হবিগঞ্জ থেকে: মুক্তিযুদ্ধের উপ-প্রধান সেনাপতি এম এ রবের নামাঙ্কিত গোলচত্বরে নেই কোনো স্থাপনা। বেশ বড় আকৃতির গোলচত্বরের তিনদিকে তিনটি নামফলক থাকলেও, সেগুলো কোচিং সেন্টার, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, স্থানীয় নেতাদের পোস্টার বা ব্যানারে ছেয়ে থাকে সারা বছর।
হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার শায়েস্তাগঞ্জের এম এ রব গোলচত্বর পোস্টার-ব্যানারে ঢেকে থাকায় সেখানে আগত অনেকে জানতেও পারেন না চত্বরটি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম চিফ অব স্টাফের নামাঙ্কিত! কাজের প্রয়োজনে পার্শ্ববর্তী জেলা থেকে শায়েস্তাগঞ্জে আসা লোকজনের অনেকেই জানেন না চত্বরটির নামও। স্থানীয় অনেকে চত্বরটির নাম বলতে পারলেও নামকরণের কারণ জানেন না তারাও। এভাবেই হবিগঞ্জের কৃতীসন্তান মেজর জেনারেল এম এ রব বিস্মৃত হচ্ছেন, সঙ্গে অবহেলিত হচ্ছে তার নামাঙ্কিত চত্বর।
মেজর জেনারেল এম এ রব গোলচত্বরে গিয়ে দেখা যায়, একটি নামফলকের নিচে ধানের খড়ের স্তূপ, ঠিক পড়ে আছে ময়লা-আবর্জনার বস্তা। আরেকটি নামফলকে দেখা যায়, বারবার পোস্টার সাঁটানো এবং তুলে ফেলায় ফলকের রঙ ফিঁকে হয়ে ঝাপসা হয়ে গেছে এম এ রবের নাম!
নিদারুণ এ অবস্থা আরও দৃশ্যমান হয় চত্বরটি প্রসঙ্গে শ্রীমঙ্গল থেকে আসা এক যুবকের সঙ্গে আলাপ করতে গেলে। গোলচত্বরের নাম জিজ্ঞেস করলে যুবক অপরাধীর মতো লাজুক হাসিতে জবাব দেন, ‘ নাম সাইনবোর্ডে লেখা আছে’। বলেই সঙ্গে সঙ্গে একটি নামফলকের দিকে আঙুল বাড়িয়ে দিয়ে পরক্ষণেই স্তম্ভিত হয় সেই যুবক। কারণ, নামফলকটি তখন স্থানীয় এক নেতার ডিজিটাল ব্যানারে ঢাকা!
স্বাধীনতা যুদ্ধের এক মহান সৈনিকের নামকরণে যে চত্বর তাতে নেই সেই যোদ্ধার কোনো ছবি বা মূর্তি। এমনকি সেখানে নেই মুক্তিযুদ্ধ সংশ্লিষ্ট অন্য কোনো কিছুই। ফলে হবিগঞ্জের এই কৃতীসন্তানকে তার নিজ জনপদের মানুষরাই ভুলতে বসেছেন প্রায়। স্থানীয় বাসিন্দা আরিফুল ইসলাম রনিও গোলচত্বরের নাম ঠিকভাবে বলতে পারেননি। ওই চত্বর থেকে কয়েকশ’ গজ দূরে স্থাপিত হয়েছে এম এ রব গেইট। হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসন স্থাপিত ওই গেইট এম এ রবের ছবি সম্বলিত হলেও একই রকম অযত্ন আর অবহেলার শিকার।
মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আব্দুর রব বা এম এ রব ১৯১৯ সালে বানিয়াচং উপজেলার খাগাউড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৩৯ সালে সিলেট এমসি কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি এবং পরবর্তীতে ভারতের আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ ডিগ্রি অর্জন করে তদানীন্তন ব্রিটিশ-ভারত বাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৪৪ সালে কমিশন লাভের পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে বার্মা, মালয়, সুমাত্রা, জাভা এবং পরবর্তীকালে কাশ্মীর সীমান্তে যুদ্ধ ও প্রতিরক্ষায় সক্রিয় অংশ নেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন শেষে ১৯৭০ সালে অবসর গ্রহণের পর রাজনীতিতে যোগ দেন তিনি। একই বছরে তিনি বানিয়াচং-নবীগঞ্জ-আজমিরীগঞ্জ এলাকা থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৭১ সালে এপ্রিল মাসে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হবার পর তিনি সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ পদে নিযুক্ত হন। মুক্তিযুদ্ধে অবদানের কারণে তাকে বীরউত্তম খেতাব দেয় বাংলাদেশ সরকার। ১৯৭২ সালের ৭ এপ্রিল পর্যন্ত তিনি সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ পদে বহাল ছিলেন। অবসর গ্রহণ তালিকা সংশোধনের পর তাকে অবৈতনিক মেজর জেনারেল পদমর্যাদায় ভূষিত করা হয়। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে এম এ রব সফলভাবে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন ও পরিচালনা করেন।
১৯৭৫ সালের ১৪ নভেম্বর ৫৬ বছর বয়সে রক্তশূন্যতাজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) মারা যান এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। মৃত্যুর পর তাকে হবিগঞ্জ শহরের উপকণ্ঠে খোয়াই নদীর তীরে উমেদনগর কবরস্থানে দাফন করা হয়।
** শীতল বনের খোঁজে বোকা বনে যাওয়া
** আরও পড়ুন... দিনের যাত্রী আসনই রাতের বিছানা
বাংলাদেশ সময়: ০৮৪০ ঘণ্টা, জুলাই ১৭, ২০১৬
এমজেএফ/পিসি