মারমেইড বিচ ও ইকো রিসোর্ট ঘুরে: আলাপ চলছিল, মারমেইডের রঁসুইঘর নিয়ে। এর মাঝখানেই সদ্য জল থেকে ডাঙায় তোলা খানচারেক ইলিশ মাছ নিয়ে হাজির স্থানীয় জেলে দিদার।
ইকো ট্যুরিজমের দুনিয়ায় বাংলাদেশে তো বটেই, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটেও বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে মারমেইড ইকো ট্যুরিজম লিমিটেড। গার্ডিয়ান পত্রিকার দৃষ্টিতে বিশ্বসেরা ১০০ রিসোর্টের মধ্যে রয়েছে মারমেইড ইকো রিসোর্ট। আবাসন সেবা ছাড়াও মারমেইডের সুনামের অন্যতম অগ্রদূত তাদের রঁসুইঘর। আরও গুছিয়ে বললে, ভিন্ন একটি খাদ্যচক্রই সৃষ্টি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। সোহাগ যেটিকে বলছেন, ফ্রম ফার্ম টু টেবল। মানে শতভাগ ‘অরগ্যানিক ফুড’ অতিথিদের মুখে তুলে দিতে নিবিড় নিষ্ঠা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি ও তার দল।
অতিথি প্রসঙ্গে বলে নেওয়া ভালো, মারমেইড ইকো ট্যুরিজম লিমিটেডের নানা অঙ্গ-প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অন্যতম প্রধান দু’টি হলো- মারমেইড ইকো রিসোর্ট ও মারমেইড বিচ রিসোর্ট। সেখানে আবাসন ব্যবস্থাসহ খাবারের নানা প্যাকেজ। এছাড়াও সবার জন্য উন্মুক্ত রয়েছে রেস্টুরেস্ট। সবাই তাদের অতিথি। খাবার সরবরাহকারী অঙ্গ-প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রত্যেকের রঁসুইঘর আলাদা হলেও, প্রত্যেকে আবার অদৃশ্য ‘মারমেইড রঁসুইঘর’র অংশ। মানে ওই খাদ্য চক্রের সদস্য।
মারমেইড বিচ রিসোর্ট দিয়ে ব্যাপারটা বোঝানো যাক। গোটা বছরকে চারটি সিজনে ভাগ করে তারা মেন্যুগুলো সাজান। যে সিজনে যে শাক-সবজি-মাছ মেলে, সেগুলোই তখন প্রাধান্য পায়। শীতকালে যেমন সকালের খাবারের মেন্যুতে প্রচুর পিঠা থাকে। লাইভ পিঠা বানানো হয়। পাশাপাশি একজন আমেরিকান-ফরাসিও যে ধরনের খাবার খেয়ে থাকেন তাও হাজির থাকছে। দেশের মানুষের জন্য ডিম-খিচুড়ি-ভর্তা-ভাজি রাখতেও ভোলে না মারমেইড।
এক কথায়, মাল্টি কুইজিন। ব্রেকফাস্ট বুফেতে নিয়মিতভাবে থাকে ৫০ পদ। অতিথিসংখ্যা বাড়লে বেড়ে যায় পদের সংখ্যাও।
রসুইঘরের খুটিনাটি বিষয়গুলো বুঝিয়ে বলছিলেন তরুণ উদ্যোক্তা সোহাগ, শুক্র-শনিবার রাখা হয় কক্সবাজারের ঐতিহ্যবাহী খাবার ‘মোচাভাত’। খোঁজ নিয়ে গ্রামের এমন ১০ জন নারীকে ঠিক করা হয়েছে যারা খুব ভালো মোচাভাত করেন। তাদেরকে পারিশ্রমিক দিয়ে মোচাভাত সংগ্রহ করে বিশেষ আয়োজন রাখা হয়। অনেকেই রয়েছেন, যারা গ্রামের অথেনটিক খাবার খেতে পছন্দ করেন।
সেলিব্রেটি বা ভিআইপিদের জন্যও রয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। তারা চাইলে মারমেইড অতি যত্নের সঙ্গে তাদের জন্য আলাদা ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ বা ডিনারের আয়োজন করে দেয়।
লাঞ্চ-ডিনারেও থাকে নানা পদের সমাহার। দেশি সেট মেন্যু ছাড়াও রয়েছে আন্তর্জাতিক কুইজিন। যার যেমন ইচ্ছে খাওয়ার স্বাধীনতা। স্পেশাল ডিনারের জন্য রয়েছে বিভিন্ন প্যাকেজ। ছোট ছোট আইল্যান্ডে বিশেষ ক্যান্ডেল ডিনারেরও ব্যবস্থা রয়েছে। চারপাশে সমুদ্র, অফুরান আঁধারের মাঝে একটু মোমের আলো, মুখোমুখি আপনি আর আপনার প্রিয়জন- এই স্বর্গীয় অনুভূতি উপহার দিতে মারমেইড কোনো কমতি করবে না, এটা দায়িত্ব নিয়ে বলা যায়।
রোজ রান্না হচ্ছে হরেক পদ। অনেক খাবারও নিশ্চয় বেঁচে যায়। সেগুলো কোথায় যায়? ‘তিনভাবে আমরা এটি ব্যবহার করি। প্রথমত, উচ্ছিষ্ট অংশ আমাদের নিজস্ব অরগ্যানিক প্ল্যান্টে সার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। দ্বিতীয়ত, স্থানীয় কুকুরদের খাওয়ানো হয় আর ভালো খাবারগুলো গ্রামীণ প্রতিবেশীদের উপহার দিয়ে দিই। ’
অরগ্যানিক ফুডের যোগান নিয়ে সোহাগ বলেন, মারমেইডের চারপাশে ১০ কিমির মধ্যে যার বাড়িতে যা আছে সব আমাদের স্টাফরা সংগ্রহ করে নিয়ে আসেন। কারও লাউ, কারও কলা, কারও ডাব বা ডিম-মুরগি। যাদের বেশি পরিমাণে রয়েছে তারা নিজেরাই এসে আমাদের দিয়ে যান। আমরা তাদের বাজার মূল্যের চেয়ে বেশিই দাম দিই। এতে তারাও উৎসাহ পান। আমরা তাদের ফসল উৎপাদনে সার দিতে নিরুৎসাহিত করি। আমাদের পলিসি, এই ১০ কিমির বাইরে না যাওয়া। ভালো দাম পেয়ে তারাও প্রাকৃতিকভাবে ফলমূল ও ফসল উৎপাদনে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। এভাবে এই ১০ কিমি অঞ্চল একটি অরগ্যানিক প্ল্যান্টে পরিণত হচ্ছে। এতে গ্রামবাসীরও লাভজনক ও সম্মানের একটি জীবিকা গড়ে উঠছে। এর পাশাপাশি আমাদেরও নিজস্ব কিছু প্ল্যান্ট রয়েছে। বিদেশি অনেক মেন্যুর উপকরণও আমরা চেষ্টা করি নিজেদের প্ল্যান্টে উৎপাদন করতে।
আর মাছের ক্ষেত্রে? “জেলেদের সঙ্গে আমাদের চুক্তি রয়েছে। তারা মাছ ধরা শেষে বোট নিয়ে আমাদের এখানে চলে আসেন। আমাদের শেফরা তাদের পছন্দ ও প্রয়োজনমতো তাজা মাছ বাছাই করে নেন। রান্নার ক্ষেত্রেও তাদের পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয়। প্রতি বৃহস্পতি-শুক্র-শনিবার রাতে আমরা লাইভ বারবিকিউ পার্টি ‘ফিশারম্যান নাইট’র আয়োজন করি। জেলেরা তাজা সব মাছ সামনে রাখেন। লবস্টার, কোরাল, লাক্ষা- যার যেটা খুশি পছন্দ করে দিলে সঙ্গে সঙ্গে সেটা বারবইকিউ করে দেওয়া হয়। ”
এই কার্বাইড, ফরমালিন, হাইব্রিড আর ভেজাল পণ্যের যুগে রাজধানীবাসী মাত্রই জানেন, অরগ্যানিক ফুডের কী মূল্য! চিকিৎসকদের মত, বর্তমানে অধিকাংশ রোগের কারণ, এইসব ক্ষতিকর রাসায়নিক মিশ্রিত শাকসবজি, মাছ-মাংস। সেখানে অতিথিদের শতভাগ অরগ্যানিক ফুড উপহার দিতে মারমেইডের যে একনিষ্ঠ চেষ্টা- তা প্রশংসার দাবি রাখে।
মারমেইড কোথা থেকে পেলো এই মহতী চিন্তা? উত্তর দিলেন চিন্তার সফল বাস্তবায়নকারী সোহাগ নিজেই, এক্ষেত্রে আমি কার্লোস প্যাথরিনি নামে এক দার্শনিককে অনুসরণ করি। তার দর্শন ফাস্টফুড বিরোধী, স্লো ফুডের পক্ষে। তিনি বলেন, ‘তুমি যে ব্র্যান্ডের শার্ট পরো সেটি আসলে তুমি নও। তুমি আসলে তাই, যা তুমি খাও। যে খাবার খেয়ে তোমার শরীরকে তৈরি করো’।
বাংলাদেশ সময়: ১১১৭ ঘণ্টা, আগস্ট ২৬, ২০১৬
এসএনএস