ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১০ অক্টোবর ২০২৪, ০৬ রবিউস সানি ১৪৪৬

খেলা

এক মাঠেই সব খেলা!

আবীর রহমান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট (স্পোর্টস) | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৫৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২৩
এক মাঠেই সব খেলা!

যশোরের একমাত্র স্টেডিয়াম শামস-উল-হুদা স্টেডিয়াম। ক্রিকেট, ফুটবল থেকে শুরু করে হকি, অ্যাথলেটিকস সব খেলাই হয় এই একই স্টেডিয়ামে।

যশোরের টুর্নামেন্ট আয়োজনের জন্য সবেধন নীলমণি এই স্টেডিয়াম।  

আজ (২০ ফেব্রুয়ারি) এই স্টেডিয়ামেই আয়োজিত হয়েছে জাতীয় নারী হ্যান্ডবল লিগের সেমিফাইনাল এবং ফাইনাল ম্যাচ। দুদিন পরেই এই মাঠে শুরু হবে প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লিগ। মূলত ক্রিকেট লিগের মাঝেই বিরতি দিয়ে এখানে আয়োজিত হয়েছে নারী হ্যান্ডবল চ্যাম্পিয়নশিপ।

যশোর জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক ইয়াকুব কবীর জানালেন স্টেডিয়ামে নিয়ে নিজের হতাশার কথা। অনেক চেষ্টা করেও স্টেডিয়াম সংকট দূর করতে পারছেন না তিনি। জানালেন, নানান প্রতিবন্ধকতার কথা। তিনি বলেন, নতুন স্টেডিয়াম করার মতো পর্যাপ্ত জায়গা পাচ্ছেন না, বর্তমান স্টেডিয়াম সংস্কারের কথা থাকলেও আর্থিক অনুদানের ফাইল আটকে আছে মন্ত্রণালয়ে।  

আগে যশোর থেকে ভালো মানের খেলোয়াড় উঠে এলেও বর্তমানে তেমন একটা দেখা যাচ্ছে না। এর কারণ জানতে চাইলে ইয়াকুব কবির বলেন, ‘কোনও জেলা ক্রীড়া সংস্থার তত্ত্বাবধানে কোনও খেলোয়াড় এখনো বের হয়নি। মাশরাফি কিংবা সাকিব জেলা ক্রীড়া সংস্থার মাধ্যমে আসেনি। তারা বিকেএসপিতে চান্স পেয়েছে, সেখান থেকে খেলে এসেছে। আমাদের ভালো মানের খেলোয়াড় আছে। খুব বেশি যোগ্যতা ছাড়া কিন্তু বেশি দূর যাওয়া যায় না। এভারেজ মানের খেলোয়াড় হলে বেশি দূর যাওয়া যায় না। আজকে ক্রিকেট বলেন ফুটবল বলেন যে কোনও খেলার মধ্যেই কিন্তু রাজনীতি ঢুকে আছে। ’

নানান সীমবদ্ধতা থাকলেও ভালো খেলোয়াড় তৈরির জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন ইয়াকুব কবির। ভালো খেলোয়াড় তৈরিতে মূল বাধা খেলার জায়গার সীমাবদ্ধতা। নিয়মিত সব ধরনের খেলারই কোচিং চলছে যশোরে এমনটাই জানিয়েছেন তিনি। তবে সব কিছুর জন্যই বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে স্টেডিয়াম। ইয়াকুব বলেন, ‘আমরা প্রতিটা খেলারই নূন্যতম ট্রেনিং করাচ্ছি। কাবাডি বলেন, হ্যান্ডবল বলেন সব খেলারই ট্রেনিং চালিয়ে যাচ্ছি। বড় সমস্যা হচ্ছে মাঠ একটা। সব খেলা এই মাঠের ওপর নির্ভর করে। হকি লিগ চলছিল এর মাঝেই, আবার হ্যান্ডবলও। হকি লিগ বন্ধ করে হ্যান্ডবল চালাতে হচ্ছে, আবার পরশু দিন থেকে হকি লিগ শুরু হবে। এরপর এই মাঠেই আবার হবে ক্রিকেট লিগ। একটা মাঠের ওপর সমস্ত খেলা নির্ভর করে। ’

তিনি আরও বলেন, ‘আমার যশোরে ভালো মানের খেলোয়াড় আছে। আমরা প্লেয়ার বানাচ্ছি, আমরা কোচিং করাচ্ছি, আমরা নিয়মিত খেলাচ্ছি। ভালো মানের খেলোয়াড় তারা। তারা যুব গেমসে ভালো করছে। আপনি হ্যান্ড বলের কথাই ধরুন খাদিজা, পান্না এরা আমাদের সৃষ্টি। আমরা তাদের তৈরি করলাম। তারা সকলের নজরে আসলো, কিন্তু আনসার তাদের নিয়ে গেল। ’

মাঠের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য চেষ্টা করলেও তা জেলা ক্রীড়া সংস্থার হাতে নেই বলে জানিয়েছেন ইয়াকুব। এছাড়া স্টেডিয়ামের সংখ্যা বাড়ানোর মতো তেমন পর্যাপ্ত পরিমাণে খালি জমিও নেই বলে জানিয়েছেন তিনি। ইয়াকুব বলেন, ‘মাঠের সংখ্যা বাড়ানো তো আর আমাদের হাতে না। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এখানে এসে বলে গিয়েছিলেন মাঠ এবং গ্যালারির উন্নয়ন করা হবে। ৫২ কোটি টাকার প্রজেক্টের কথা বলা হয়েছিল। তার মধ্যে ২৬-৩২ কোটি টাকার প্রজেক্ট পাস হয়েছে। সেই ফাইল ৫-৭ মাস ধরে অর্থ মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। হয়তো অফিসিয়াল কোনও জটিলতা রয়েছে। ’

তিনি আরও বলেন, ‘যশোরে যে জায়গা তাতে নতুন স্টেডিয়াম বানানোর জন্য তেমন সুযোগ নেই। লন টেনিস বানানোর জন্য এসেছিল ২-২.৫ কোটি টাকার প্রজেক্ট পাশ হয়েছিল কিন্তু আমাদের জায়গা নেই বলে সেটা বানানো হয়নি। পরে যশোর ক্লাবকে সেটা হস্তান্তর করা হয়েছে। ইনডোর করতে গেলে যে জায়গা লাগে আমাদের কাছে সেটা নেই। আমাদের এই স্টেডিয়াম, তার পাশে জিমনেশিয়াম, বাস্কেটবল কোর্ট, ভলিভল কোর্ট এই পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। এরে মধ্যেই সব চলছে। কাবাডি খেলতে পারতাম না আমরা, পরে ডিসি সাহেবের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে আমরা টাউন হল ময়দানে কাবাডি লিগ করি। ’

একমাত্র এই মাঠের অবস্থাও ভালো না। এই মাঠে বর্ষাকালে খেলা চালানো কঠিন হয়ে যায়। বৃষ্টি হলেই মাঠের অবস্থা নাজুক হয়ে যায় বলে জানিয়েছেন ইয়াকুব। তিনি বলেন, ‘এই মাঠটা রাস্তা থেকে দুই ফুট নিচে। এটা কিছুটা উন্নয়ন করতে পারলে তাও অনেকটা সুবিধা হতো। ৫ মিনিট বৃষ্টি হলে ৫ দিন এই মাঠে খেলা যায় না। ’

স্টেডিয়াম সংকটের জন্য জেলা ক্রীড়া সংস্থার ওপরও কি কিছুটা দায় বর্তায়? এমন প্রশ্নের জবাবে ইয়াবুক বলেন, ‘না জেলা ক্রীড়া সংস্থার ব্যর্থতা না। আমাদের কিছু করার নাই। কোনও প্রজেক্ট অটোমেটিক পাস হবে না। লোকাল যে নেতারা আছেন তারা নিজেরা বের করে না নিয়ে আসলে তো হবে না। আমি একটা উদাহরণ দিই, কুষ্টিয়া স্টেডিয়াম ভেঙে নতুন করে স্টেডিয়াম করলো হানিফ ভাইয়ের (মাহবুবুল আলন হানিফ, কুষ্টিয়া-৩ আসনের সংসদ সদস্য) কারণে। হানিফ ভাই করাচ্ছে বলে হচ্ছে। রাস্তা-ঘাট সব কিছু করে ফেলেছেন। খুলনা স্টেডিয়ামও সুন্দরভাবে করা হয়েছে। যশোরেরটা করানো হয়নি। ’

যশোর-৩ আসনের এমপি কাজী নাবিল আহমেদ। তিনি বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) সহ-সভাপতি এবং ন্যাশনাল টিম কমিটির চেয়ারম্যান। তার কাছে এই সমস্যারর কথা বললেও কোনও সমাধান মেলেনি বলে জানিয়েছেন ইয়াকুব। তিনি বলেন, ‘কাজী নাবিল আহমেদ খেলার মাঠের লোক। আমি ওনাকে বারবারই এই প্রজেক্টের কথা বলেছি। উনি আমাকে বলেছেন কবির ভাই আমি কথা বলেছি। কিন্তু এভাবে বললে তো হবে না। এটা হাতে ধরে করিয়ে আনতে হবে। ’

‘আমাদের ক্ষমতা ঐ পর্যন্ত নাই তো। আমি একটা কথা বলি, আমি জেলা ক্রীড়া সংস্থার জেনারেল সেক্রটারি। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা আমি রাজনীতি করি না। আমারতো মন্ত্রণালয়ে গিয়ে পাশ করানোর ক্ষমতা নেই। আমার যতটুকু করার আমি করেছি। এনএসসিতে (জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ) আমার কিছু জানাশোনা আছে, ইঞ্জিনিয়ারকে বলে-কয়ে আমি পাঠিয়েছি, ফাইলে কিছুটা সংশোধন ছিল, আমি সংশোধন করে পাঠিয়েছি। বাকিটুকুতে তো আমার হাত নেই। আমি পারবো না। আমি বারবার বলেছি, দুই এমপিকে বলেছি, শাহেদ চাকলাদারকে বলেছি, তারা বলেছেন করে দেবেন। তবে নিজে বসে থেকে কাজ না করালে হয় না। ’

তাহলে কি ক্রীড়া সংস্থার সঙ্গে রাজনৈতিক জটিলতার কারণেই স্টেডিয়ামের সংস্কার কাজ আটকে আছে? এমেন প্রশ্নের জবাবে ইয়াকুব বলেন, ‘রাজনৈতিক জটিলতা আমাদের সঙ্গে না। আমি এখানে যারা নেতা আছেন তারাসহ ডিসি মহদোয়কেও বলেছি আপনার তো প্ল্যানিং মিনিস্ট্রিতে জানা-শোনা আছে একটু বলে দেখেন হয় কিনা। ’

স্টেডিয়াম সংস্কার এবং উন্নয়নের ক্ষেত্রে কর্তাব্যক্তিদের মধ্যে আন্তরিকতার অভাব অনুভব করছেন জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক ইয়াকুব কবির। তিনি বলেন, ‘ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) আমি আগে কাউন্সিলর ছিলাম। তবে সেই কাউন্সিলরশিপ এনাম সাহেব আমার কাছ থেকে নিয়ে নিয়েছেন। ওনারা ঢাকায় থাকেন, যশোরের সঙ্গে তাদের তো কোনও ই.. নাই। আমাকে বারবারই বলেন, ক্রিকেট মাঠের জন্য জায়গা দেখেন মাঠ করবো। ঐ বলে চলে গেলেন আর এক বছরের মধ্যে আসেন না। আপনারা যদি আন্তরিকতা না দেখান তবে হবে? আপনাকে আন্তরিকতা দেখাতে হলে জেলার লোক হতে হবে। আপনাকে দরদ আনতে হবে তারপর এটা হবে। ’

যশোরের মাঠে ফুটবল খেলাটা বেশ অনিয়মিতই বলে জানিয়েছেন ইয়াকুব। তিনি বলেন, ‘যশোরে যে ফুটবল পরিষদ আছে ডিএফএ বলে এটাকে। ডিএফএ প্রেসিডেন্ট আসাদুজ্জামান মিঠু সাহেব আজ চার-পাঁচ বছরের মধ্যে লিগ করতে পারে না। এই বছরে দুই মাস ষোলো দিন মাঠ দিয়েছিলাম। ১০টা টিম নিয়ে লিগ আয়োজন করেছিলেন, শেষ করতে পারেননি। এখন ক্রিকেটের লিগ চলছে, এখন মাঠ চাচ্ছে। ক্রিকেটের ফার্স্ট ডিভিশন, সেকেন্ড ডিভিশন মিলিয়ে ১২০-৩০টা ক্লাব লিগ চলছে। এখন মাঠ চাইলে তাকে মাঠ দেয়া যায়? জুন-জুলাইতে ১০টা দলের খেলা ১৬-১৮ দিন লাগে শেষ করতে। দুই মাস ১৬ দিন দিলাম, এরমধ্যেও শেষ করতে পারেনি। এখন তারা মাঠ চাচ্ছে। এর মধ্যে কি মাঠ দেয়া সম্ভব?'

এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের একটাই উপায় দেখছেন জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক। আর তা হচ্ছে, কর্তাব্যক্তিদের আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করা।

বাংলাদেশ সময়: ২০৫৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২৩
এআর/এমএইচএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।