লাউয়াছড়া (শ্রীমঙ্গল) থেকে: মাঝরাতে ভৌতিক অবয়ব নিয়েছে লাইয়াছড়ার রহস্যময় গাছটা। অতীব বিরল প্রজাতির এই গাছের পাতার গন্ধ শুঁকলেই নাকি অজ্ঞান হয়ে পড়তো মানুষ।
হঠাৎ ঝড়ে ভেঙে পড়ার পর কেবল ফুট পাঁচেক মরা কাণ্ড টিকে আছে গাছটির। ওপর থেকে ভেতরে ঢুকে যাওয়া খোঁড়লটিতে নিকষ অন্ধকার। একপাশে আফ্রিকান ওক ট্রি ট্যাগ লাগানো। খোঁড়লের মতোই অন্ধকার দানা বেঁধেছে তৃণলতায় ছাওয়া টিলার পাশের কাণ্ডটিকে ঘিরে।
এ এলাকাটায় রক্তন গাছের আধিক্য। যেনো মাথা উঁচু করে আকাশ ছোঁয়ার প্রতিযোগিতায় মেতেছে গাছগুলো। মাথার অনেক ওপরে তাই প্রাকৃতিকভাবেই তৈরি হয়েছে পাতার ছাউনি। ওই ছাউনির কারণেই দিনের আলোও ঠিকঠাক প্রবেশ করে না লাউয়াছড়ায়। আর এখন তো তৃতীয় প্রহরে গড়িয়েছে বনের রাত। টর্চের আলো নেভালেই ঘুটঘুটে অন্ধকার।
চারপাশে চেনা-অচেনা কীট-পতঙ্গ আর বন্যপ্রাণির ডাক-চিৎকার। একটানা গেয়ে চলেছে লক্ষ-কোটি ঝিঁঝিঁ পোকা। ওগুলোর ভেতর থেকে তক্ষকের ডাকটাকে বেশ আলাদা করেই চেনা যাচ্ছে। আর চেনা যাচ্ছে পাখির ডাকের মতো অদ্ভূত শব্দটাকে। অথচ ওটা পাখির ডাক নয় মোটেও। ছোট্ট এক পোকার কণ্ঠ চিরে এমন তীক্ষ্ম আওয়াজ অদ্ভূতই বটে। এই অদ্ভূত পোকার ডাককে নাম দেওয়া হয়েছে ফরেস্ট মিউজিক। রাতে বটেই, দিনে-দুপুরেও এই ফরেস্ট মিউজিক বাড়তি পাওনা পর্যটকদের।
হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লেন বিট অফিসার রেজাউল করিম। রাতের এই বিশেষ অভিযান পুরোটাই নির্ভর করছে তার ওপর। কুলকুল করে বয়ে চলা ছোট্ট এক ছড়ার দু’পাশে টর্চের আলো ফেলে কী যেনো দেখছেন। অস্ফুটে বলছেন, কেমন একটা গন্ধ পাচ্ছেন না? সব বন্যপ্রাণিরই বুনো একটা গন্ধ থাকে। এই গন্ধটা গন্ধগোকুলের।
অনেক খোঁজাখুজি করেও গন্ধগোকুলের টিকিটিরও দেখা পাওয়া গেলো না। ঘণ ঝোপ আর লতা-গুল্মের আড়ালে গন্ধগোকুলের গন্ধটা ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে বলে মনে হলো। তবে রাতের আঁধারে টর্চের আলোয় অদ্ভূত রূপ মেলে চোখের সামনে ফুটে রইলো অনিন্দ্যসুন্দর লাউয়াছড়া। দিনের আলোর চেয়ে রাতের আঁধারে বনের এই রূপ একেবারেই অন্যরকম, অবর্ণনীয়। কয়েক ঘণ্টা আগে হয়ে যাওয়া বৃষ্টিতে লতা-পাতায় ঝা চকচকে রূপ।
এমন রূপের টান কাটিয়ে ওঠা মুশকিল। তবুও জোর করে চোখ ফিরিয়ে সামনে চলতে হয়। বিট অফিসকে পাশ কাটিয়ে শ্রীমঙ্গল থেকে কমলগঞ্জগামী পাকা সড়কে উঠে আসে নিশাচর কাফেলা। যোগ হয় রাইফেলধারী, মসৃণ লাঠি হাতের বনকর্মী।
শ্রীমঙ্গলের দিক থেকে বনের নীরবতা চিরে একটা জিপ গাড়ি এসে ব্রেক কষে কাফেলার পেছনে। রাইফেল হাতে নামেন আরো বনরক্ষী। এই রাত দুপুরেও ছুটে এসেছেন সহকারী বন সংরক্ষক তবিবুর রহমান আর রেঞ্জ অফিসার সাহেব আলী মিয়া।
এমন গভীর রাতে জঙ্গল ট্রেকিংয়ের কথা শুনে বন্দুকধারী আর লাঠি হাতের আরো ক’জন বনকর্মী সঙ্গে দিয়ে দেন তিনি।
মাথা তুলে আকাশের গায়ে দুলতে থাকা চাপালিশ গাছের ডগাটাকে দেখান। রাস্তার অপর পাশের এক গর্জন গাছের দিকে ঝুঁকে রয়েছে মাথাটা। সাদা আকাশের গায়ে কালচে দেখাচ্ছে।
আঙুল তুলে বলেন, ওই মগডাল, ওটা হয়তো অতো মজবুত নয়, কিন্তু ওটাই লজ্জাবতী বানর আর চশমাপরা হনুমানের যাতায়াতের পথ। এক মগডাল থেকে আর এক মগডালে চলাফেরা করে ওরা। কিন্তু ওই যে দেখেন, আশপাশের গাছগুলো ঠিক গোটা রাস্তাটাকে ছেয়ে ফেলতে পারেনি। তাই কোনো বানর বা হনুমানের এই পাকা রাস্তা পার হতে হলে গাছ থেকে নেমে রাস্তায় আসতেই হবে। এ কারণেই এ এলাকায় দুর্ঘটনা বাড়ছে। রাস্তায় পিষে যাচ্ছে কতো যে প্রাণী তার হিসাব কষা মুশকিলই বটে।
চলবে...
**তপ্ত জলে মিশে আছে নির্মাইয়ের কান্না
** চায়ের রাজধানী সবুজ শীতল শ্রীমঙ্গলে
**৪ ঘণ্টায় চায়ের দেশে
**ট্রেন চলেছে চায়ের দেশে
বাংলাদেশ সময়: ১১৪৬ ঘণ্টা, জুলাই ১৬, ২০১৬
জেডএম