ঢাকা, বুধবার, ২৮ কার্তিক ১৪৩১, ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ১১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

সাগর-নদী-পাহাড়-বন, ভ্রমণে চনমনে হলো মন

রেফায়েত উল্যাহ রুপক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৫৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ১২, ২০২৪
সাগর-নদী-পাহাড়-বন, ভ্রমণে  চনমনে হলো মন

রাত ১টা, মঙ্গলবারের প্রথম প্রহর,  চারদিকে সুনশান নীরবতা। একটি ব্যাগ কাঁধে গুটি গুটি পায়ে হেঁটে যাচ্ছি ১ নং গেইটের দিকে।

কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে থাকতেই দুটি হেডলাইট জ্বেলে একটা বড় এসি বাস এসে থামলো সামনে। চট করেই উঠে পড়লাম বাসে। পরিচিত সব মুখ। সবার সঙ্গে কুশল বিনিময় শেষে বসলাম নিজের সিটে।

কানে হেডফোন গুঁজে দিলাম। এরপর একে একে কিশোর কুমার, কুমার বিশ্বজিৎ, নচিকেতা, আসিফ আকবর, চমক হাসানসহ কিংবদন্তি সব শিল্পীর গান বাজছে। আমি গান শুনছি আর এগিয়ে চলছে গাড়ি। গন্তব্য কক্সবাজার, প্রিয় চবি সাংবাদিক সমিতির মিনি ট্যুর। যদিও এই মিনি ট্যুরের আয়োজন গ্র্যান্ড ট্যুরের চেয়ে কম নয়। আশপাশের সবাই ঘুমাচ্ছে। তখনো নির্ঘুম চোখে আমি হেলান দিয়ে বসে আছি।

ভোরের আলো মাত্রই ফুটতে শুরু করেছে। ৩৬ সদস্যের টিম বাসটি এসে থামলো কক্সবাজার। সমুদ্র সৈকতের লাবনী পয়েন্টে গিয়ে দাঁড়াতেই অন্যরকম এক অনুভূতি। সদ্যফোটা আলো, সমুদ্রের গর্জন, স্নিগ্ধ বাতাসের ছোঁয়ায় যেন মহান রবের এক অনন্য নিয়ামতে সিক্ত হলাম সবাই।

এখান থেকে শুরু আমাদের সমুদ্র সৈকত ঘোরাঘুরি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির (চবিসাস) সমুদ্র বিলাস।

লাবনী পয়েন্টে ঝলমলে সকাল
বিস্তীর্ণ বেলাভূমি, সারি সারি ঝাউবন, সৈকতে আছড়ে পড়ছে বিশাল ঢেউ। সকালবেলা দিগন্তে জলরাশি ভেদ করে রক্তবর্ণের থালার মতাে সূর্যেরও দেখা মিললো। প্রকৃতির স্নিগ্ধতায় যেন কেটে গেল ভ্রমণে ক্লান্তি আর চোখে লেগে থাকা নির্ঘুম রাতের আবেশ। সবাই মিলে হালকা নাশতা সেরে নিলাম। গ্রুপ ছবি তোলার পর সবাই ছড়িয়ে পড়লো বিস্তীর্ণ সৈকতে। সমুদ্রের মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্যে যেন অবগাহন করলাম। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্রের ঢেউ বড় হতে থাকলো।

সুগন্ধা পয়েন্টে কিছুক্ষণ
বিশাল বেলাভূমি আর আছড়ে পড়া লোনাজলে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম সুগন্ধা পয়েন্টে। ১২০ কিলোমিটারের পৃথিবীর সর্ববৃহৎ সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারের অন্যতম আকর্ষণীয় বিচ এই সুগন্ধা পয়েন্ট। অসংখ্য পর্যটকের উপস্থিতি এখানে। কেউ ছবি তুলছেন, কেউ সমুদ্রজলে গোসল করছেন, কেউবা টগবগিয়ে ঘোড়ায় ছুটছেন। স্পিড বোটে চড়ে অনেকের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসও দেখা যাচ্ছে। সকাল ৯টায় আমরা সবাই করে নিলাম সকালের নাশতা। এরপর আমাদের বাস ছুটে চললো পরবর্তী গন্তব্যের দিকে।

রামু রাবার বাগান
দুপাশে বাড়িঘর, গাছপালার সারি ফেলে ছুটছে আমাদের বহনকারী বাসটি। কক্সবাজার জেলা শহর থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে রামু উপজেলায় পাহাড় ও সমতলের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা ঐতিহ্যবাহী রামু রাবার বাগান আমাদের গন্তব্য। এসির শীতল বাতাসে কেউ কেউ তন্দ্রাচ্ছন্ন। এমন সময় ডাক এলো সবাই নামো, আমরা রাবার বাগানে এসে গিয়েছি। প্রথমেই সবাই মিলে গ্রুপ ছবি তুলে নিলাম। এরপর সবাই নিজের মতো করে ঘুরে দেখছে রাবার বাগান। মাঝারি গাছগুলো থেকে রাবার সংগ্রহের পদ্ধতিটি চমৎকার লাগলো। গাছগুলোও সুন্দরভাবে সারিবদ্ধ করে লাগানো। দেখেই বোঝা যাচ্ছে পরিকল্পিত বনায়ন। গুগল করে জানলাম ১৯৬০-৬১ সালে বাংলাদেশ বন শিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশনের সহায়তায় অনাবাদি জমি গবেষণার মাধ্যমে রামুতে রাবার চাষাবাদ শুরু করা হয়। ছোট বড় অসংখ্য পাহাড়, টিলা ও বিস্তৃত সমতল পাহাড়ের মাঝে দুই হাজার ৬৮২ একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত এটি।

শুরুর দিকে বাগানে উৎপাদনক্ষম ৫৮ হাজার রাবার গাছ থাকলেও বর্তমানে প্রায় এক লাখ ৪০ হাজার গাছ রয়েছে। একটি রাবার গাছ ২৫ বছর পর্যন্ত রাবার কষ উৎপাদন করতে পারে। তবে রাবার বাগান ঘুরতে গিয়ে একটি বিশাল বৃক্ষের দিকে চোখ আটকে যায় আমাদের। দেখে মনে হচ্ছিল শতবর্ষী এটি। আমাদের বেঁধে দেওয়া সময় শেষ হলো। পাশেই আমাদের দুপুরের খাবার অর্ডার দেওয়া ছিল। প্যাকেটজাত খাবারগুলো তোলা হলো বাসে। এবার আমাদের গন্তব্য দক্ষিণের সর্বশেষ উপজেলা টেকনাফের দিকে।

টেকনাফ সি-বিচে মনোমুগ্ধকর বিকেল
রামু থেকে ছুটছে আমাদের বাস। এবার গন্তব্য টেকনাফ। তবে উখিয়ায় গিয়ে নষ্ট হয়ে গেল গাড়ির এসি। প্রচণ্ড গরমে হাঁসফাঁস করছিল সবাই। তাই গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম আমরা। পাশে থাকা দোকানে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে গল্পে-আড্ডায় মেতে উঠেছে কেউ, কেউবা খাচ্ছে চিপস, কেউ খাচ্ছে আইসক্রিম বা ঠাণ্ডা পানীয়। এভাবেই কেটে গেল প্রায় দেড় ঘণ্টা। এসি ঠিক করে আবারও গাড়ি চলছে আপন গতিতে। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ মায়ানমারের সীমান্তবর্তী নাফ নদী। ঘড়ির কাঁটায় তখন আড়াইটা ছুঁই ছুঁই। আমরা বাস থেকে নেমে নাফ ট্যুরিজম পার্কের সামনে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। এরপরই তাড়াতাড়ি রওনা দিলাম টেকনাফ সি-বিচের দিকে। আমাদের গাড়ি পৌঁছে গেল গন্তব্যে। আসরের সুমধুর আজান শুনতে পেলাম। নামাজ পড়ে সি-বিচে কয়েক মিনিটের অবস্থান। কেউ কেউ ছবি তুলছেন, কেউবা করছেন সৌন্দর্য উপভোগ। কী চমৎকার এক আবহ!

অপূর্ব মেরিন ড্রাইভ
গাড়ি ছুটে চলছে, মেরিন ড্রাইভের অপূর্ব সৌন্দর্য আমাদের মুগ্ধ করে। এক পাশে সমুদ্র আরেক পাশে পাহাড়। যেন স্রষ্টা নিজ হাতে সাজিয়েছেন এটি। এদৃশ্য যে কাউকে মুগ্ধ করবে। মুগ্ধ হয়েই সবাই ক্যামেরাবন্দী করছে এই অপরূপ দৃশ্য। চোখ জুড়ানো এই দৃশ্য যেন মনেও গেঁথে গেছে।

কাঁকড়া বিচে মোহনীয় সন্ধ্যা
সূর্য ডোবার আগে কেউ খেলছে ফুটবল, কেউ তুলছে ছবি। আবার কয়েকজন সমুদ্রে মেতে উঠেছে গোসলে। ক্রমেই যেন সূর্য হারিয়ে যাচ্ছে গহীনে। এমন সময় লাল কাঁকড়াও ছুটে চলছে দলবেঁধে। আঁধার নেমে এলো চারিদিকে। আমরা উঠে পড়লাম বাসে। মাঝে দেওয়া হলো সামান্য কিছু ফল। এরপর রাত ৮টার দিকে গাড়ি থেকে নেমে সবাই মিলে তৃপ্তি নিয়ে রাতের খাবার খেলাম।

এবার ফেরার পালা
রাতের খাবার শেষে আমাদের এবার ফেরার পালা। গাড়ি চলছে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে। গাড়িতেই হলো ট্যুরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় আয়োজন র‍্যাফেল ড্র। বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণের মধ্যে দিয়ে ট্যুরের আয়োজন সমাপ্ত হয়। এরপর চট্টগ্রামে আসার পর বিভিন্ন জায়গায় একজন একজন করে নামছে আর গাড়ি খালি হচ্ছে। ক্লান্ত শরীরে নিমিষেই ঘুম এসে গিয়েছিল। আজহার ভাইয়ের ডাকে ঘুম ভাঙলে দেখি আমরা ১নং রেল ক্রসিং। তাড়াতাড়ি নেমে পড়লাম। ঘড়িতে তখনো রাত ১টা, বুধবারের প্রথম প্রহর। ঠিক ২৪ ঘণ্টায় শেষ হলো আমাদের মিনি ট্যুর। মাত্র একদিনেই সাগর-নদী আর পাহাড়-বন একসঙ্গে দেখতে পারার আনন্দে হৃদয়ে খেলে গেল উচ্ছ্বাসের ঢেউ।

বাংলাদেশ সময়: ১৭৩৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ১২, ২০২৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।