ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৩৯)

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০০৯ ঘণ্টা, মার্চ ৬, ২০২০
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৩৯) ভোরের মহাসড়ক

বাবর আলী। পেশায় একজন ডাক্তার। নেশা ভ্রমণ। তবে শুধু ভ্রমণ করেন না, ভ্রমণ মানে তার কাছে সচেতনতা বৃদ্ধিও। ভালোবাসেন ট্রেকিং, মানুষের সেবা করতে। সম্প্রতি চট্টগ্রামের এই ডাক্তার হেঁটে ভ্রমণ করেছেন দেশের ৬৪ জেলা। সেটা আবার ৬৪ দিনে। কেমন ছিল সেই অভিজ্ঞতা? সেটা নিয়ে ধারাবাহিকভাবে লিখেছেন বাংলানিউজের ট্রাভেলার্স নোটবুকে। ৬৪ দিনে থাকবে ৬৪ দিনের ভ্রমণ-অভিজ্ঞতা।

দিন ৩৯
সরোজগঞ্জ বাজার (চুয়াডাঙ্গা)- মুজিবনগর (মেহেরপুর)= ৪৪.০৬ কিমি
চুয়াডাঙ্গা শহরের দেয়ালগুলো ছেয়ে গেছে অস্পৃশ্যতা বিরোধী হোটেল প্রবেশ আন্দোলনের লেখনীতে। ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজেরা হোটেলে প্রবেশ করতে পারলে ঝাড়ুদার কেন পারবে না সে বিষয়ক প্রশ্ন তোলা আছে জায়গায় জায়গায়।

যৌক্তিক আন্দোলনগুলো অনেক সময়ই সফলতার মুখ দেখে না বলে বাংলাদেশি হিসেবে আমার নিজের মাথা হেঁট হয় মাঝে মধ্যেই। এসব আন্দোলন টানেলের শেষ মাথার আলো খুঁজে পাক সেই প্রত্যাশা বুকে নিয়েই ভ্যানে চেপে সরোজগঞ্জের উদ্দেশ্যে।

কাল হাঁটা শেষ করেছিলাম এখানেই। অন্য দিনের তুলনায় আজ ঠাণ্ডা পড়েছে। আমি সরোজগঞ্জ থেকে সামনের দিকে এগোচ্ছি আর শীতকালীন সবজি বোঝাই ভ্যানগুলো যাচ্ছে আমার বিপরীত দিকে। হাতের ডানদিকে দেখলাম খানিকটা ব্যতিক্রমী ড্রাগন ফ্রুটস চাষ। সিমেন্ট-খোয়ার তৈরি পিলারের মাথায় বাঁধা হয়েছে টায়ার। আর পিলারের গায়ে বাঁধা আছে চারা।

সুবদিয়া হয়ে চলে এলাম ডিঙ্গেদহ বাজার। হাঁস বিক্রির এক অভিনব পদ্ধতি দেখলাম এক ভ্যানওয়ালার কাছে। ভ্যান বোঝাই হাঁস নিয়ে যেতে যেতে হাসের দাম ঘোষণা করছে আর মাঝে মাঝেই স্পিকারটা হাঁসের মুখের কাছে ধরছে কিছুক্ষণের জন্য। হাঁসের প্যাকপ্যাক আওয়াজ স্পিকারে শুনতেই মনের অজান্তে হেসে ফেললাম। সামনেই পড়লো বিজিবি হাসপাতাল। এই হাসপাতালটা অবিকল ঠাকুরগাঁওয়ের বিজিবি হাসপাতালের মতোই।  

একই গড়ন, একই রং। ছাগলা মোড়ের কাছে চরে বেড়ানো ছাগল দেখতে দেখতে জাফরপুর মোড়। মহাসড়ক ছাড়লাম এখান থেকেই। বামের ছোট রাস্তাটা বাইপাস হয়ে মিশেছে ভিমরুল্লার কাছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রবেশ করলাম পাখির গ্রাম বেলগাছিতে। গ্রামে ঢোকার মুখের সাইনবোর্ডটি জানান দিচ্ছে এই গ্রাম পাখি ও বন্যপ্রাণীদের অভয়ারণ্য।  

পাখির দেখা না মিললেও নিয়মিত বিরতিতে দেখা মিলছিল বালির স্তূপের। এই গ্রামে এটা খুব সম্ভবত বেশ চালু ব্যবসা। পাকশীর বালি, পঞ্চগড়ের বালিসহ হরেক রকমের বালি বিক্রির সাইনবোর্ড। বেশ ঘনবসতি এদিকটায়। আমি চলেছি বাইপাস রোড হয়ে। বুজরুক গড়গড়ী নামক মজার নামের জায়গা পেরিয়ে সুমিরদিয়া বলাকা মোড়। এরপরেই হাটকালুগঞ্জ নামক ছোট একটা বাজার ছাড়িয়েই আবারো বড় রাস্তায়। সকাল থেকেই প্রচুর জমি বিক্রির সাইনবোর্ড দেখছি। এত লোক এত জমি বিক্রি করে কোথায় যেতে চায় কে জানে। আর কোনো জেলায় আমি এত জমি বিক্রির বিজ্ঞপ্তি দেখিনি। দামুড়হুদা উপজেলার শুরু উজিরপুর থেকে। আবার বড় রাস্তা ছেড়ে ডানের দিকে বিষ্ণুপুরের রাস্তা নিলাম। এদিকে মোটামুটি সবার বাড়িই লাল ইটের৷ ইটের উপর সিমেন্টের আস্তরণ দেওয়া কিংবা রং করা বাড়ি নেই বললেই চলে। রাস্তাটা যথেষ্ট নিরিবিলি। মিনিট দুয়েক-তিনেক পরপর একটা-দুটো গাড়ির দেখা মেলে। জায়গা পেলেই সেটাকে পেঁপে বাগান বানিয়েছে এখানকার কৃষকেরা। আর আছে রাস্তার দু'ধারে খেজুর গাছের সারি।  

মাথাভাঙ্গা নদীমাথাভাঙ্গা নদী পেলাম আরো কিছুদূর যেতেই। নদীর অর্ধেক অংশে পানি আর চাষাবাদ চলছে বাকি অর্ধেক অংশে। জেলা শহরগুলোতে নদীর নামে পত্রিকার নাম রাখার খুব একটা চল আছে। সকালে নাশতা করতে গিয়ে দৈনিক মাথাভাঙ্গা নামক পত্রিকার সন্ধান পেয়েছিলাম। নদীর অপর পাশে বিশাল সব পানের বরজ। দেখেই বোঝা যাচ্ছে বেশ যত্ন-আত্তি করা হয় এই বরজগুলোর। বেশ ক'টা ছাড়া ছাড়া সরিষার ক্ষেত পেরিয়ে বিষ্ণুপুর। বাজার ছাড়াতেই আমার মাথার হ্যাট আর ব্যাকপ্যাক দেখে এক লোক জিজ্ঞেস করলো- 'বলখেলা কোম্বে? (ফুটবল খেলা কোথায়)। ' আমি ক্রিকেট ব্যাটের শ্যাডোইং করে দেখিয়ে বলাতেই উত্তর এলো- 'ও বল খেলেন না, কিরিকেট খেলেন?' জুড়ানপুর থেকে এগিয়ে রাস্তার দুপাশেই বাঁশঝাড়। কৃষিজমিতে তুলাচাষের বেশকিছু প্রদর্শনী প্লট দেখলাম হোগলডাঙ্গায়। হেমায়েতপুরের কাছেই ভৈরব নদী। প্রশস্ততায় ও গভীরতায় খুব আহামরি কিছুই নয়।  

সরিষা ক্ষেত
নদীর পাড় থেকেই আমবাগানের শুরু। বর্ষীয়ান আমগাছগুলোর প্রস্থ তাক লাগানোর মতো। চারুলিয়ার কাছে আমাকে হেঁটে আসতে দেখেই ফেসবুক লাইভে চলে গেলেন এক মাঝবয়সী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। পরে স্কুলের পাশেই কথাবার্তা হলো বেশ কিছুক্ষণ। উনি আমাকে দেখেই নাকি ধারণা করেছেন আমি দেশ ভ্রমণে বেরিয়েছি। বেশিরভাগ স্কুলগুলোতে বার্ষিক পরীক্ষা চলছে বলে গত ক'দিনে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বাক্যালাপের সুযোগ মিলছিল না। এই শিক্ষকের সৌজন্যে কিংবা তার ফেসবুক লাইভের সৌজন্যে সেটা হয়ে গেলো।  

খানিক বাদেই উঠে গেলাম আটকবর রোডে। এদিকের রাস্তায় কোথাও ভাতের হোটেল মিলছিল না বলে জগন্নাথপুরে চা-বিস্কুট খেয়ে নিলাম। এ অঞ্চলে প্রচুর ভ্যান থাকলেও এই ভ্যানগুলো দেশের অন্য অঞ্চল থেকে খানিকটা আলাদা। নৌকার ছই বা ছাউনির আদলে এই ভ্যানগুলোতেও আছে ছই।  

মুজিবনগরের রাস্তা

ঢোলমারী থেকে প্রবেশ করলাম মেহেরপুর জেলার মুজিবনগর উপজেলায়। অল্প হাঁটতেই রতনপুর। এদিকটায় আছে প্রচুর খ্রিস্টান বসতি। অনেক বসতবাড়ির গেটে খোদাই করা ক্রুশ দেখলাম। স্থানীয় অধিবাসীদের নামের শেষাংশ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মন্ডল কিংবা মল্লিক। বুঝলাম এখানের খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বিরা মূলত সনাতন ধর্ম থেকে রূপান্তরিত হয়েছেন। রাস্তার দু’পাশে বিশাল সব আম গাছ আম্রকাননের অনুভূতি জোগাচ্ছে। আম গাছের চেয়েও আকর্ষণীয় অবশ্য আম বাগানের বুক চিরে চলে যাওয়া মেঠোপথগুলো।  

একটা ছোট শর্টকাট নিতে গিয়ে মেঠোপথ ধরে হাঁটাও হলো অল্প একটু। বাগোয়ান মোড়ে এসে কেদারগঞ্জের বড় রাস্তা ছেড়ে বেছে নিলাম গ্রামের মাঝের ছোট রাস্তাটা। এই রাস্তায় প্রথম বড় পাড়াটার নাম পাঠান পাড়া। ম্যাপ জানাচ্ছে কাছেই আনন্দবাস নামক একটা জায়গা আছে। বিজিবির একটা ক্যাম্পও আছে ওখানটায়।

মুজিবনগর কমপ্লেক্সখানিকক্ষণ হাঁটতেই এই রাস্তায় আসার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ে দিলাম। দু’পাশে সুবিশাল বিল। হেন কোনো সবজি নেই যার চাষ হচ্ছে না এই বিলে। লালশাক থেকে শুরু করে একেবারে পেঁয়াজ পর্যন্ত। মুজিবনগর কমপ্লেক্সে যখন পৌঁছেছি সূর্য তার শেষ আলোটুকু বিকিরণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন। মুজিবনগরে আমি আগেও এসেছি। বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের প্রথম রাজধানী হওয়ায় এই জায়গার প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়েছে। আমবাগানের মাঝে দিয়ে এগোতেই পাকড়াও করলেন স্থানীয় এক সাংবাদিক। আরেক দফা জীবন বৃত্তান্ত জানিয়ে ওনার কাছ থেকেই জেনে নিলাম সূর্যোদয় নামক ডাকবাংলোর অবস্থান। মুজিবনগর কমপ্লেক্সের ভেতরের এই দারুণ ডাকবাংলোতে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন গাংনীর ইউসিও মাহবুব ভাই। পুরোদিনই ফোন করে খবরাখবর নিচ্ছিলেন উনি।  

আমি গোসল সেরে ফ্রেশ হওয়ার একটু বাদেই উনি মেহেরপুর থেকে দেখা করতে চলে এলেন। সঙ্গে প্রফেসর আমিন ভাই, সাংবাদিক চান্দু ভাইসহ আরো জনাতিনেক। রুমেই বেশ কিছুক্ষণ গল্প-গুজব করে খেতে নিয়ে গেলেন কেদারগঞ্জ বাজারে। এই উপজেলার মূল বাজারই এটি। আকার-আয়তনে একে উপজেলা সদরের বাজার মনে হওয়ার কোনো কারণই নেই। এই জায়গার একটাই ভালো হোটেল। নাম আনছার হোটেল। আমাকে ভরপেট ভাত খাইয়ে চা হয়ে গেলো একদফা। ভীষণ আন্তরিক এই মানুষগুলো না থাকলে ওই প্রথম কোথাও আসার পরের সন্ধ্যাটা কাটতো একা একাই। একটাই আফসোস থেকে গেলো, মেহেরপুর এসে সাবিত্রী মিষ্টিটা চেখে দেখা হলো না এবার৷ 

চলবে...

আরও পড়ুন>>

পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৩৮)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৩৭)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৩৬)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৩৫)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৩৪)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৩৩)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৩২)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৩১)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৩০)​
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৯)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৮)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৭)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৬)​
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৫)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৪)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৩)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২২)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২১)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২০)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৯)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৮)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৭)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৬)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৫)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৪)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৩)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১২)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১১)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১০)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৯)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৮)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৭)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৬)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৫)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৪)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (দিনাজপুর-৩)
পায়ে পায়ে ৬৪ জেলা (ঠাকুরগাঁও-২)
পায়ে পায়ে ৬৪ জেলা (পঞ্চগড়-১)

বাংলাদেশ সময়: ১০০৯ ঘণ্টা, মার্চ ০৫, ২০২০
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।