লালপুর (নাটোর) থেকে: সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে গিয়ে আঁতকে উঠলাম আচমকা। ছোপ ছোপ রক্তের দাগ।
নাটোর লালপুরের নর্থ বেঙ্গল সুগার মিল আবাসিকের ভেতরে সংঘঠিত গণহত্যার সংরক্ষিত স্মৃতিচিহ্নের কথা বলছি। বাহ্যিক রক্তের দাগ হয়তো মুছে গেছে এতোদিনে, কিন্তু মোছেনি সে ক্ষতচিহ্ন, দূর হয়নি হৃদয়ের রক্তক্ষরণ। সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে সেদিন যে রক্তস্রোত যে পানিতে মিশেছিলো, পরিণত হয়েছিলো রক্তসাগরে- সে পুকুর আজও সেই ক্ষতচিহ্ন বয়ে চলেছে। বুলেটের ক্ষতগুলো আছে সেভাবেই। সেখানে লাল রং ঝরিয়ে জিইয়ে রাখা হয়েছে সে বাস্তবতা, নৃশংসতার নিদর্শন। নতুন প্রজন্মকে আমাদের মতোই চমকে দেবে যেকোনো সময়। বলে দেবে পাকিস্তানিদের স্বরূপ।
বধ্যভূমিটির নামকরণ হয়েছে শহীদ সাগর। সুন্দর, গোছালো নিস্তব্ধতা। কমপ্লেক্সের ভেতরে ঢুকে সোজা তাকালেই সেই আতঙ্কের পুকুর। দুপাশে ফুল-পাতাবহারের গাছঘেরা। একটু এগিয়ে বাঁপাশে পুকুরের পাড়ঘেঁষে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ। সেদিন শহীদ হওয়া ৪২ জনের নাম পরিচয় খোদাই মার্বেল পাথরে। পুকুরের সিঁড়ি দিয়ে কেউ পানিতে নামে না। জমে থাকা শ্যাওলাও যেন দিয়ে চলেছে সে বারতা। রক্তের দাগের কৃত্রিমতাও অনেক জীবন্ত।
সেদিনের নৃশংসতম সে হত্যাকাণ্ড থেকে দৈবক্রমে বেঁচে যাওয়া কয়েকজনের বর্ণনায় শিউরে ওঠে গায়ের রোম।
ঘটনা ১৯৭১ সালের ৫ মে’র। বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম চিনিকল নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলে কাজ করছিলেন কর্মকর্তারা-কর্মচারীরা। সময় সকাল ১০টা। চিনিকলের তৎকালীন জিএম ছিলেন লেফটেন্যান্ট (অব.) আনোয়ারুল আজিম। গোপালপুরে এক যুদ্ধে নিহত হন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা।
পরে ৫ মে চিনিকল দখলে নেয় পাকিস্তানিরা। প্রায় ২শ’ জনকে আটক করে প্রথমে গাছের গোড়ায় রাখে। তারপর রাস্তায় শুইয়ে দেয়। পরে বাছাই করে নিম্নশ্রেণীর কয়েকজনকে দেয় ছেড়ে। বাকিদের নিয়ে লাইন ধরে দাঁড় করানো হয় অফিসার্স কোয়াটারের পুকুরের সিঁড়িতে। লে. আজিম নিজের জীবনের বিনিময়ে তার সহকর্মীদের ছেড়ে দিতে বলেন। কিন্তু পাকিস্তানি হায়েনারা স্বয়ংক্রিয় এলএমজির ফায়ার করে। মুহূর্তে সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে রক্তসাগরে পরিণত হয় পুকুরের পানি। পুকুর হয়ে ওঠে লাশের স্তূপ। ১৯৭৪ সালে স্মৃতিস্তম্ভ বানিয়ে এটি সংরক্ষণ করা হয়।
সংরক্ষিত এ বধ্যভূমিটি তালা লাগানো থাকে। কেউ এলে খুলে দেওয়া হয়। পাশের অতিথিশালার কেয়ারটেকার শাহ আলম আমাদের নিয়ে যান ভিতরে। দেখান সব ঘুরিয়ে। দেখান কীভাবে সেদিন কয়েকজন পুকুরের এক কোণে থাকা ড্রেন দিয়ে পালিয়ে যান। কথা প্রসঙ্গে জানা যায় সেদিন বেঁচে সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়াদের একজন পাশের গোপালপুর বাজারে থাকেন।
তোড়জোড় শুরু হলো তার মুখে সেদিনের ভয়াবহ সে অভিজ্ঞতার কথা শোনার। তার আগে ঢুঁ মারলাম শহীদ সাগর জাদুঘরে। শহীদ সাগর গেটের ঠিক উল্টো পাশে এর অব্স্থান। এক কক্ষের এ জাদুঘরে রয়েছে লে. আজিমসহ কয়েকজনের ছবি, ব্যবহৃত জিনিস। সেখান থেকে বেরিয়ে নানা জনের কাছে শুনে শেষতক যখন সেদিন বেঁচে যাওয়া খন্দকার জালালের বাড়ি পৌঁছুলাম তখন তিনি বের হচ্ছেন নামাজে। তবু সময় দিলেন কিছুক্ষণ। বললেন সেদিনের কথা।
তখন সকাল ১০টা বাজে। আমি কাজ করছিলাম। হঠাৎ চারদিক দিয়ে মিল ঘিরে ধরে নিয়ে এলো সবাইকে। আমি, আমার বাবা ও ছোট ভাই তখন মিলে চাকরি করি। তিনজনকেই পাকিস্তানি সৈন্যরা ধরে নিয়ে গেলো। প্রথমে একটি গাছের গোড়ায় জড়ো করলো। পরে শুইয়ে দিলো। পরিচয় জেনে নিম্নশ্রেণীর কয়েকজনকে দিলো ছেড়ে। আমাদের নিয়ে গেলো পুকুর পাড়ে। সিঁড়িতে দাঁড় করালো। আমার ছোট ভাই মান্নান তখন আমাকে বললো, ভাইয়া ওরা আমাদের মেরে ফেলবে।
আমি তখন ওকে বললাম, গুলি লাগলে আমার আগে লাগবে। পরে ১২ জন সৈন্য পজিশন নিয়ে শুধু বারবার জানতে চাচ্ছিলো কখন গুলি করবে। ১১টা ৫ মিনিটে যখন ওর্ডার এলো তখন আমার সামনেই ছোট ভাই ঝাঁঝরা হয়ে লুটিয়ে পড়লো। আমার কি হয়েছিলো জানি না, কীভাবে যেন লাশের নিচে পড়ে গেলাম। গুলি লাগেনি। কিন্তু কিছুতেই চোখ বন্ধ রাখতে পারছিলাম না। এক সময় তারা এটা দেখে ফেলে। তখন নেমে এসে গুলি না করে বেয়োনেট চার্জ করে বুকে। কিন্তু ভিতরে না ঢুকে চামড়ার উপর দিয়ে চলে যায়। পরে ঘাড়েও একই ঘটনা ঘটে। কারণ আমি কাত হয়ে ছিলাম৷'
বলতে বলতে চোখের কোণায় জমছিলো অশ্রুবিন্দু। থেমে কিছুক্ষণ লুকানোর চেষ্টা। তারপর আবার কথা বলা।
মরে গেছি মনে করে ওরা পানিতে ফেলে দিয়ে চলে গেলো। কিছুক্ষণ পর মেহমান আলী নামে আরেকজন লাশের নিচ থেকে বেরিয়ে এসে আমাকে সিঁড়ির উপর তুলে দেয়। তিনি লাশের নিচে কোনো রকম নাক বের করে বেঁচে ছিলেন। পরে অনেক কষ্টে পুকুরের এক কোণের ড্রেন দিয়ে পালাতে পারি। আমার বাবা পুকুরের কোণে এক ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে থেকে এসব দৃশ্য দেখে প্রায় পাগল হয়ে গেছিলেন। তার মতো আরও ছয় সাতজন সেদিন বেঁচে গিয়েছিলেন। সবাই বেঁচে আছেন কোনো না কোনো ক্ষত নিয়ে। '
নিজে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন বলেও জানান তিনি। তবে স্বীকৃতি মেলেনি এখনো।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অন্যতম নারকীয় এ হত্যাকাণ্ড এখনো তাড়িয়ে বেড়ায় শহীদ পরিবার, বেঁচে থাকা যোদ্ধাদের। এ বধ্যভূমি, হত্যাযজ্ঞের ইতিহাস হাজার বছর ধরে পরবর্তী প্রজন্মকে জানাবে মুক্তিযুদ্ধের কথকতা।
শহীদের রক্তমাখা সেই শুচি জল-হাওয়া থেকে শিক্ষা নিতে চলে যান নাটোর শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরের নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলে। ব্যক্তিগত বাহন না থাকলে যেতে হবে কয়েকবার নাছিমন বা অটোরিকশা বদলে। রাস্তাও বিশেষ ভালো না। যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও ভালো হলে শহীদ সাগর হয়ে উঠতে পারে আগামী প্রজন্মের কাছে অন্যতম শিক্ষণীয় স্থান।
বাংলাদেশ সময়: ০৭২৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৯, ২০১৬
এসএস/এএ/জেডএম
** ‘অলৌকিক’ কুয়া, বট ও নারিকেল গাছের গল্প
** মানবতার ভাববিশ্বে পরিভ্রমণ
** পর্যটন বর্ষে ব্যাপক আয়োজন: ৩০ শতাংশ ছাড়
** আহসান মঞ্জিলে নতুন রঙ, অন্দরমহলে গ্যালারি হচ্ছে