ঢাকা, মঙ্গলবার, ৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৯ মার্চ ২০২৪, ০৮ রমজান ১৪৪৫

ট্রাভেলার্স নোটবুক

১ম পর্ব

এপ্রিলে, সিঙ্গালিলায়

অনিমিখ পাত্র | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৫০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৩, ২০২১
এপ্রিলে, সিঙ্গালিলায় ছোট্ট নদী মোমোখোলা দূরে দেখা যাচ্ছে। পালমাজুয়া

কেউ কথা বলে না পাখিদের হয়ে। মস আর ফার্নের হয়ে, বুনো শুয়োরের হয়ে।

ঝিঁঝিঁপোকা কিংবা পাইনগাছের হয়ে। সিঙ্গালিলার অরণ্য পাহাড়ে, লম্বা হাঁটাপথে আর অরণ্যঘেরা একটুকরো গ্রামে বুড়ো সোনম ওয়াংদির ডেরায় ডানামেলা চমৎকার কয়েকটা দিন কাটানোর পর সমতলে নামতেই দেখি মানুষ আর জায়গা কিছুই খালি রাখেনি। নিজেকে নিয়েই সে ভারি ব্যস্ত।

রাতেই শিলিগুড়ি থেকে উঠে পড়েছিলাম গাড়িতে, ফেসবুকে আমারই একটা পুরনো পোস্টে অনুজ বন্ধু দীপব্রত মন্তব্য লিখেছিল যে পাহাড়ে ওঠার সময়টায় সবচেয়ে প্রিয় অনুভূতিটা হয়- যেন পিঠের থেকে বেরিয়ে আসে দু’খানা ডানা, রাতের মোটরকারে তো ঘুমিয়েই পড়লাম, এবারে সেই আশ্চর্য সুন্দর থেকে বঞ্চিতই হতে হলো। মানেভঞ্জনে পৌঁছে ঘুম ভাঙলো যখন, আলো সবে ফুটছে। সেই মানেভঞ্জন, যার অনতিদূর থেকে অফিসিয়ালি শুরু হয়েছে সিঙ্গালিলা ন্যাশনাল পার্কের প্রবেশ।   ট্রেকপথে চেরি ব্লসম।  টংলুর কাছাকাছি, ডানে অরণ্যগ্রাম ধোত্রে

পাখির সীমান্ত থাকে না, কীটপতঙ্গ, জন্তুদেরও নয়, অরণ্যেরও কি থাকে নাকি? এই জনপ্রিয় সান্দাকফু, স্থানীয় উচ্চারণে যা সান্দাকপুর, এই ট্রেকপথে আশ্চর্যজনকভাবে মানুষেরও সীমান্ত থাকে না। মানেভঞ্জন থেকেই সেই সীমানা হারানোর শুরু, বাজারে রাস্তার পাশ দিয়ে একটা নালা- তার দু'পাশে পা রেখে দাঁড়ালে এক পা পড়ে ভারতে আর আরেকটি পা নেপালে। এই গোটা রাস্তাটাই ইংরেজিতে যাকে বলে ‘ফ্লার্টিং উইথ ইন্টারন্যাশনাল বর্ডারস’। সেনা নেই, সাঁজোয়া নেই, নিদেনপক্ষে কাঁটাতারও নেই।  

তবে, এবার আমরা সে পথে যাবো না।               
আমরা ধরলাম ধোত্রে হয়ে পালমাজুয়ার পথ। ভোরের জঙ্গল থেকে ছুটে গেল সিঙ্গালিলার স্পেশাল পাখি কালিজ ফেজান্ট, কালো পালকে মোড়া গা, চোখের কাছে লালের পোঁচ- পুরুষ আর স্ত্রী জোড়া। ঈশ্বর মানি না, তাই সৌভাগ্যকেই ধন্যবাদ দিলাম। যাওয়ার সময়ই দেখলাম ধোত্রে থেকে পালমাজুয়ার পিচরাস্তাটি ভারি সুন্দর, বিরাট বিপুল পাইন, সিলভার ফার, রডোডেনড্রন আর বাঁশগাছে ঢাকা। পাইনগাছের চাঁদোয়া এমন যে রোদ পৌঁছায় না কোথাও কোথাও। তখনই ঠিক করি, পাহাড়ি ফরেস্ট ভিলেজ ধোত্রেতে আমরা আসবো বটে, তবে গাড়িতে চড়ে নয়। কোনো ফিক্সড প্ল্যান নেই, ফলে যেদিকে দু’চোখ যায় চলে যেতে পারি।  পালমাজুয়া থেকে ধোত্রে।  যে রাস্তায় মাঝে মধ্যে রোদ পড়ে না

আপাতত গিয়ে উঠি সিঙ্গালিলার বাইরের দিকে এক জঙ্গলকুটিরে, তার সামনে হিমালয়ের সিগনেচার বৃক্ষরাজি আর অঢেল অদেখা রঙিন পাখি। পুরোদস্তুর বার্ডওয়াচার নই, ফলে তাদের আমি নামই জানি না। খানিক হেঁটে আসি রিম্বিকের দিকে চলে যাওয়া রাস্তা ধরে, আওয়াজ শুনতে শুনতে চোখে এসে পড়ে পাহাড়ি এক ধারা- মোমোখোলা। ‘খোলা’ মানে নেপালি ভাষায় ছোট নদী।  বুড়ো সোনম ওয়াংদি

পরদিন হাঁটতে থাকলাম দু'জনে। ১৩ কিলোমিটার রাস্তা, চড়াইয়ের দিকে। এই রাস্তায় সাধারণত কেউ হাঁটে না। গাড়িতে যায়। কিন্তু না হাঁটলে কীভাবে টের পাওয়া যাবে পাথরের হৃৎস্পন্দন, নীরবতার গান, প্রাচীন সব গাছের আত্মীয়তা! হিমেল হাওয়ায় ভিজে কেমনই বা চকিতের রৌদ্র অনুভূতি! মাঝে মধ্যে থামি আমরা, ছবি তুলি, ঝিঁঝি আর পাখপাখালির সঙ্গীত শুনি। পাইনের মোটা থামের মতো গুঁড়ি সবুজ মস আর শ্যাওলায় ঢাকা, তাতে এসে পড়েছে চুরি করা রোদ্দুর, সেদিকে তাকিয়ে সব শোক ভুলে যাওয়া যায়। এই রাস্তার অধিকাংশই রেড পান্ডার আবাসস্থল। কচি বাঁশ তো রেড পান্ডার খাদ্য, তাই বাঁশের জঙ্গলে চোখ রাখতে রাখতে এলাম, কিন্তু ওরা বড়ই লাজুক, দেখা দেয় না মোটে! হাঁটতে হাঁটতে জল ফুরিয়ে গেল। সামনে ভোট, তাই ইলেকশনের গাড়ি ও জওয়ানদের আনাগোনা আছেই। হাত দেখিয়ে গাড়ি থামিয়ে জল চাইতে লাগলাম, একজন দিয়ে দিলেন একটা বোতল। যুদ্ধজয়ের স্মারকের মতো এক একটা মাইলস্টোন গুনতে গুনতে এসে পড়লো পনাম্বার থার্টিন, তখনও বিকেল কিছুটা আছে।        পালমাজুয়ার জঙ্গল

ধোত্রে- হাতের তেলোর মতো ছোট দোহারা গ্রাম। পিচরাস্তার একঢালে কয়েকটা হোমস্টে, অপর ঢালে গ্রামবাসীদের গোনাগুনতি একরঙা বাড়ি। ধোত্রের অর্কিড ডেল হোমস্টে, সেরা থাকার জায়গা, বিরাট কাচের জানলার ওপারেই ঘন অরণ্য। লেপার্ড, ভালুক, বুনো শুয়োর মাঝেমধ্যেই হানা দেয়। তা, শুয়োর দেখার সৌভাগ্যও হলো। মানুষ ওদের গা-সওয়া হয়ে গেছে। বুড়ো সোনমজি নিজেই আস্ত গল্প একখানা, নেপালি ভাষায় কবিতা লেখেন, ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট থেকে অবসর নেওয়ার পর হোমস্টে খুলেছেন। সঙ্গে আছে ভীষণই প্রাণবন্ত ও যত্নশীলা কন্যা, নাম তার ছোড়েন। তাদের আতিথেয়তা আমাদের পথশ্রম ভুলিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্টই ছিল।  

আমাদের খাওয়া-দাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে সোনম ওয়াংদি শোনান তার জীবনগল্প, যা রূপকথার চেয়ে তেমন কী আর কম! গরিবের চেয়েও গরিব ছিলেন তারা একসময়ে। আরও প্রত্যন্ত জায়গা থেকে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের দয়ায় মেলা একখণ্ড জমি পেয়ে ধোত্রেতে উঠে আসেন সোনমজির পরিবার। ওই সবজি ফলিয়েই যা হতো, তার সঙ্গে জুড়ে যেত রাস্তা বানানোর হাড়ভাঙা খাটুনি। একসময় দিনরাত পাথর ভেঙেছি, বুড়ো সোনম স্মৃতি খুঁড়তে থাকেন। তারপর হঠাৎই এক ফরেস্ট রেঞ্জারের নেকনজরে পড়ে যান যুবক সোনম। পাহাড়ি ঢালের উপযুক্ত বাড়ি বানানোয় বেশ বুদ্ধি খেলে তার। আর ধীরে ধীরে দার্জিলিং রেঞ্জের ফরেস্ট ডিভিশনের মুশকিল আসান বান্দা হয়ে ওঠেন সোনম ওয়াংদি। অবস্থা ফেরে তার পরিবারের। নিষ্ঠার সঙ্গে অরণ্যের সেবা করেছেন সোনমজি।  

চলবে...

অনিমিখ পাত্র: ১৯৮৩ সালে জন্ম। ইংরাজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত। প্রকাশিত কবিতার বই ছয়টি: যতদূর বৈধ বলি (২০০৯), কোনো একটা নাম (২০১৩), পতনমনের কুর্সি (২০১৬), সন্দেহপ্রসূত কবিতাগুচ্ছ (২০১৭), আলো দেখার নেশা (২০১৯), রাস্তার কোনো ছুটি নেই (২০২০)। 'দুনিয়াদারি' নামক একটি দ্বিভাষিক অনলাইন সাহিত্য-সংস্কৃতি জার্নালের সহ-সম্পাদক (duniyaadaari.com)। সমসাময়িক বিশ্বের কবিতা বাংলায় অনুবাদ প্রচেষ্টায় নিয়োজিত।  
  
বাংলাদেশ সময়: ০৮৩৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৩, ২০২১
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।