ঢাকা: মিরপুর থেকে আশুলিয়ার স্টারলিং ক্রিয়েশন কারখানায় যখন পৌঁছালাম ঘড়ির কাঁটা ১টা ছুই ছুই। স্টারলিং গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে কর্মরত বাংলা ধারাভাষ্যের জীবন্ত কিংবদন্তি আলফাজউদ্দিন আহমেদ।
টেবিলের উপর সাদা কাগজে টুকে রাখা বেশ কযেকটি নাম-বদরুল হুদা চৌধুরী, মোহাম্মদ শাহজাহান, তৌফিক আজিজ খান, নূর আহমেদ, আতাউল হক মল্লিক, খোদা বক্স মৃধা, আব্দুল হামিদ, মোহাম্মদ মুসা ও মঞ্জুর হাসান মিন্টু। খ্যাতিমান এই নয়জন ধারাভাষ্যকারের সঙ্গে বহুবার ক্রিকেট-ফুটবলের ম্যাচে ধারাভাষ্য দিয়েছেন আলফাজউদ্দিন। এদের কেউই আজ পৃথিবীতে নেই। বাংলা ধারাভাষ্যের দিকপাল হয়ে আছেন এই আলফাজউদ্দিন।
নামগুলোতে চোখ বুলিয়ে দীর্ঘশ্বাস নিলেন ৭০ ছুঁই ছুঁই এই ধারাভাষ্যকার। ফিরে গেলেন ১৯৮১ সালে। ওই বছরই বাংলাদেশ বেতারে প্রথমবার ধারাভাষ্য দিয়েছিলেন আলফাজউদ্দিন, ‘বাংলাদেশ বেতারের অডিশনে পাশ করে আবাহনী-মোহামেডান ফুটবল ম্যাচে ঢাকা স্টেডিয়ামে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম) আমাকে ধারাবর্ননার সুযোগ দেয়া হয়। আশির দশকে মাঠে যত মানুষ থাকতো, তত মানুষ মাঠের বাইরে থাকতো। ফুটবল মানেই তখন চরম উত্তেজনা। তার উপর আবাহনী-মোহামেডান হাইভোল্টেজ ম্যাচ। ভাষ্যকার হিসেবে আব্দুল হামিদ ও মঞ্জুর হাসান মিন্টু। হামিদ ভাই বললেন, তুমি মাঝখানে বসো। যখন ভলিবল খেলতাম তখন হামিদ ভাই পাকিস্তান ভলিবলের সেক্রেটারি ছিলেন। সে হিসেবে আমাকে তিনি চিনতেন। ধারাবর্ননা করি সেটা তিনি প্রথমে জানতেন না। তারা দু’জন কিছুক্ষণ ধারাভাষ্য দিয়ে আমার সামনে মাইক্রোফোন দিলেন। ‘বিসমিল্লাহ’ বলে শুরু করলাম। আমি প্রচন্ড নার্ভাস ছিলাম কারণ, ধারাভাষ্যের দুই জায়ান্টের সঙ্গে আমি। হামিদ ভাইয়ের কণ্ঠ, বলার ভঙ্গি সবসময় আমাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতো। তিনি আমার পিঠে হাত রাখলেন আদর করে দেয়ার মতো করে। আমি সাহস পেলাম। হামিদ ভাই বললেন, আমি প্রত্যাশা করিনি এতো ভালো করবে তুমি। ’
সেই শুরু আলফাজউদ্দিন আহমেদের। এরপর পেরিয়ে গেছে তিন যুগ। শ্রুতিমধুর কণ্ঠ, কথা বলার অসাধারণ ভঙ্গি আর বিশ্লেষণী ক্ষমতা দিয়ে শ্রোতামহলে জনপ্রিয়তা পান তিনি। শ্রোতাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখেন এখনও। দেশের ভেতর ক্রিকেট ও ফুটবলের অসংখ্য ম্যাচ ছাড়াও চারটি ওয়ানডে ও তিনটি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ধারাভাষ্য কক্ষ থেকে বাংলাদেশ বেতারের মাধ্যমে ম্যাচের চলতি ধারাবিবরণী দিয়েছেন তিনি।
বাংলাদেশ জাতীয় ভলিবল দলের সাবেক খেলোয়াড় আলফাজউদ্দিন আহমেদ ক্রিকেটও খেলেছেন বহুদিন। খেলোয়াড়ি জীবন সম্পর্কে জানতে চাইলে শুরু করলেন শৈশব থেকে, ‘আমাদের ছোটবেলা কেটেছে কুষ্টিয়ায়। এরপর ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি। আমরা চার ভাই। বড় ভাই প্রখ্যাত চলচ্চিত্র অভিনেতা আহম্মেদ শরীফ। আমার ছোট দুই ভাই জমজ-নিজামউদ্দিন আহমেদ ও মঈনউদ্দিন আহমেদ। নিজাম আবাহনী ও মোহামেডানে দীর্ঘসময় ফুটবল খেলেছে, জাতীয় দলে খেলেছে। মঈনও ফুটবল খেলতো। তবে বড় কোনো ক্লাবে খেলেনি। আমিও ফুটবল খেলতাম, ঢাকায় খেলিনি। তবে আমরা তিন ভাই একসাথে বাংলাদেশ ভলিবল দলে খেলেছি। ১৯৬৫ সালে বিখ্যাত অ্যাথলেট খন্দকার আবুল হাসান ভাইয়ের প্রচেষ্টায় ভলিবল খেলা শুরু করি। তিনি (খন্দকার আবুল হাসান) সোনালী ব্যাংকে খেলতেন, আমি তখন মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে। ১৯৬৬ থেকে স্বাধীনতা পর্যন্ত সোনালী ব্যাংকে খেলেছি। ওই সময় আমাদের হারানো কঠিন ছিল। আমাদের পরিবারের মধ্যে খেলাধুলার চর্চা খুব বেশি ছিল। ক্রিকেটের ক্ষেত্রে আমরা চার ভাই কুষ্টিয়া জেলা দলে ক্রিকেট খেলেছি। আমি ছিলাম উইকেটকিপার কাম ব্যাটসম্যান। ’
১৯৬৮ সালে ব্যাংকার হিসেবে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন আলফািউদ্দিন। ব্যাংকার হিসেবেও সফল ছিলেন তিনি। হয়েছিলেন রুপালি ব্যাংকের এজিএম। কর্মজীবন শুরু করলেও ক্রিকেট খেলা থামাননি, ‘অস্ট্রেলেশিয়া ব্যাংকে (বর্তমানে রুপালি ব্যাংক) আমি প্রবেশনারি অফিসার হিসেবে জয়েন করি। স্বাধীনতার পর রুপালি ব্যাংক ক্রিকেট টিম করে। সেই দলে অধিনায়কত্ব করি। দ্বিতীয় বিভাগে আমাদের দলে প্রয়াত আব্দুল হাদি রতন, বেলাল, ফারুক, সুরু, প্রিন্সরা খেলেছে। পরের বছরই আমরা প্রথম বিভাগে উঠি। দলের যে স্ট্যান্ডার্ড ছিল, সে স্ট্যান্ডার্ড আমি মেইনটেইন করতে পারছিলাম না। তখন আমি সরে যাই। তখন দল পরিচালনার দায়িত্ব আমার উপরে পড়ে। মনে আছে, চট্টগামে একটি টুর্নামেন্টে আমরা কলকাতা মোহনবাগানকে হারিয়েছিলাম। ’ চলবে...
বাংলাদেশ সময়: ১৮৩৫ ঘণ্টা, ০৫ আগস্ট ২০১৬
এসকে/এমআরপি
** বাংলা ধারাভাষ্যের আদ্যোপান্ত জানাবে বাংলানিউজ
** প্রয়াত ধারাভাষ্যকারদের স্মৃতিচারণ করবে কমেন্টেটরস ফোরাম