ঢাকা, শনিবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পর্যটন

ঘুরে আসুন সভ্যতার নিদর্শন মহাস্থানগড়ে

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২১৬ ঘণ্টা, জুন ৪, ২০১৯
ঘুরে আসুন সভ্যতার নিদর্শন মহাস্থানগড়ে ইতিহাস-ঐতিহ্যের নগরী মহাস্থানগড়, ছবি: বাংলানিউজ

বগুড়া: একেকজন একেকভাবে কাটাবেন ঈদের ছুটি। কর্মব্যস্ত জীবনে বেশিরভাগ মানুষই পরিবার-পরিজনদের সময় দিতে পারেন না। ইট-পাথরের শহরে অনেকটা যান্ত্রিক জীবনই কাটাতে হয় সবাইকে। তবে ঈদের ছুটির অপেক্ষায় থাকে সেই মানুষগুলো। ছুটিতে পরিবারকে সময় দেওয়ার পাশাপাশি সবাই মিলে ঘুরে বেড়িয়ে আনন্দ-উল্লাস করেন অনেকেই।

কিন্তু কোথায়? এবারের ঈদের ছুটিতে ঘুরে আসতে পারেন আড়াই হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্যের নগরী মহাস্থানগড়। দেখতে পাবেন ইটের ভাঁজে ভাঁজে সভ্যতার ছাপ।

এর পাশেই রয়েছে ঐতিহাসিক মহাস্থান জাদুঘর। এছাড়া সভ্যতার আরেক নিদর্শন গোবিন্দ ভিটা, যেখানে এসে জানতে পারবেন নিজের ইতিহাস-ঐতিহ্য। দেখতে পারবেন আকর্ষণীয় নানা ধরনের প্রত্ন নিদর্শন। পর্যটকদের মনকে বিমোহিত করবে ঐতিহাসিক এসব স্থানের রূপের ছোঁয়া।

বগুড়া শহর থেকে ঢাকা-রংপুর মহাসড়ক ধরে উত্তরে যেতে হবে প্রায় ১২ কিলোমিটার। সেখান থেকে একটু পশ্চিমে গেলে মিলবে সমতল ভূমি থেকে প্রায় ১৫ থেকে ৪৫ ফুটের উঁচু স্থান। প্রায় পাঁচ হাজার ফুট দীর্ঘ ও সাড়ে চার হাজার ফুট প্রশস্ত প্রাচীণ প্রসিদ্ধ এই নগরীর নামই মহাস্থানগড়। এ নগরীর চারপাশে রয়েছে নানা ইতিহাস-ঐতিহ্য আর স্থাপত্য নিদর্শন।
 
পুণ্ড্রনগরখ্যাত দীর্ঘ প্রাচীর বেষ্টিত নগরীর ভেতর রয়েছে- পরশুরাম প্যালেস, জিয়ৎ কুণ্ড, গোবিন্দ ভিটা, বৈরাগীর ভিটা, খোদার পাথর ভিটা, শিলা দেবীর ঘাট, মহাস্থান মাজার, মুনির ঘোন ও মানকালীর কুণ্ডুসহ আরও অনেক নিদর্শন। এর পূর্ব ও উত্তরে বহমান করতোয়া নদী। আর পশ্চিমে রয়েছে কালিদহ সাগরখ্যাত জলাশয়। পশ্চিম-দক্ষিণে আছে বারনসি খাল।

হিন্দু, বৌদ্ধ ও মুসলিম সম্প্রদায়সহ নানা জাতের হাজারো মানুষ ঐতিহাসিক এ স্থানটির দর্শন পেতে নিয়মিতই এখানে আসেন। সর্বসাধারণের কাছেও স্থানটি অত্যন্ত আকর্ষণীয়। তীর্থস্থান হিসেবেও মহাস্থানগড়ের গুরুত্ব কম না। দর্শনার্থী ও পর্যটকদের দৃষ্টি কাড়তে এখানে নির্মাণ করা হয়েছে আকর্ষণীয় অনেক স্থাপনা।

প্রসিদ্ধ এই নগরীর পশ্চিমপ্রান্তে লাগোয়া মহাস্থান জাদুঘর। এ জাদুঘরটি সুঙ্গ থেকে মুসলিম আমলের হাজারো প্রত্নবস্তুর সংরাক্ষণাগার হিসেবে খ্যাত। জাদুঘরের ঠিক উত্তরপ্রান্তে ঐতিহাসিক গোবিন্দ ভিটা। মাঝ বরাবর শুধু মহাস্থান-শিবগঞ্জ আঞ্চলিক সড়ক অতিবাহিত।
 
মহাস্থানগড়: মৌর্য, সুঙ্গ, গুপ্ত, পাল ও সেন রাজবংশের রাজধানী ও শাসনকেন্দ্র ছিলো এই নগরী। তৃতীয় খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে পঞ্চদশ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এসব রাজবংশের প্রধানরাই ছিলেন শাসনকর্তা। প্রাচীণ নগরী বা সমৃদ্ধশালী জনপদের নাম আসলেই দেশের মধ্যে ঐতিহাসিক পুণ্ড্রবর্ধনের নাম উঠে আসবে।

৬৩৮-৬৪৫ খ্রিষ্টাব্দে বিখ্যাত চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ রাজমহলের পাশ দিয়ে কজঙ্গল হয়ে পূর্বদিকে যাত্রা করে গঙ্গা পেরিয়ে পৌঁছান পুণ্ড্রবর্ধনে। ১৮০৮ খ্রিষ্টাব্দে একইকথা লিপিবদ্ধ করেন বুকানন হ্যামিল্টন। পণ্ডিত পরশুরাম রতিচের ‘করতোয়া মাহাত্ম’ কাব্যগ্রন্থেও উল্লেখ রয়েছে প্রসিদ্ধ এই নগরীর নাম।

সেখানে প্রত্নতাত্ত্বিক খননে সন্ধান মেলে ব্রাহ্মী লিপির। সেই লিপিতে পুণ্ড্রনগরের প্রাদেশিক শাসক সম্রাট অশোক দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষকে রাজভান্ডার থেকে খাদ্যশস্য ও অর্থ সহায়তা দেওয়ার নির্দেশ দেন। করতোয়া মাহাত্ম কাব্যগ্রন্থে বিষ্ণুর স্থায়ী আবাস্থল হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে মহাস্থানকে। হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ মহাস্থানকে আজও তাদের পীঠস্থান মনে করেন।

মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের কাছেও মহাস্থানগড়ের গুরুত্ব অনেক। শাহ সুলতান মাহমুদ মাহীসওয়ার বলখী (র.) এই নগরী আক্রমণ করে পরশুরামকে পরাজিত করেন। এখানে তার মাজার শরীফ রয়েছে। আবার অনেকেই ফকির-সন্যাসী বিদ্রোহের নায়ক মজনু শাহের নামানুসারে এই স্থানের নাম মহাস্থানগড় বলেও মনে করেন। এ পর্যন্ত প্রসিদ্ধ এই নগরী খননে বিভিন্ন আমলের স্থাপত্য কাঠামোর পাশাপাশি বেশকিছু প্রত্ন সামগ্রীর সন্ধান মিলেছে। এখনও সেখানে খনন কাজ চলমান।
 
এদিকে দর্শনার্থী ও পর্যটকদের জন্য মহাস্থানগড়ে রেস্তোরাঁ, স্যুভেনরি কর্ণার, সৌচাগার, চারকোনা ছাউনি বিশিষ্ট ঘর, বেঞ্চ, ডরমেটরি, আনসার ক্যাম্প, গাড়ি পার্কিং চত্বর, পিকনিক স্পট, রাস্তা কার্পেটিংসহ নিত্যনতুন অনেক কিছু গড়ে তোলা হয়েছে। আকর্ষণীয় নানা ধরনের প্রাচীন প্রত্ন নিদর্শন, ছবি: বাংলানিউজসাউথ এশিয়া ট্যুরিজম ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের আওতায় এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থার (ইউনেসকো) সহযোগিতায় প্রসিদ্ধ এই নগরীজুড়ে এসব উন্নয়নমূলক কাজ করা হয়।

মহাস্থান জাদুঘর: সুঙ্গ থেকে মুসলিম আমলের ইতিহাস-ঐতিহ্যের স্বাক্ষী আজকের মহাস্থান জাদুঘর। এই জাদুঘরে এসব আমলের প্রায় দুই হাজার ৬৮৭টি প্রত্মবস্তু সংরক্ষিত। যা দর্শনার্থীদের বিমোহিত ও আকর্ষিত করবে। মহাস্থানগড়সহ আশপাশের এলাকা খননের ফলে প্রাপ্ত এবং দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাওয়া প্রত্নতত্ত্ব সম্পদ সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের জন্য ১৯৬৭ সালে স্থাপন করা হয় মহাস্থান জাদুঘর। এখানে সংরক্ষিত রয়েছে তৃতীয় খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে পঞ্চদশ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সময়ে পাওয়া নানা ধরনের প্রত্নবস্তু।
 
এ জাদুঘরের প্রবেশ মূল্য- সাধারণ দর্শনার্থীর জন্য ২০ টাকা, মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত ছেলে-মেয়েদের জন্য পাঁচ টাকা, সার্কভুক্ত দেশের পর্যটকদের জন্য ১০০ টাকা ও সার্কভুক্ত ছাড়া অন্যান্য দেশের পর্যটকদের জন্য ২০০ টাকা। এছাড়া যানবাহন পার্কিং বাবদ- বড় বাসের জন্য ১০০ টাকা, মাইক্রোবাস ৫০ টাকা ও মোটরসাইকেল ২০ টাকা। এসব মূল্যের ওপর শতকরা ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাটও রয়েছে।
 
গোবিন্দ ভিটা: গোবিন্দ ভিটা খনন করা হয় ১৯২৮ থেকে ১৯২৯ সাল ও ১৯৬০ সালে। এটি খননে পাওয়া যায় চারটি যুগের নিদর্শন। এগুলোর মধ্যে গুপ্তযুগে নির্মিত প্রদক্ষিণপথ বেষ্টিত আয়তকার ডায়াস, প্রাথমিক পাল যুগের কমপ্লেক্স, বহুপার্শ্ব বিশিষ্ট প্রস্তর বেদি পালপরবর্তী যুগে নির্মিত কিছু ক্ষয়িষ্ণু দেয়াল ও সম্ভাব্য অগ্নিশিলা এবং সুলতানি যুগে নির্মিত ভগ্ন মেঝের মধ্যে ১৮টি মুদ্রা ভর্তি মাটির পাত্র অন্যতম।

প্রাথমিক পাল যুগে মন্দির দু’টি ঘিরে সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করা হয়েছিলো। মন্দির ঘেঁষে বহমান করতোয়া নদীর তীরে নির্মাণ করা হয়েছিলো একটি পাথরে বাঁধানো ঘাট। যা ১৯২২ সালে বন্যায় ভেসে যায়।
 
এদিকে সন্ধান মেলে পূর্ব ও পশ্চিমে পাশাপাশি অবস্থিত দু’সেট মন্দিরের। ছয়-সাত শতকে গুপ্তযুগে নির্মিত বারান্দাযুক্ত একটি মন্দির। মন্দিরটি ভিত্তিভূমি প্রচুর গভীর ও অফসেটযুক্ত।  

পাশেই উচুঁতে রয়েছে আরেকটি বারান্দাযুক্ত মন্দির। আট-নয় শতকে এটি নির্মিত। প্রাথমিক পাল যুগের মন্দির এটি। এগারো শতকে মন্দিরের পাশে একটি করে চণ্ডী দেবীবর ও নৃত্যরত গণেশের প্রস্তর প্রতিমা পাওয়া যায়। এছাড়া উপরিভাগে পনের-ষোল শতকে সুলতানি যুগে নির্মিত ইটের প্লাটফর্ম আবিস্কৃত হয়।
 
১৯৬০ সালে গোবিন্দ ভিটায় খনন করে মৌর্যযুগের ছাপাকৃত ও ঢালাই করা রৌপ্য মুদ্রা, উত্তরাঞ্চলীয় কালো চকচকে মাটির পাত্র, সুঙ্গ যুগের ছয়টি পোড়া মাটির ফলক, খ্রিষ্টীয় প্রথম-দ্বিতীয় শতকের খোদাইকৃত নীল পাথরের চাকতি আকৃতির একটি প্রসাধনী ট্রে, চতুর্থ শতাব্দীর কাদা মাটির তৈরি একটি সীলমোহর ও পোড়া মাটির মস্তক এবং খ্রিষ্টীয় ছয়-সাত শতকের তিনটি বড় মাটির পাত্র পাওয়া যায়। এতে শঙ্খখোসা, চুন ও নরকঙ্কালও ছিলো।
 
এছাড়া বিভিন্ন সময়ে গোবিন্দা ভিটা খনন করে পোড়া মাটির মূর্তি, খেলান, কমমূল্যের পাথরের তৈরী গুটিকা, বোতাম, কানবালা, কুন্তল, নাকফুল, তামা, ব্রোঞ্জের তৈরি বলয়, সুরমা দন্ড, ছাচে ঢালা তাম্র ও রৌপ্য মুদ্রাসহ বিভিন্ন আমলের বহু প্রত্নবস্তু পাওয়া যায়।
 
বাংলাদেশ সময়: ১৮১২ ঘণ্টা, জুন ০৪, ২০১৯
এমবিএইচ/এসএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।