লাউড়াছড়া (শ্রীমঙ্গল) থেকে ফিরে: হাত দশেক উঁচু ডালে বসে চাম কাঁঠাল খাচ্ছিল এক বানর। খুটে খুটে খাওয়ার দৃশ্য দেখতে খুবই ভালো লাগছিল।
তাড়িয়ে দেওয়ার জন্য ঢিল ছুঁড়ল, নাকি খাওয়ার জন্য দিল বুঝতে পারলাম না। ছুঁড়ে দিয়েই আবার খাওয়ায় মনোনিবেশ করল। সে কারণে মনে হলো হয়তো খাওয়ার জন্যই দিয়েছে, কাঙ্গালের মতো তাকিয়ে ছিলাম বলে। ঠিক চিড়িয়াখানায় গেলে চিপস খাওয়ার সময় বানর তাকালে যেভাবে অনেকেই এক আধ টুকরো ছুঁড়ে দিই, তেমনি এখানে ওরা স্বজাতি ভাইয়ের সঙ্গে ব্যবহারের পাল্টা জবাব দিচ্ছে বলে অনুমান করলাম।
লাউড়াছড়া রেস্ট হাউসের সামনের ওই গাছটিতে কাঁড়ি কাঁড়ি চাম কাঁঠাল পেকে বাদামী হয়ে আছে। একটি দু’টি নয়, এ রকম অনেকগুলো গাছ দেখলাম পাশাপাশি। প্রত্যেকটিতে চাম কাঁঠাল ঝুলছে। কোথাও আবার পাকা চাম কাঁঠাল ধপাধপ খসে পড়ছে, ঠিক যেভাবে শুকনো নারিকেল গাছ থেকে খসে পড়ে।
শ্রীমঙ্গল শহর থেকে যখন বনের ভেতরের পিচঢালা পথ বেয়ে রেস্ট হাউসে যাচ্ছিলাম, তখন দেখেছিলাম রাস্তার উপর অনেক চাম কাঁঠাল গড়াগড়ি খাচ্ছে। আবার কোথাও খাবারের পর উচ্ছিষ্ট অংশ পড়ে ভিন্ন আবহ তৈরি করেছে। অনেকটা দাদী নানীদের কাছে শোনা গল্পের মতো। তারা বলতেন, আগের দিনে নাকি খাওয়ার লোক থাকত না। গাছের নিচে পড়ে থাকতে থাকতে পচে যেতো আম, কাঁঠাল, বরই, জাম, জলপাই ও তেঁতুল। খানিকটা তেমনি হয়েছে এখানকার পরিবেশ।
চাম কাঁঠালের সঙ্গে জীবনের প্রথম পরিচয়। এর আগে কখনও এই ফলটি সরাসরি দেখা হয় নি। দেখতে অবিকল কাঁঠালের মতো, তবে সাইজ ঠিক বেলের সমান। গায়ে কাঁঠালের মতো ধারালো কাঠা। কাঁচা থাকতে সবুজ, কিন্তু পাকলে কলার মতো হলুদ হয়ে যায়।
মনের মধ্যে উঁকিবুকি দিচ্ছিলো ফলটির স্বাদ নেওয়ার আকুলতা। কিন্তু এমন কাউকে পাওয়া যাচ্ছিল না যাকে দিয়ে তাজা ফল পাড়ানো যায়। একজন পরামর্শ দিলেন বানরের ছুঁড়ে দেওয়া চাম কাঁঠাল খেয়ে দেখতে। এ নিয়ে বেশ হাসাহাসিও হল নিজেদের মধ্যে।
তবে এক ধরনের ভালো লাগা কাজ করছিল মনের মধ্যে। অসংখ্য বানর দেখলাম চারদিকে। সবগুলোর চেহারা নাদুস নুদুস। চিড়িয়াখানার খাঁচাবন্দি বানরের মতো রোগাটে নয়। চাম কাঁঠালের মৌসুমে ভীষণ রকম আনন্দে দিন যাচ্ছে, দেখেই বুঝা যাচ্ছে। আপন মনে খেলা করছে বানরগুলো। কোনটি আবার মুখ ভেংচি কাটল আমাদের দিকে।
লাউয়াছড়া বনকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়ে গেছে শ্রীমমঙ্গল থেকে কমলগঞ্জ সড়ক। সড়কটির দু’পাশে গহীন বন। তাতে দানবীয় গতিতে ছুটে চলছে হরেক রকম যানবাহন। হরহামেশা এপার ওপার হচ্ছে বানরগুলো। বানরের পাশ দিয়ে যানবাহনের হুসহুস করে ছুটে চলা দেখে ভয় লাগছিল। হায় হায় না জানি কখন দুর্ঘটনা ঘটে।
চাকায় পিষ্ট হয়ে প্রাণহানির ঘটনায় ঘটেছে অহরহই। যানবাহনের অনুমোদিত গতি ২০ কিলোমিটার হলেও কাউকেই মেনে চলতে দেখা গেলো না। বরং ফাঁকা রাস্তা পেয়ে গতি বাড়িয়ে দিচ্ছেন চালকরা। আমরা সিএনজি থেকে নেমে ওদের খেলা দেখছিলাম। হা-ডু-ডু খেলায় টিক দেওয়া খেলায়াড়কে যেভাবে ধামকি দেওয়া হয়, তেমনি ভাবে কয়েকটি বানর আমাদেরভয় দেখানোর চেষ্টা করল।
সঙ্গে থাকা বনকর্মী বললেন, কেউ দাঁড়ালে ওরা বিরক্ত হয়। সে কারণে আপনাদের চলে যাওয়ার জন্য ভয় দেখাচ্ছে। চাম কাঁঠাল ছাড়াও ডেউয়াসহ অনেক ফলের কারণে বেশ ভালো সময় যাচ্ছে বন্য এই বানরদের। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বেশ কিছু উল্লুক। সকালের দিকে গেলে তাদের খেলা আপনার প্রাণ ভরিয়ে দেবে।
বিকেলে শ্রীমঙ্গল স্টেশন এলাকায় ভ্যানে করে চাম কাঁঠাল বিক্রি হতে দেখলাম। তখন কিনে পরখ করার সুযোগ হলো। স্বাদ অনেকটা ডেউয়ার মতো। তবে ডেউয়ার চেয়ে টকের পরিমাণ অনেক কম। স্বাদ নিয়ে আশা পূরণ হলেও দুর্ভাবনায় পড়ে গেলাম পরক্ষণেই। হায় এইভাবে যদি বন থেকে চাম কাঁঠাল সংগ্রহ করা হয়, তাহলে বানরগুলো খাবে কি? আর খাবার না পেলে ওরা এখানে থাকবে কেমনে। আর ওরা যদি না থাকে তাহলে লাউয়াছড়ার ভবিষ্যত কি হবে?
বাংলাদেশ সময়: ১৩৩৫ ঘণ্টা, জুন ২২, ২০১৬
এসআই/জেডএম