আফতাবনগর এমনিতেই একটু ঝিমিয়ে পড়া জায়গা। শহুরে কোলাহল নেই, আছে কৃষ্ণচূড়া গাছের সৌন্দর্য।
পথ চলতে চলতেই ছোট্ট একটা মাঠের দেখা পাওয়া গেল, দুই-তিন রঙের জার্সি গায়ে ক্রিকেট অনুশীলনের ব্যস্ততা সেখানে। তারও আগে চোখ আটকাল মাঠের ঠিক সামনের রাস্তার চেয়ারে। কয়েকজন মধ্য-বয়সের নারী আর একজন পুরুষ দাঁড়িয়ে।
কৌতূহলী চোখে তাদের নজর ছোট্ট মাঠটিতে। এখানেই বেড়ে উঠছে সন্তানের স্বপ্ন। ছুটির দিনের আয়েশের চেয়েও এটা তাদের কাছে বেশি দামী। কিছুক্ষণ তাদের চঞ্চল চোখে তাকিয়ে থাকা দেখে জানতে ইচ্ছে করল- ছুটির দিনে এখানে বসে থাকতে ক্লান্ত লাগে না?
১২ বছরের বায়েজিদ বোস্তামি খেলছে ঢাকার মিলন ক্রিকেট একাডেমিতে। এবার তাদের খেলার কথা মোহামেডান অনূর্ধ্ব-১২ টুর্নামেন্টে। রেজিস্ট্রেশন না থাকায় আসতে হয়েছে বনশ্রীতে। খিলক্ষেত থেকে তাই ছেলেকে নিয়ে এসেছেন আছিয়া বেগম। তার কাছেই জানতে চাওয়া ক্লান্তির কথা।
জবাবটা ছিল এমন, ‘ছেলের হাসি দেখলে ক্লান্ত লাগে না। সংসারের কাজ সামলে এসব তো কঠিন। কিন্তু ও খেলতে পারলে হাসে, আনন্দ করে; এটা দেখেই শান্তি লাগে। সব ক্লান্তি শেষ হয়ে যায়। বাবা-মা হয়ে এর চেয়ে বেশি কী দরকার?’
বায়েজিদের মায়ের প্রশ্নটার উত্তর আপাতত নেই। সন্তানের স্বাদ পাওয়া কেউই হয়তো বলতে পারবেন ভালো। পাশেই বসে ছিলেন মুন্সী মুহাম্মদ জালাল উদ্দিনের স্ত্রী রোকেয়া বেগম। পেশায় তিনি শিক্ষক, রাজধানীরই একটি স্কুলের প্রিন্সিপাল।
তার কাছে জানতে চাওয়া, সন্তানের আগ্রহটা কেমন? এর চেয়ে বেশি দরকারীই বা কী? তিনি বললেন, ‘আমার ছেলের খুব আগ্রহ। ও জাতীয় দলে খেলবেই- এটা ওর স্বপ্ন। কালকে যেমন স্কুল থেকে ফিরতে একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল। ততক্ষণে ক্রিকেট কোচিংয়ের সময় শেষ। এরপর কান্না শুরু করল, কিছুতেই আর বোঝাতে পারি না। আজকে তাই আগেই এনে বসিয়ে রেখেছি। ’
স্কুল শিক্ষিকা ভদ্র মহিলা জানালেন, কীভাবে পেশা ও সংসার সামলে ছেলেকে নিয়ে এই মাঠ থেকে ওই মাঠে দৌড়ান। ছেলের ক্রিকেট নিয়ে অস্থিরতা কীভাবে তাকে শেখায় অপেক্ষা করতে। স্বামী ব্যবসায়ী মুন্সী জালাল উদ্দিন তখন পাশেই দাঁড়িয়ে।
তিনি বললেন, ‘আমার তেমন ইচ্ছে ছিল না শুরুতে। কিন্তু ছেলের আগ্রহের কারণে এখন নিজের মধ্যেও একটা ইচ্ছে জন্মেছে। প্রতিদিনই ওকে নিয়ে আমি বা ওর মা আসি। কারো না কারো থাকতে হয়। ’
এখনকার ক্রিকেটে টাকা আছে। তারকাখ্যাতিও মেলে মুহূর্তেই। এজন্যই কি ক্রিকেটের প্রতি এত তুমুল আগ্রহ? ৮ বছরের আফ্রিদি ইসলাম ইউষার মা এমন প্রশ্নের পর বললেন, তার ছেলের ক্রিকেট প্রেমের শুরুটা দুই বছর বয়সে; দেশসেরা তারকা সাকিব আল হাসানের হাত ধরে।
ছেলের আগ্রহের শুরুর কথা শোনাতে গিয়ে তিনি বলছিলেন, ‘ওর বাবা সাকিব আল হাসানের একটা ছবি টাঙিয়ে রেখেছিল আমাদের বাসায়। আফ্রিদির বয়স যখন দুই বছর, তখন ও বারবার গিয়ে এটা জড়িয়ে ধরতো। খেলাতো বুঝতো না, শুধু গিয়ে সাকিব সাকিব করতো। আমরা বলতাম এটা কে বলো তো বাবা? ও বলতো, সাকিব!’
‘সেই শুরু। তখন ওর বাবা কাঠ দিয়ে ছোট করে একটা ব্যাট বানিয়ে দিল, প্লাস্টিকের বল আনল। আমাদেরও অনেক আগ্রহ ছিল, সেখান থেকেই যাত্রা শুরু। ’ বলতে বলতে চোখেমুখে অদ্ভূত ভালো লাগা কাজ করে আফ্রিদির মায়ের।
ধীরে ধীরে বিকেল পেরোয়। আফ্রিদিদের তাড়া দেন কোচ। একটু হাঁপিয়ে উঠলেই মেলে কড়া শাসন। ছয় মিনিটের বিরতিতে তাদের ক্লান্তি কাটে না। ৮-১০ বছর বয়সেই বয়ে বেড়াতে হয় ভারি ভারি ব্যাট-প্যাড-হেলমেট। ক্যাচ ধরার অবিরাম চেষ্টা বেশির ভাগ সময়ই ব্যর্থ হয়; সফল হলেই হাততালিতে অভিবাদন মেলে সমবয়সীদের কাছ থেকে।
বাইরে থেকে দাঁড়িয়ে সেসব দৃশ্য অদ্ভূত ভালো লাগার চোখে দেখেন গৃহনী কিংবা কর্মজীবি মায়েরা। তাদের মনে হয়তো খেলা করে স্বপ্ন আর রোমাঞ্চ। অচেনা পথিকের গন্তব্যের ঠিকানাও মিলে যায় একটা সময়- কিন্তু এই বাবা-মায়েদের স্বপ্ন কোথায় গিয়ে থামে; জানা হয় না বেশির ভাগ সময়। কিন্তু এটুকু নিশ্চিত হওয়া যায়- ক্রিকেটেই এখনও পথ খুঁজেন কেউ কেউ।
বাংলাদেশ সময়: ১০৫২ ঘণ্টা, জুলাই ৩০, ২০২২
এমএইচবি/এআর