ঢাকা, শনিবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

উপবৃত্তিতে অদম্য গঙ্গাচড়ার রোজিনারা

রাইসুল ইসলাম, এডিশনাল আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৫০ ঘণ্টা, মার্চ ২২, ২০১৬
উপবৃত্তিতে অদম্য গঙ্গাচড়ার রোজিনারা ছবি: জি এম মুজিবুর- বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

গ্রামবাংলার নারী শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে উপবৃত্তি প্রকল্প। উপবৃত্তি শুধু মেয়েদের ক্লাসরুমেই ফেরত আনছে না, গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে তাদের ক্ষমতায়নেও।

পাশাপাশি বাল্যবিবাহ রোধেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে উপবৃত্তি। অনেকটা এই উপবৃত্তির কাঁধে ভর দিয়ে নারী শিক্ষার আলো ছড়িয়ে পড়ছে দেশের প্রত্যন্ত পল্লী অঞ্চলগুলোতেও। উত্তরবঙ্গের রংপুর ও গাইবান্ধা জেলার প্রত্যন্ত এলাকাগুলো ঘুরে চোখে পড়লো এই চিত্র।
 
অবহেলিত ও পশ্চাৎপদ এসব এলাকায় একটা সময় মেয়েদের স্কুল কলেজে যাওয়াকে ভালো চোখে দেখা হতো না। কিংবা স্কুলে গেলেও মা বাবার আর্থিক অস্বচ্ছলতা কিংবা সচেতনতার অভাবে ঝড়ে পড়তে হতো অকালেই। সেই পরিস্থিতির এখন পরিবর্তন হয়েছে ব্যাপক। মেয়েরা শুধু স্কুল-কলেজেই যাচ্ছে না পারিবারিক বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রেও মেয়েটির মতামতকে গুরুত্ব দিচ্ছে পরিবার।
 
তাইতো রংপুরের প্রত্যন্ত গঙ্গাচড়ার তিস্তা নদীর তীরের বড় বিলের মাঝখানে কৃষকদের বলতে শোনা যায় “বেটি ছাওয়াল ঘরের খ্যামোতাই এখন বেশি”।

অফিসের অ্যাসাইনমেন্টে ঘুরে বেড়াচ্ছি উত্তরবঙ্গের মাঠঘাটে। রংপুর থেকে গাইবান্ধার গ্রাম থেকে গ্রামে। ব্রহ্মপুত্রের বালাসী ঘাট থেকে তিস্তার দ্বারকাডোবা ঘাট। উত্তরের পথে প্রান্তরে চলার পথে কথা বলছি নারী থেকে শিশু, কৃষক থেকে শ্রমিক নানা পেশার সাধারণ মানুষের সঙ্গে।
 
স্মরণে আছে বসের নির্দেশ ‘কথা বলো মানুষের সঙ্গে, তুলে ধরো তাদের কথা’। আরও বলেছিলেন, কোনো এলাকার সত্যিকারের চিত্র তুলে ধরতে যেতে হবে ওই জেলার সবচেয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে। তিনিই বললেন, গঙ্গাচড়ার তিস্তার চরে যেতে। নদীভাঙ্গন আর মঙ্গাপীড়িত এলাকা হিসেবেই সারাদেশে পরিচিত এই এলাকা।
 
গঙ্গাচড়ার উপজেলারই একটি গ্রামের নাম ধামুর। চলার পথে এখানেই কথা হলো গঙ্গাচড়া মহিলা ডিগ্রি কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী রোজিনা বেগমের সঙ্গে।
 
রোজিনারা দুই ভাই দুই বোন। পিতা পানের দোকানদার ও বর্গাচাষি। পানের দোকানের আয় দিয়েই সংসার চলে তাদের। তিস্তা নদীর ভাঙ্গনে নিঃস্ব পরিবারটির নিজের জমি নেই। বর্গা নেয়া সামান্য জমিতে কিছু আবাদ হয়।

তবে দরিদ্র পিতার সামর্থ্য না থাকলেও থেমে থাকেনি রোজিনার পড়াশোনা। এ জন্য উপবৃত্তির কথাই কৃতজ্ঞতাভরে স্মরণ করলেন রোজিনা। উপবৃত্তির কারণে প্রাথমিক থেকেই তার পড়াশোনার খরচ চালাতে কোনো সমস্যা হয়নি। বই খাতা নোট কেনার পাশাপাশি এমনকি স্কুল কলেজে যাওয়ার জন্য বছরে একটা দুটো পোশাকও বানাতে পেরেছেন তিনি।
 
উপবৃত্তির কারণে বাল্যবিয়ের হাত থেকেও রক্ষা পাওয়ার কথা জানালেন রোজিনা। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় একবার দাদা দাদীর মাধ্যমে তার বিয়ের কথা হয়। কিন্তু রোজিনার মায়ের দৃঢ়তা এবং উপবৃত্তির কল্যাণে বিয়েটা আর হয়নি। উপবৃত্তি পাওয়ার বেশ কিছু শর্তের মধ্যে একটি হলো এসএসসি পর্যন্ত অবিবাহিত থাকা। তাই যখন বিয়ের কথা এলো তখন রোজিনা ও তার মায়ের অমত দেখে তার বাবাও খুব একটা তোড়জোড় করেননি। ‘মেয়ে যখন পড়ছে তখন পড়ুক। পড়াশোনার খরচ তো আর লাগছে না। ’ এই ছিলো রোজিনার পিতার মনোভাব। এভাবেই বাল্য বিয়ের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া রোজিনা এখন স্বপ্ন দেখছেন পড়াশোনা শিখে আরও বড় হওয়ার।
 
কথা হয় গঙ্গাচড়ার উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শাহনাজ বেগমের সঙ্গে। জানালেন, আগের থেকে স্কুল কলেজে মেয়েদের উপস্থিতি বেড়েছে। কোন কোনো ক্ষেত্রে উপস্থিতির দিক থেকে ছেলেদের থেকে এখন মেয়েদের সংখ্যাই এখন বেশি। এজন্য তিনি কৃতিত্ব দিলেন সরকারের উপবৃত্তি কার্যক্রমকে।

ডিগ্রি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক হওয়ায় নারী শিক্ষার্থীদের তো বেতন লাগছেই না উল্টো ডিগ্রি পর্যন্ত উপবৃত্তির টাকা পাচ্ছেন অস্বচ্ছল ও দরিদ্র পরিবারের মেয়েরা।

আগের থেকে সহজ হয়েছে উপবৃত্তির শর্তও। আগে উপবৃত্তি পেতে কোনো শিক্ষার্থীকে শতকরা ৪৫ শতাংশ নাম্বার পেতে হতো। এখন তা নামিয়ে আনা হয়েছে ৩৩ এ। এছাড়া প্রায় ২৭টি ক্রাইটেরিয়ার আওতায় ‍উপবৃত্তি প্রদান করায় এর আওতা থেকে বাদ যাচ্ছে না দরিদ্র ও অস্বচ্ছল পরিবারগুলোর কোনো মেয়ে। শাহনাজ বেগম জানালেন, এই মুহূর্তে গঙ্গাচড়ার দরিদ্র নারী শিক্ষার্থীদের প্রায় শতভাগই উপবৃত্তির আওতায়।

উপবৃত্তির আওতায় এসএসসির ফরম পূরণ পর্যন্ত মাধ্যমিকে একজন নারী শিক্ষার্থী পাচ্ছেন ৬ হাজার ৪৫০ টাকা। এছাড়া ডিগ্রিতে মেয়েদের উপবৃত্তি দেয়া হচ্ছে ৪ হাজার ৯শ’ টাকা। উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের নারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে শতকরা ৪০ ভাগই উপবৃত্তির আওতায়। অস্বচ্ছল নারী শিক্ষার্থীদের প্রায় সবাই এর আওতায়।
 
শাহনাজ বেগম জানালেন, উপবৃত্তি রোধ করছে বাল্য বিবাহের প্রসারও। উপবৃত্তি পাওয়ার শর্তগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো এসএসসি পর্যন্ত অবিবাহিত থাকা। ফলে দরিদ্র পরিবারগুলোর পিতামাতারা আল বাল্যবিবাহে আগ্রহী হচ্ছে না। ধামুর গ্রামের নারী শিক্ষার্থী রোজিনাও ঠিক এই কথাগুলোই বলেছিলেন।
 
উপবৃত্তি প্রসার ঘটাচ্ছে মোবাইল ব্যাংকিংয়েরও। উচ্চমাধ্যমিক ও ডিগ্রি পর্যায়ে উপবৃত্তির টাকা দেয়া হচ্ছে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমেই।

উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শাহনাজ বেগম গঙ্গাচড়ায় কর্মরত আছেন প্রায় ৫ বছর। নারীর ক্ষমতায়নের তিনি নিজেও একটি উজ্জল দৃষ্টান্ত। জানালেন গঙ্গাচড়ায় আগের থেকে মেয়েদের আর্থ সামাজিক পরিস্থিতির অনেক উন্নয়ন হয়েছে। বেড়েছে নারীর ক্ষমতায়ন।

বাল্য বিয়ে এখন আর নেই বললেই চলে। বাল্য বিয়ে প্রতিরোধে উপবৃত্তির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা উল্লেখ করলেন তিনিও।

সব মিলিয়ে ‘মেয়ে মানুষ’ হিসেবে পিছিয়ে নেই নারীরা। আত্মশক্তিতে বলীয়ান হওয়ার পথে কোনো বাধাই আর তাদের থামিয়ে দিতে পারছে না। এমনকি গঙ্গাচড়ার প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতেও জ্বলজ্বল করে জ্বলছে নারী শিক্ষার আলো। শিক্ষা, ক্ষমতায়ন এবং কর্মসংস্থানে গ্রাম বাংলার নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে অপ্রতিরোধ্য গতিতে। এই এ গতির নৌকায় পালে বাতাস দিচ্ছে উপবৃত্তি প্রকল্প।
 
বাংলাদেশ সময়: ১২৩২ ঘণ্টা, মার্চ ২১, ২০১৬
আরআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে এর সর্বশেষ