ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

তারার ফুল

অনুপম রায়ের সঙ্গে কিছুক্ষণ

‘এই গন্ডি আর সীমান্ত হলো বোকা বোকা ব্যাপার!’

জনি হক, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০০২ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৩, ২০১৫
‘এই গন্ডি আর সীমান্ত হলো বোকা বোকা ব্যাপার!’ অনুপম রায় / ছবি: নূর- বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

খেতে ভালো লাগে। মানুষের সঙ্গে আলাপ করতে ভালো লাগে।

ঘুরে বেড়াতেও ভালো লাগে। ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও’- বাক্যটা বললে বুঝে ফেলা যায়, তিনি অনুপম রায়! তার লেখা এমন কিছু বাক্য শ্রোতার মুখে মুখে ফেরে গান আকারে। বাজে মনের মাঝে! 
 
বাংলা গানের গণ্ডি পেরিয়ে বলিউডের ছবিতেও কাজ করেছেন অনুপম। অমিতাভ বচ্চন, দীপিকা পাড়ুকোন ও ইরফান খান অভিনীত চলতি বছরের ব্যবসাসফল ছবি ‘পিকু’র সব গানের সুর ও সংগীত পরিচালনা করেছেন তিনি। ‘বেজুবান’, ‘জার্নি সং’, ‘লামহে গুজার গ্যায়ে’, ‘তেরি মেরি বাতে’ ও ‘পিকু’ গানগুলো প্রশংসিতও হয়েছে। ফলে বেড়েছে তার জনপ্রিয়তা।
 
গত ২৯ আগস্ট চট্টগ্রামে তালাশ মিডিয়া এন্টারটেইনমেন্ট আয়োজিত কনসার্ট করতে এসেছিলেন অনুপম। এর পরদিন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হীরক দাশগুপ্তর সৌজন্যে আগ্রাবাদের একটি হোটেলের ব্যালকনিতে বাংলানিউজের মুখোমুখি হলেন তিনি। প্রায় তিন মাস বাদে জনপ্রিয় এই সংগীতশিল্পী আবার এলেন ঢাকায়। সোমবার (২৩ নভেম্বর) আন্তর্জাতিক কনভেনশন সিটি বসুন্ধরায় সংগীত পরিবেশন করবেন তিনি। এ উপলক্ষে চট্টগ্রামে নেওয়ার তার সাক্ষাৎকারটি পড়ে নিন।
 
বাংলানিউজ : চট্টগ্রামে তো এবারই প্রথম এলেন?
অনুপম রায় : হ্যাঁ। বাংলাদেশে যখনই আসি, ভালো লাগে। তবে চট্টগ্রাম বেশি ভালো লাগছে। কেনো জানি না! প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণেই কি-না। সমুদ্রে বড় বড় জাহাজ, অল্প অল্প বৃষ্টি পড়ছে। অন্যরকম আবহ। চট্টগ্রামে কি রান্না স্পেশাল তা নিয়ে পড়াশোনা করে এসেছি। মেজবানের কথা অনেক শুনেছি। তাই মেজবান খেয়েছি ভালো করে!
 
বাংলানিউজ : অনেক দেশে গেয়েছেন, বাংলাদেশে গান গেয়ে মজা কোথায়?
অনুপম : ভাষাটা মজার! আমার দেশের ভাষায় গান গাইতে পারি একটা গোটা দেশে, দেশের যে কোনো প্রান্তে। এখানে আমি ওভাবে সরাসরি কোনো গান বের করিনি। দু’একটা ছবির গান হয়তো করেছি, তা সত্ত্বেও মানুষ সব গান জানে, সব গান ভালোবাসে। এটা একটা অদ্ভুত মজার দিক।  
 
বাংলানিউজ : এখানকার গান নিশ্চয়ই শোনেন?
অনুপম : এখানকার গানগুলো আমার খুব ভালো লাগে। সুরের মধ্যে অদ্ভুত মাদকতা আছে। সুন্দর সুন্দর সুর তৈরি করা হয় এখানে। স্বাতন্ত্র একটা ব্যাপার আছে, শুনলেই বুঝতে পারি এটা ভালো লাগার জায়গা। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, বাচ্চু ভাই (আইয়ুব বাচ্চু), মাইলস, অর্ণবের গান নিয়মিত শুনি।
 
বাংলানিউজ : ‘চোরাবালি’র পর আর ঢাকার আর কোনো ছবির গানে আপনাকে পাওয়া গেলো না। অথচ ওপারের অনেকেই কিন্তু এখানে হরহামেশা কাজ করছেন। এরপর আর কাজ করেননি কেনো?
অনুপম : আমাকে কেউ বলেনি কাজ করতে। আমাকে কেউ বললেই কাজ করবো।
 
বাংলানিউজ : একটা দেশ থেকে আরেকটা দেশে যেতে অনেক জটিলতা। এ কারণে কালকের কনসার্টে বলছিলেন, পাসপোর্ট চান না। ভিসাও চান না। এটা কি সম্ভব?
অনুপম : এই যে আলাদা আলাদা দেশ, এখন যে জায়গায় গেছে, তাতে কাজটা কঠিন। তবে একটু পরিষ্কারভাবে ভাবলে মানুষ বুঝবে এটা বোকা বোকা ব্যাপার! এই যে জাতীয়তা, গন্ডি, সীমান্ত, এটাতে অসুবিধা ছাড়া সুবিধা কিন্তু হয় না। সবশেষ কথা হলো সবাইকে ভালোবেসে একসঙ্গে থাকতে হবে, এটাই সবচেয়ে কঠিন কাজ। অন্যের দাবি-দাওয়া মেনে, অন্যের তৈরি ইতিহাস নিয়ে বেঁচে থাকতে হচ্ছে। এতেই আমার একটু আপত্তি।
 
বাংলানিউজ : ‘পিকু’তে কাজ করার অভিজ্ঞতা কেমন?
অনুপম : ‘পিকু’ আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ। আমি বাংলায় কাজ করছিলাম, সেগুলো সুজিতদা (পরিচালক সুজিত সরকার) শুনেছিলেন। তার ভালো লেগেছিলো। এরপর তার কথায় ‘পিকু’র জন্য গান বানাতে থাকি। এভাবে শুরু হয়। যেহেতু এটা বড় ক্যানভাসের ছবি, তাই এখানে কাজ করার ধরণটা আলাদা ছিলো। এক বছর ধরে কাজটা করতে হয়েছে।
 
বাংলানিউজ : ‘পিকু’র পর জীবনে কী কী পরিবর্তন এসেছে?
অনুপম : ‘পিকু’ মুক্তির পর এমন এমন কনসার্টের ডাক পেলাম যেখানে বাংলার সঙ্গে হিন্দি গানও করতে হচ্ছে। এ ধরনের কনসার্ট বাড়তে লাগলো। আগে আমার পরিচিতিটা একটা নির্দিষ্ট অঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিলো, মানে বাংলা ভাষাভাষীদের মধ্যে অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গে। সে জায়গাটা পাল্টে মারাঠি, তামিল, তেলেগু, পাঞ্জাবি ভাষাভাষী মানুষদের কাছেও আমার গান পৌঁছালো ‘পিকু’র মাধ্যমে। সুতরাং এটা একটা বড় পরিবর্তন। এরপর এমটিভি কোক স্টুডিওর জন্য কাজ করেছি।
 
বাংলানিউজ : ছোটবেলায় কি হতে চেয়েছিলেন?
অনুপম : প্রথমে ভাবতাম ডাক্তার হবো, যেহেতু আমার বাবা ডাক্তার। তারপর নিজেই ঠিক করলাম ইঞ্জিনিয়ার হবো। তবে ভেতরে ভেতরে ইচ্ছে ছিলো, মানুষকে গান শোনাবো। তখন সংগীত পরিচালক হবো নাকি গায়ক হবো, সেরকমভাবে কিছু ভাবিনি। আমি গান তৈরি করছিলাম, আমার ইচ্ছা ছিলো মঞ্চে উঠে মানুষকে গেয়ে গেয়ে শোনাবো। একটা গীতিকার বা কণ্ঠশিল্পীর যেমন ইচ্ছা থাকে তেমনই।
 
বাংলানিউজ : অনুপমকে ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও’ গানের কথা বললেই চেনা যায়! এই গানের অন্তরালে কি কোনো যন্ত্রণা জড়িয়ে আছে?
অনুপম : গানের গল্প বললে তো বই লেখা হয়ে যাবে! একটা পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম একটা সময়, এটা সে সময়ের গান। এটা অবশ্যই প্রেমের গান। সেই কিছু সময় ও তার আগের কিছু সময়ে ফিরে ফিরে তাকিয়ে ভেবেছি, কী কী হয়েছে, কী কী হয়নি। সেরকম একটা জায়গা থেকে লেখা এই গান।
 
বাংলানিউজ : আপনার গানে কবিতার প্রভাব কতোটা?
অনুপম : আমি দীর্ঘদিন বাংলা কবিতা চর্চা করেছি। এখনও করি। খুব ভালো লাগে আমার। কবিতাটাই আমার প্রথম প্রেম আর কি! সেখান থেকে আমি সংগীতের মধ্যে আসি। প্রথম লেখা শুরু করি কবিতা। যেহেতু সুর করার, গানের কথায় সুর তৈরির ইচ্ছা ছিলো, তাই আস্তে আস্তে সংগীতে এসেছি। গান সাহিত্যনির্ভর হলে, সে গানের আয়ু বেশি হয়, মানুষের কাছে এটা অন্যভাবে পৌঁছায়।  
 
বাংলানিউজ : আপনার জীবনে কবিতার জানালা খুললো কীভাবে?
অনুপম : কবিতায় অনেকেই প্রভাবিত করেছিলেন আমাকে। গৌরব নামে একটি পত্রিকার সঙ্গে যখন যুক্ত হই, সেটা একটা বড় টার্নিং পয়েন্ট আমার জীবনে। সেখানকার লেখা পড়ে, যেসব মানুষ গৌরবে লিখতেন, তাদের সঙ্গে আলাপ করে, কথাবার্তা বলে, অনেক এক্সপোজার বাড়ে আমার। ফলে আমার লেখাটার একটা দিক ঘোরে। একটা বাঁক নেয়।
 
বাংলানিউজ : আপনার গানে কাদের প্রভাব আছে?
অনুপম : অনেক মানুষের। আমার গান লেখা শুরু সুমন (কবির সুমন), নচিকেতা, অঞ্জন (দত্ত)- এদের গান শুনেই। এভাবেই শুরু করি গান লেখা। প্রভাব পড়েছে আরও অনেক শিল্পীর। আরডি বর্মণের প্রভাবও আছে। মাইলসের প্রভাবও আছে। যাদের গানই শুনেছি, তারা কোনো না কোনোভাবে প্রভাবে পড়ে গেছেন।
 
বাংলানিউজ : আপনার সুরে অঞ্জন দত্ত একটা গান গেয়েছেন। কেমন লাগলো?
অনুপম : কলকাতায় ‘সাহেব বিবি গোলাম’ বলে একটা ছবির কাজ করেছি। এতে অঞ্জনদা নিজেও অভিনয় করছেন। তো তাকে অনুরোধ করে বলেছিলাম- তুমি কি গাইবে? তিনি খুব ভালোবেসে গানটা গেয়েছেন। অঞ্জনদার গান ছোট থেকে শুনছি। মানুষটাকে এতো কাছ থেকে সংগীত পরিচালনা করতে পারবো, এটাও একটা ভাগ্যের ব্যাপার। নিজের গানের বাইরে নিজের পুত্র (নীল দত্ত) ছাড়া তিনি এর আগে কারও সুরে গাননি।
 
বাংলানিউজ : চলচ্চিত্রের গান তৈরি করতে গেলে আপস করতে হয়। আপনি যেহেতু একজন লেখক, সেক্ষেত্রে বিরোধ হয় না?
অনুপম : ছবির গান মানেই আপস থাকে। সবার মন রেখে চলতে হয়। কারণ এটা আমার একার প্রকল্প নয়। আমার লেখা নিয়ে যে খুব একটা বিরোধ হয় তা না। কারণ লোকের একটা বিশ্বাস তৈরি হয়ে গেছে, আমার লেখা ভালো লাগবে। তবে উপস্থাপনা নিয়ে অনেক সময় বিরোধ করতে হয়। কিন্তু সবাই যেহেতু বন্ধুর মতো, তাই দুঃখের কোনো জায়গা নেই আমার।
 
বাংলানিউজ :  এই যে বললেন, লোকের আস্থা তৈরি হয়ে গেছে। এটা কি চাপ তৈরি করে কাজ করতে গিয়ে?
অনুপম : না, চাপ অনুভব করি না। আমার অতোটা চাহিদা নেই। যা তৈরি করছি সবই যে মানুষের ভালো লাগবে, এতোটা দাবি-দাওয়া নেই। মাঝে মধ্যে একটা-দুইটা ভালো লাগলেই হলো।
 
বাংলানিউজ : ৬ ডিসেম্বর অনেক তরুণীর মন ভাঙতে যাচ্ছেন! অনুভূতি কেমন?
অনুপম : ওইদিন আমার বিয়ের কথা বলছেন তো? (মৃদু হাসি) অনুভূতি সেরকম কিছু না। কাজের চাপ কমে গেলে ভালো। কারণ অনেক কাজ বাকি আছে, সেগুলো করতে হবে। এখন যেমন চলার সেরকমই চলবে। পিয়ার (পিয়া চক্রবর্তী) সঙ্গে আমি গান নিয়ে অনেক কিছু শেয়ার করি। এবার জীবনটাকে শেয়ার করতে যাচ্ছি!

* বাংলানিউজের ক্যামেরায় চট্টগ্রামে অনুপম রায়ের পরিবেশনা :


বাংলাদেশ সময় : ০৯৫৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৩, ২০১৫
জেএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

তারার ফুল এর সর্বশেষ