মহেশখালী ঘুরে: রসুমিয়ার ব্রিজের গোড়ায় মাথা ভর্তি ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা শিশু গাছ। আগন্তুকদের স্বাগত জানাতেই যেনো এই সাজ শিশু গাছের।
এই খালের উত্তর-পশ্চিম প্রান্ত মিশেছে বঙ্গোপসাগরে। আর মহেশখালী চ্যানেলের মোহনায় মিশেছে দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্ত। ব্রিজ পেরুলেই গোরকঘাটা, মহেশখালী পৌরসভা এলাকা।
শুক্রবারের সকালে কোচিং শেষে বাড়ি ফিরছে ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা। তাদের ঘরবাড়িগুলোতে টিনের ব্যবহারই বেশি।
ব্রিজ পেরিয়ে একটু এগুলেই তিন রাস্তার মোড়ের ওপাশে পরিত্যক্ত জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে বসবাস পুলিশের।
রাস্তার দু’পাশে এখানে ওখানে লবণ ক্ষেত। গত কয়েকদিন ধরে বৃষ্টি বেশ ভোগাচ্ছে এখানকার লবণচাষীদের। শুকিয়ে যাওয়ার আগেই বৃষ্টিতে বিফলে যাচ্ছে লবণ চাষের প্রচেষ্টা।
ক্ষেতে বিছানো পলিথিনে জোয়ারের সময়ে ধরে রাখা হয় আধা ইঞ্চি পরিমাণ লবণ পানি। সপ্তাহভর রোদে শুকিয়ে সেই পানি পরিণত করা হয় লবণে। সেই লবণ পাঠানো হয় রিফাইনারিতে। রোদ যতো কড়া হয়, লবণ ততো ভালো হয়।
কিন্তু অসাবধানতাবশত অতিরিক্ত জোয়ারের পানি ঢুকে ভেসে গেছে লবণ ক্ষেত। সেই ক্ষেতে এখন ফুরসতহীন ব্যস্ততা লবণ চাষী শাহবাজের। এই ক্ষেতের মালিক আবু সাইয়িদ। ৬ মাসের জন্য ৫০ হাজার টাকায় ১০ কানি জমি ইজারা নিয়েছেন তিনি। পশ্চিমে হাড়িঘোনায় আরো সাড়ে ৫ কানি লবণ ক্ষেত আছে তার।
ওই পশ্চিমেই মূলত এখানকার বড় বড় সব লবণ ক্ষেত। ওদিকটার লবণও ভালো। আবু সাইয়িদ এর ভাষায়, এখানে ৫ হাজার টাকা কানিতে জমি ইজারা পাওয়া গেলে পশ্চিমে তার দর হয় ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা। এখানে পানি আসে মহেশখালী খাল থেকে, আর ওখানে সরাসরি বঙ্গোপসাগর পানি দেয়।
বর্ষাকালে ৪ মাস চিংড়ি চাষ হয় এই লবণের জমিতেই। স্থানীয় দোকানি মহিউদ্দিন জানান, এখানে উৎপাদিত লবণই বাসা-বাড়িয়ে ব্যবহার করেন তারা। পান, লবণ আর শুটকি-এই তিনে মহেশখালী। এই তিনটি জিনিস ছাড়া পুরো দ্বীপ অচল।
শুকনো মৌসুমে দ্বীপের উপকূলীয় বলয় জুড়ে মাইলের পর মাইল বিস্তৃত থাকে পানের বরজ, লবণ ক্ষেত আর শুটকি পল্লী।
এখানকার পানের মতো লবণের ওপরও নজর পড়ে ব্রিটিশ বেনিয়াদের। পঞ্চদশ শতাব্দীতে শুরু হওয়া লবণ চাষ থমকে যায় অষ্টাদশ শতকে এসে। ইংরেজ সরকার লবণ চাষ নিষিদ্ধ করে ইংল্যান্ড থেকে লবণ আমদানি শুরু করে। পরে ইংরেজরা ভারতবর্ষ থেকে পাততাড়ি গুটালে ১৯৪৭ সালে ব্যক্তি উদ্যোগে নতুন করে লবণ চাষ শুরু হয়। বর্তমানে এ উপজেলার অধিকাংশ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে লবণ চাষের সঙ্গে জড়িত। এই দ্বীপের মিঠা পানির সবচেয়ে বড় পুকুরটার পরিচিতি বড় দীঘি নামে। সেটাও এই ছোট মহেশখালীতেই। বাংলাদেশের দ্বীপগুলোতে এতো বড় দীঘি সচরাচর দেখা যায় না। দীঘির বুকে এক ঝাঁক হাঁস জলকেলিতে মত্ত। ৬টি ঘাটের সবক’টিতে গোসল করছে মানুষ। দীঘির পশ্চিমপাড়ে শহীদ মিনার, উপজেলা পরিষদ। স্থানীয় যুবক ধীমান দাস জানান, শুকনো মৌসুমেও এ দীঘি দুই মানুষ সমান গভীর। প্রতিবছর শ্রাবণ মাসে বড়শি দিয়ে মাছ ধরার প্রতিযোগিতা হয় এখানে। প্রতি সীট ব্রিক্রি হয় ১০ হাজার টাকায়। এ দীঘিতে ১৫ থেকে ১৮ কেজি পর্যন্ত রুই, কাতলা, চিতল পাওয়া যায়।
দক্ষিণপাড়া বৌদ্ধ বিহারের অবস্থান ১ নম্বর জেটির দক্ষিণ গোড়ায়। এখানকার দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যরীতি চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। মঠ আর ভাবনা ঘরে সোনালী রঙ। পশ্চিমে ছোট্ট জলাধারে ধ্যানরত বুদ্ধের মাথায় ফণা তুলে ছায়া দিচ্ছে নাগরাজ।
জনশ্রুতি অনুযায়ী, গৌতম বুদ্ধ বৌদ্ধত্ব লাভের পর সাতটি স্থানে এক সপ্তাহ করে ধ্যানমগ্ন ছিলেন। ষষ্ঠ সপ্তাহ তিনি ধ্যানমগ্ন থাকেন এখানে। তিনি এখানকার পুকুরে ধ্যানমগ্ন থাকার সময়ে প্রবল ঝড়বৃষ্টি হয়। তখন ফনা বিস্তার করে এক সপ্তাহ বুদ্ধের মাথার ওপর অবস্থান করেন নাগরাজ।
দক্ষিণ চত্বরে বিবর্ণ হয়ে যাওয়া মঠের শরীরে সোনালী রঙের নতুন পোঁচ চড়াচ্ছেন বিকাশ দে। দেখালেন, রঙের কৌটাগুলো মিয়ানমারের।
এখানে সব স্থাপনার নিচেই রাখাইন ভাষায় পরিচিতি লেখা। বাংলাদেশের ভাষা বাংলা বা আন্তর্জাতিক ভাষা ইংরেজি কোনোটারই প্রবেশাধিকার নেই এখানে। এখানকার এক ধর্মগুরুর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা বিফলে গেলো। রাখাইন ভাষা ছাড়া আর কোনো ভাষা জানেন না তিনি।
ধোয়ামোছা চলছে প্রায় তিনশ’ বছরের পুরনো বড় রাখাইনপাড়া বৌদ্ধ মন্দিরেও। বিশাল বাঁধানো চত্বরজুড়ে মঠ, আশ্রম আর বোধীবৃক্ষ।
একটি মঠে বুদ্ধের সামনে দু’পাশে দাঁড়িয়ে দুই শিষ্য দেবরাজ আর ব্রহ্মণরাজ। সামনে মহানাম, অসসজি, ভদ্দীয়, বপ্প আর কৌণ্ডিণ্য বসে আছেন। বুদ্ধের পেছনে দু’পাশে দুই হরিণ।
প্রবেশপথে চম্পা গাছে মাথা ভর্তি ফুল। উল্টোদিকে রাখাইন মার্কেট। রাখাইন পল্লীতে তাঁতে বোনা জামা, চাদর, লুঙ্গি বেশ সস্তায় বিকোচ্ছেন নারী দোকানিরা।
মাতৃপ্রধান সমাজব্যবস্থা হওয়ায় এখানে নারীরাই পুরুষদের চেয়ে সব কাজে এগিয়ে। এমনই এক দোকানি রানু শেমু জানালেন, পর্যটক মৌসুম না হওয়ায় বেচাকেনা এখন অনেক কম হয় দোকানে।
তার স্বামী শেমুল মং একটু দূরে বার্মিজ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি দেখিয়ে বললেন, নামে বার্মিজ হলেও ওখানে কিন্তু এখন আর রাখাইন ভাষা পড়ানো হয় না। যদিও রাখাইনরা নিজস্ব ভাষায় কথা বলে। ভাষা, সংস্কৃতি আর সত্ত্বার দিক দিয়ে তারা আর সব সম্প্রদায়ের চেয়ে আলাদ।
প্রতি নভেম্বর-ডিসেম্বরে এই বড় রাখাইনপাড়া মন্দিরকে ঘিরে জমে ওঠে মেলা, পূজা, নিজস্ব সংস্কৃতির নানা আয়োজন। নিজস্ব গয়না, থামি আর হাফ ফতুয়া পরে চন্দন মেখে চোখ জুড়ানো ত্বকের অধিকারী হয়ে ওঠা তরুণীরা।
একসময় মহেশখালী দ্বীপে ছিলো বাঘ, হরিণ, বানর, হাতি, ভাল্লুক, নানা প্রজাতির সাপ, দেশি ও পরিযাযী পাখিসহ নানা জীবজন্তু। সর্বশেষ ২০১২ সালের জরীপেও এখানে মিলেছে কিছু হরিণ, বানর, কয়েক প্রজাতির সাপ। এখনো শীতকালে এ দ্বীপ হয়ে ওঠে পরিযায়ী পাখির স্বর্গ।
১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল প্রায় ২৫০ কিলোমিটার বেগে এখানে আঘাত হানে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়। দ্বীপটির ওপর দিয়ে বয়ে যায় প্রায় ১৯ ফুট উঁচু সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস। সেই তাণ্ডবে কক্সবাজার জেলায় নিহত অর্ধ লক্ষ মানুষের অধিকাংশই ছিলো মহেশখালীর।
সেই ক্ষতি কাটিয়ে এখন অবারিত সম্ভাবনার গান শোনাচ্ছে মহেশখালী। তিন দিকে সমুদ্র সৈতক, গাছ-লতায় ছাওয়া বালিয়াড়ি, সৈকত জুড়ে বিচরণকারী লাল-কাঁকড়া, জলপাই রঙের বিরল কচ্ছপ, কেয়া-নিশিন্দার ঝোপ, নানা প্রজাতির জলচর পাখি আর ছোট ছোট খাল বিশিষ্ট প্যারাবন দ্বীপটিকে করেছে অপরূপ রূপবতী।
দেশের প্রধান শুটকি উৎপাদন কেন্দ্র এই মহেশখালীই। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে একচেটিয়া ব্যবসা করছে মহেশখালীর শুটকি।
এখানকার মিঠাপানের সুখ্যাতিও বিশ্বজুড়ে। যদিও সামনে বর্ষাকাল বলে শুটকির কর্মযজ্ঞ এখন নেই বললেই চলে। মৎস্য সম্পদের বেলায় এখানে চিংড়ির পরই কাকড়ার অবস্থান।
বাংলাভাষার ৫৭টি উপভাষার মধ্যে মহেশখালী দ্বীপের ভাষা হলো মিশ্র উপভাষা। আঞ্চলিক ভাষায় মিশেছে আরব বণিকদের প্রভাব। এখানকার অধিবাসীরা আরবী ভাষার ‘লা’ এর আদলে ‘না’ শব্দটি আগে বসিয়ে বাক্য তৈরি করে। যাব না বাক্যটিকে বলে ‘ন যাইয়ুম’।
এখানকার জন্ম-বিয়েতে হয় কোমর দুলিয়ে নাচ। গাওয়া হয় অহলা নামে এক ধরনের গীত। বলী খেলা এখানকার আদি্ ঐতিহ্য। আর ঝড়, তুফান, খরা এবং বিপদ-বালাই থেকে মুক্তির জন্য ফানুস বাতি ওড়ায় মহেশখারীর বৌদ্ধরা। সব মিলিয়ে আরাকান, আকিয়াব আর চট্টগ্রামের সংস্কৃতি এক হয়ে মিশে আছে মহেশখালীতে।
বাংলাদেশ সময়: ১৯১৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ১২, ২০১৬
জেডএম/