দীর্ঘদিন ধরে মিরপুরে বসবাস করতেন অভিনেতা আব্দুল কাদের। পুরনো বাসা ছেড়ে ৪-৫ বছর আগে মিরপুর ডিওএইচএস-এর নতুন ফ্ল্যাটে উঠেছিলেন তিনি।
কাদের পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন প্রায় এক মাস হতে চলেছে। এখনও তার পরিবারের সবাই শোকে কাতর। হয়তো এই শোক কখনই কাটিয়ে উঠতে পারবেন না তারা।
নিজের হাতে বাসার সবকিছু সাজিয়েছেন কাদের। বাসায় গিয়ে সবখানে তার হাতের ছোঁয়া অনুভব করা গেল। কাদেরের পুত্রবধূ জাহিদা ইসলাম শোকেস ভর্তি প্রখ্যাত এই অভিনেতার প্রাপ্ত নানা পুরস্কার ও সম্মাননা ক্রেস্ট দেখিয়ে বললেন, ‘এখানে অল্পকিছু পুরস্কার রয়েছে। এমন আরও দুই-তিনগুণ ক্রেস্ট-পুরস্কার ছিল। কিন্তু বাসা পাল্টানোর সময় ওইগুলো চুরি হয়ে গেছে। অনেক চেষ্টা করেও তা উদ্ধার করতে পারিনি’।
কথা বলতে বলেতে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে আসে কাদেরের নাতি সাদমান এহসান ও নাতনি সিমরিন লুবাবা। কাদের যখন হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন, তখন একবার তার মৃত্যুর গুজব ছড়িয়েছিল। তখন সামাজিক মাধ্যমে ১০ বছর বয়সী লুবাবার অশ্রুসিক্ত ভিডিওবার্তা সবার হৃদয় স্পর্শ করেছিল।
কেমন আছো? জিজ্ঞেস করতেই সে মাথা নাড়িয়ে জানায়, ভালো আছে। কিন্তু তার চোখে-মুখে দেখা যাচ্ছিল প্রিয় দাদাকে হারানোর হাহাকার।
দাদার কথা মনে হয়? প্রশ্নটি শুনে কিছুক্ষণ চুপ থেকে লুবাবা কথা বলা শুরু করে, ‘আমি যখন বাসায় থাকি মনে হয় দাদা অফিসে গেছেন, অন্য কোনো কাজে গেছেন, আবার মনে হয় সোফায় বসে টিভি দেখছেন-কিন্তু আমি তাকে দেখতে পাই না। ’
কথাগুলো যখন বলছিল চোখ দিয়ে অঝরে অশ্রু ঝরছিল তার। যতক্ষণ লুবাবার সঙ্গে কাদেরকে নিয়ে কথা হয় ততক্ষণই কেঁদেছে এই তৃতীয় শ্রেণি পড়ুয়া। বলে, ‘দাদা আমাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখতেন। গায়িকা হতে বলেছিলেন। আমি তার ইচ্ছাগুলো পূরণ করতে চাই। আমি জানি, এতে দাদা খুশি হবেন’।
দাদার উপদেশের কথা স্মরণ করে সে আরও বলে, ‘দাদু বলতেন, পরীক্ষায় ভালো করলে ঘুরতে নিয়ে যাবেন। পড়াশোনা করলে জীবনে সবকিছু করতে পারবে। আরও বলতেন, গান করবা, সবসময় ভালো কাজ করবা, বড়দের সম্মান করবা’।
লুবাবার সঙ্গে কথা বলার ফাঁকে অনুরোধে ড্রইং রুমে আসেন কাদেরের স্ত্রী খাইরুল কাদের। তার প্রয়াত স্বামীকে নিয়ে কথা বলতে হবে- তা শুনে বাঁধভাঙা কান্না তার চোখ ভিজিয়ে দেয়।
স্বামীর প্রসঙ্গে উঠতেই ভারাক্রান্ত গলায় তিনি বলেন, ‘অনেক ভালো মানুষ ছিলেন। কখনো কাউকে শুনিনি তাকে খারাপ বলতে। আমার অনেক যত্ন নিতেন। আর কি বলবো; কথা খুঁজে পাচ্ছি না…’, বলে আবারও কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
তিনি জানান, মৃত্যুর আগে কাদের ব্যাংকে বলে গেছেন, তার মৃত্যুর পর অর্থসংক্রান্ত কোনো কাজে স্ত্রীকে যেন কোনোরকম হয়রানি না করা হয়। সেজন্য কাদের জীবিত থাকতেই সব প্রয়োজনীয় কাগজ ঠিকঠাক করে রেখেছিলেন।
বাসার একটা কর্নারে কাদেরের নানা সময় তোলা ছবি বাঁধাই করা রয়েছে। কাদেরের সঙ্গে শুটিংয়ের সময় তোলা একটি ছবি সবচেয়ে বড় ফ্রেমে বাঁধাই করা উপরে। সেই ছবিটি দেখিয়ে খাইরুল কাদের বলেন, ‘২০০০ সালের দিকে একটি ধারাবাহিক নাটকের শুটিংয়ের সময় ছবিটা তোলা। তিনি নিজ হাতে বাঁধাই করে সেটা ঝুলিয়ে রেখেছেন। আজ মানুষটা শুধু ছবিতেই রয়ে গেলেন…’।
স্বামীর হাত ধরেই তার নাটক ও সিনেমায় অভিনয় করা। কাদের সঙ্গেই শুধু অভিনয় করেছেন তিনি। এর বাইরে কারো সঙ্গে কখনো কাজ করেননি। সহশিল্পী হিসেবে কাদের ছিলেন চমৎকার। হুমায়ূন আহমেদ ও আব্দুল্লাহ আল মামুন পরিচালিত নাটকে তারা বেশি অভিনয় করেছেন বলে জানান কাদেরপত্নী।
শুটিং থাকলে সবসময় কাদের স্ত্রীকে নিয়ে যেতেন বলেও জানান খাইরুল কাদের। তখন শুটিংয়ের সবাই তাকে মজা করে বলতেন, ‘ভাবি কাদের ভাইকে কখনো একা ছাড়েন না’।
সবশেষে কাদেরের স্ত্রী বলেন, ‘তিনি সবসময় সবার ভালোবাসা পেয়েছেন। কারো মনে কখনো কষ্ট দেননি। তার জন্য সবার কাছে দোয়া চাইছি’।
বাংলাদেশ সময়: ১২২৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৩, ২০২১
জেআইএম