাগরিকরাও। যা দেখে এই অনুষ্ঠানকে মুসলিম-বৌদ্ধ ধর্মীয় সম্প্রীতির এক অনন্য উদাহরণ বলতে বাধ্য হবে যে কেউ।

বাংলাদেশ সময়: ১৭৫৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৯, ২০১৫/আপডেট ২০২৬
জেপি/আইএ

** রাজার জন্য যতো ভালোবাসা!

** থাইল্যান্ডে বাংলাদেশিদের ‘শক্তি’
** রেন্টে বাইক!
** গাড়ির হর্নবিহীন শহর
** সময়ানুবর্তী রিজেন্ট এয়ার
** কলম দেখলেই এগিয়ে আসেন তারা!

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

স্পেন এর সর্বশেষ