লালাখাল ঘুরে: শান্ত ছেলেটা স্বভাবে শান্ত হলেও হঠাৎ অশান্ত হয়ে উঠলো তার ট্রলার। মাঝ নদীতে প্রবল স্রোতের টালমাটাল ঘূর্ণি।
কোনোমতে উল্টে যাওয়া ঠেকানো গেলো বটে, কিন্তু নৌকার খোল ভরে গেলো পানিতে। দ্রুত ইঞ্জিন বন্ধ করে পাড় ঘেঁষা নলখাগড়ার বনে ঢুকে পানি সেচতে শুরু করলো কিশোর শান্ত। একটু উজানে ভারতের চেরাপুঞ্জি, বিশ্বের সর্বাধিক বৃষ্টিপাতের স্থান। আর বাংলাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বিশি বৃষ্টিপাত হয় এ লালাখালে।
বৃষ্টির চরিত্র জানান দিতেই বোধ হয় সকাল থেকে মুষলধারায় বৃষ্টি। গলুইয়ের বাইরে দাঁড়ানোই যাচ্ছে না। পানি সেচতে হচ্ছে একটু পর পর। কি করে যেনো একটা জোঁক উঠে এসেছে নৌকার পাটাতনে।
বৃষ্টির দেশে এসে কাকভেজা হতে হলো আকাশ ভাঙা বর্ষায়। নীল রঙ উধাও। উজান বেয়ে আসা পানিতে টইটুম্বুর লালাখাল। পাহাড় ধোয়া পানিতে ঘোলা হয়ে আছে নদী। দু’পাড় থেকে নদীর দিকে ঝুঁকে থাকা গাছগুলো মাথা চুবিয়ে আছে পানিতে।
গাছপালার ফাঁকে নদীর উজানে তাকাতে মেঘালয়ের পাহাড় ভেসে উঠলো চোখের সামনে। মনে হলো যেনো, পাহাড়ের নিচ থেকে বেরিয়ে এসেছে জলধারা। আদতে নদীটা সাপের ফনার মতো বাঁক নিয়েছে ওখানে। বাংলাদেশের সীমান্ত রেখাটাও নদীর বুকে বুকে রচনা করেছে সাপের ফনার মতো সীমান্তভূমি। চোখের সামনে ঝুলে আছে পাহাড়, বন আর নদীর অবর্ণনীয় সৌন্দর্য।
আর একটু এগুতেই গোল লাল চাতকিতে লেখা ‘আমি জিরো লাইন, আমাকে অতিক্রম করবেন না’। একটু পেছনে বিজিবি’র ক্যাম্পটা নিঃসঙ্গ টিলার ওপরে চোখ রাঙানি দিচ্ছে। ওপাশে পাহাড়ের গায়ে ঘন ঝোপের আড়ালে কোথাও লুকিয়ে আছে বিএসএফ ক্যাম্প। আর এগুনো যাবে না সামনে।
এমন সুন্দরের সঙ্গ ছাড়তে ইচ্ছা না করলেও ভাটির পথ ধরতে হলো এক সময়। বছরের এ সময়টায় সেকেন্ডে ৭৭৫ ঘণফুট পানি বয়ে যাওয়ার কথা লালাখালের বুক বেয়ে। কিন্তু পাহাড় বেয়ে নেমে আসা ঘোলা পানি বলে দিলো, আরও অনেক বেশি পানি আসছে এখন। ক্রমে ক্রমে খালের কিনারায় উঠে যাচ্ছে পানির স্তর।
ভারতের লোভাছড়ি নদী থেকে উৎপন্ন এই লালাখাল মূলত সারি গোয়াইন নদী। এই নদী এখানে বাংলাদেশে প্রবেশের পর জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট, কোম্পানিগঞ্জ ও সিলেট সদর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কোম্পানিগঞ্জে পড়েছে সুরমায়। বাংলাদেশে প্রবেশ মুখের কাছে এর নাম লালাখাল। একটু ভাটিতে গিয়ে সিংগার খাল নাম নিয়েছে বাদাম ঘাটে।
সব মিলিয়ে মাত্র ২৫.৭৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য সারি গোয়াইননের। সিলেট-জৈন্তাপুর রোডে সারিঘাটের কাছে প্রস্থ ১১৭ মিটার। ৭৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিছিয়ে আছে বারোমাসী প্রবাহের এই নদীর অববাহিকা। ফেব্রুয়ারিতে কম প্রবাহের মৌসুমে মাত্র পৌনে ১ মিটার গভীরতা থাকে সারি গোয়াইনে। প্রতি সেকেন্ডে বয়ে যায় মাত্র সাড়ে ৫ ঘণমিটার পানি। জিন্তু জুলাই মাসে পানি বেড়ে গেলে গভীরতা বেড়ে দাঁড়ায় সাড়ে ৮ মিটারে।
লালাখাল টি এস্টেট ঘাটে নেমে একটু এগুতেই চা বাগান। কোনো চেষ্টা তদবির ছাড়াই কারখানায় ঢুকে চা প্রক্রিয়াজাতকরণ দেখা হয়ে গেলো। বছরে ৫ লক্ষ কেজি চা উৎপাদন করে এম আহমদ গ্রুপের এই চা কারখানা। এ বাগানের ছয়শ’ শ্রমিকের অধিকাংশই বাঙালি।
এখানকার পাহাড়গুলো খাড়া। বাগানে চায়ের গাছগুলোর একটার সঙ্গে আর একটার দূরত্ব একটু যেনো বেশিই। তবে পাহাড়ের ফাঁকে জল ভর্তি খাল মনোমুগ্ধকর এক দৃশ্য সাজিয়ে রেখেছে এখানে।
ছোট্ট লালাখাল বাজারে কোনো খাওয়ার হোটেল নেই। স্থানীয় বাগানের চম্পা কলা প্রতি পিস বিক্রি হচ্ছে ৪ টাকা দরে। পাশেই এই ঘোর বর্ষাতেও ক্লাস চলছে নিশ্চিন্তপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।
সিলেট সদর থেকে এখানকার দূরত্ব ৩৫ কিলোমিটারের বেশি নয়। ২ ঘণ্টার জন্য নৌকা ভাড়া লাগলো মাত্র ৭শ’ টাকা।
বাংলাদেশ সময়: ১০২২ ঘণ্টা, জুলাই ২২, ২০১৬
জেডএম/
**রাজবাড়ি ভেঙ্গে বাজার, পুকুর ভরে বাড়ি
**লাউড়ের গড়ে বৃষ্টির বাগড়া
** বিশ্বের বৃহত্তম গ্রামে
** জগমোহিনীদের বিথঙ্গল আখড়ায়
** হারিয়ে যাচ্ছেন হবিগঞ্জের প্রতিষ্ঠাতা
**সাত শতাব্দীর সাক্ষী শঙ্করপাশা মসজিদ
**চুন ব্যবসায়ীর ঘাট থেকে মুক্তিযুদ্ধের সদর দপ্তরে
** চুরি গেছে মুড়ারবন্দরের শিলালিপি
**চেনা-অচেনা বন্য প্রাণীদের সঙ্গে লুকোচুরি
**বেটা-বেটির পুঞ্জি ঘুরে বীজহীন বাগানে
** রাত দুপুরে গভীর বনে ভয়ের সঙ্গে পাঞ্জা
** বন্যপ্রাণির বুনো গন্ধে মাতাল লাউয়াছড়ার রাত
**তপ্ত জলে মিশে আছে নির্মাইয়ের কান্না
** চায়ের রাজধানী সবুজ শীতল শ্রীমঙ্গলে
**৪ ঘণ্টায় চায়ের দেশে
**ট্রেন চলেছে চায়ের দেশে